কোনো অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে দাবি আদায় পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার আহ্বান
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা এবং সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু এক যুক্ত বিবৃতিতে চলমান কোটা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশব্যাপী ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। একইসাথে কোটা আন্দোলনে উত্থাপিত ৫টি সুনির্দিষ্ট দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সরকারের কোনো অপকৌশলে বিভ্রান্ত না হতে ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নেতৃত্ববৃন্দ বিবৃতিতে বলেন, “বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী হাজার হাজার শিক্ষার্থী পথে নেমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ পাবলিক ও কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে যুক্ত। আজও এই আন্দোলন সারাদেশ অচল হয়ে পড়েছে। ছাত্রসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন এবং দেশের বেশিরভাগ শ্রেণি-পেশার মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে এ আন্দোলন গণ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার শুরু থেকেই চরম নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। গত ৮ এপ্রিল প্রায় সারারাত পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর যে নির্মম-নিষ্ঠুর আক্রমণ করেছে তা বর্ণনার অতীত। বৃষ্টির মতো গুলি, টিয়ারশেল চালিয়েছে; লাঠিচার্জ করে আহত করেছে অনেককে। এর প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনে গত দুই দিন কার্যত সারা দেশ অচল হয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পথে নেমে এসেছে।
এই আন্দোলনে শুরু থেকেই সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ পুলিশ বাহিনীর মতোই শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করেছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে, হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা-নির্যাতন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে। ১১ এপ্রিল মধ্যরাতে কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি ইফফাত জাহান তিন ছাত্রীকে হলের একটি রুমে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই কয়েক হাজার শিক্ষার্থী হামলাকারীর শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনকারীদের চাপে নিপীড়ক ছাত্রলীগ নেত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে প্রশাসন বাধ্য হয়। নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের এই ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দেশের দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে এক সুতীব্র প্রতিবাদ। আমরা ছাত্রসমাজের এই ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানাই।
কোটা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ভূমিকার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল, শিক্ষক সমিতির এবারের ভূমিকায় তা ম্লান হয়ে গেছে। শতাধিক শিক্ষার্থী যখন রাবার বুলেট, টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলায় ভীষণভাবে আহত; তখন আমরা শিক্ষক নেতাদের তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি। বরং তারা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসায় হামলার প্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেছেন, সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সাথে সুর মিলিয়ে ‘আন্দোলনে জামাত-শিবিরের অনুপ্রবেশের কথা’ বলেছেন, ভাঙচুরকারীদের শাস্তির দাবি করেছেন। নিঃসন্দেহে ভাইস চ্যান্সেলরের বাসায় হামলা নিন্দাজনক, কিন্তু শিক্ষকনেতারা একটি বারের জন্যও শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলার বিষয়টি আনেননি। আন্দোলনের ন্যায্যতা তুলে ধরার বদলে তারা পুরো ঘটনাকে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। শিক্ষক সমিতির এমন অবস্থান শাসকদলের স্বার্থকেই কেবল সহযোগিতা করে। যদিও পরবর্তীতে অনেক সমালোচনার পরে এবং আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝে আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক সমিতি আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু একটি যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে শিক্ষক সমিতির এমন দ্বিচারিতা জনমনে কেবল অনাস্থাই বাড়িয়েছে।
আজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বরাতে আরেকটি খবর প্রচার করা হচ্ছে। তা হলো প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদের বলেছেন, সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা বলে কিছু থাকবে না। যদিও এটি প্রধানমন্ত্রীর কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, তবুও আমরা শাসকদের এমন কূটচালের ব্যাপারে ছাত্রসমাজকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। এই আন্দোলনে ছাত্রদের সুস্পষ্ট দাবি কোটা ১০ শতাংশে নিয়ে আসার। অর্থাৎ কোটা প্রথা সংস্কারের, বাতিল নয়। কেননা দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলোপের কথা বলে না। এখনো আদিবাসী, প্রতিবন্ধী কোটার প্রয়োজন আছে। অন্যান্য কোটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তা না করে যদি কোটা তুলে দেবার কথা সরকার বলে সেটা স্পষ্টতই হবে আন্দোলনকে নিয়ে আরেক ধরনের চালাকি। এর মাধ্যমে জনগণের মধ্যেই তারা বিভক্তি আনতে চাইবে। যারা প্রকৃত অর্থে কোটা সুবিধা পাবার যোগ্য তাদের সাথে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে। আমরা এসকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানাই।”
নেতৃবৃন্দ আন্দোলনকারী সকল ছাত্র-জনতাকে ৫ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন।