Thursday, April 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৯কোরবানির চামড়ার দাম: লাভের নেশা ধর্ম মানে না

কোরবানির চামড়ার দাম: লাভের নেশা ধর্ম মানে না

পোস্তা শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যতম বড় চামড়ার আড়ত। সেখানেই কথা হয় মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী কাওসার আলীর সাথে। ঈদের দিন ১৩৭টি চামড়া কিনেছেন ৫১ হাজার ৩৭৫ টাকায়। বিক্রি করেছেন ২৮ হাজার ৫০০ টাকায়। গড়ে প্রতিটি চামড়ায় লোকসান ১৬৬ টাকা ৯৭ পয়সা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানতে চাই, এবার দাম কম কেন? উত্তরে বলেন, “ভাই পুরোটাই লস। প্রথমে ভাবলাম ফালাইয়া দেই—পরে ভাবলাম ফালাইয়া কী লাভ?”

কাওসার আলী একজন উদাহরণ মাত্র, এরকম অসংখ্য কাওসার আলী এই ঈদে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। দাম কমার কারণ জানতে চাইলে মজুতদাররা বলছে, ট্যানারি মালিকরা দাম দিচ্ছে না। আবার ট্যানারি মালিকরা তা অস্বীকার করেছেন। আপাতভাবে তাদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এক জায়গায় তাদের অবস্থান একই — তা হলো সিন্ডিকেট গড়ে তুলে মৌসুমী ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সস্তায় চামড়া কেনা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোট ব্যবসায়ীরা কিন্তু লাভবান হয় ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। এবারের ঈদে এরকম কারসাজির মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

আড়তদার ও ট্যানারি মালিক পরস্পর দোষারোপ করলেও হিসাবটা একই
চামড়ার স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ এ শিল্প দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর। তা সত্তে¡ও প্রতিবছর কমছে দাম। এ জন্য ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা বিভিন্ন কৃত্রিম সংকটের কথা বললেও এর নেপথ্যে কাজ করছে উভয়ের কারসাজি। আড়তদাররা বলছে ট্যানারি মালিকদের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ পাওনা টাকা বছরের পর বছর অনাদায় থাকায় তারা বেশি পরিমাণ চামড়া কিনতে পারেনি। ফলে দামে ধস নেমেছে। ‘বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (BTA) এ দাবিকে প্রত্যাখান করেছে। ট্যানারি মালিকরা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় ও ব্যাংকগুলো ঋণ না দেওয়ায় তারা বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেনি। অথচ চামড়া খাতে ঋণ দেওয়ার নামে চলছে লুটপাট। এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছে, তার ৯০ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, “সার্বিকভাবে চামড়াশিল্পে এখন ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।” এক পর্যায়ে আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন ঘোষণা করে অর্থাৎ ব্যাংকের মূল হিসেব থেকে বাদ দেয়। এ খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিবিধান ভঙ্গ করা হয়। বেশিরভাগ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো জামানত নেই। খেলাপি গ্রাহকদের বেশিরভাগ কারখানাই বন্ধ, কিছু প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন।

জালিয়াতির ঘটনা নিয়মিত। ঋণের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি ঘটে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে। জনতা ব্যাংক এসময় ক্রিসেন্ট লেদারকলে অবৈধভাবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়। এর মধ্যে ঋণ দেওয়া হয় ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, “গত বছরের কোরবানির ঈদে চামড়া সগ্রহের জন্য দেওয়া প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশিরভাগই এখনও আদায় হয়নি। এবছর শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ব্যাংক থেকেই ট্যানারি মালিকদের ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।” কিন্তু আড়তদাররা বলছে, তাদের বকেয়া শোধ হয়নি। তাহলে টাকাগুলো গেল কোথায়?

অনিয়ম-দুর্নীতি সত্তে¡ও এ খাতে প্রতিবছর নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কাঁচা চামড়া কিনতে। গবেষণায় দেখা যায়Ñএ শিল্পের নামে ঋণ নিলেও তা স্থানান্তর ঘটছে অন্য শিল্পে।

সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে দেওয়া পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন বা বিক্রয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ মুনাফা করা। সেজন্য যা যা করা দরকার, পুঁজির মালিকরা তা-ই করে। কৃষকের উৎপাদিত ধান যেমন কৃষককে উৎপাদনের কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় অথচ খোলা বাজারে চালের আগুন দাম থাকে, তেমনি সবক্ষেত্রেই এটা ঘটে। বড় ব্যবসায়ীদের দাপটে ছোট ও মধ্য ব্যবসায়ী, তারও মধ্যবর্তী স্তরে যুক্ত থাকা অসংখ্য নি¤œমধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষ রাস্তায় বসে যায়। কোরবানির চামড়া নিয়ে এই কাণ্ডই ঘটছে। উপরন্তু কোরবানির চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ গরুর মালিক নিজে কখনও ব্যয় করেন না। এলাকার দরিদ্র মানুষ, এতিমখানা এসবে এই অর্থ ব্যয় হয়। মুনাফা ধর্মের তোয়াক্কা করে না; আবার করে, যখন ধর্মীয় জিগির তুললে আরও অধিক মুনাফা হবে বলে সে মনে করে।

চামড়া শিল্প : নতুন শিল্প নগরীর অব্যবস্থাপনা
২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর ঘটে চামড়া শিল্প নগরীর। প্রায় ২০০ একর জমির উপর স্থাপিত এর নির্মাণ কাজ ১৬ বছরেও শেষ হয়নি। লুটপাট-দুর্নীতির ফলে ১৭৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ এখন ঠেকেছে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকায়। শিল্পাঞ্চল জুড়ে রাস্তায় একটু পরপর জমে আছে নোংরা-দুর্গন্ধময় পানি। কিছু রাস্তায় হাঁটা প্রায় অসম্ভব। কিছু রাস্তা ছোট গাড়ি চলাচলেরও উপযোগী নেই।

এখনও প্রস্তুত হয়নি চামড়ার কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থান বা ডাম্পিং ইয়ার্ড। পুরোদমে চালু হয়নি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)। এ কাজ দেড় বছরে হওয়ার কথা থাকলেও ৫ বছরেও শেষ হয়নি। নির্মাণ খরচ ছাড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তরল বর্জ্য শোধন করার কাজ (ডি-ওয়াটারিং) হচ্ছে না। কারণ এ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র এখনও আসেনি। এই প্রজেক্টের টাকা লুটপাট যেমন চলছে, তেমনি বছরের পর বছর ধরে শিল্পাঞ্চলকে অযোগ্য করে রেখে লাভ হচ্ছে কার? মালিকের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি? তারা তো তাদের বিভিন্ন ক্ষতি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পেতে পারেন সহজেই, পাচ্ছেনও। কিন্তু শ্রমিকদের অবস্থা কি সেরকম?

চামড়া শিল্পে শ্রমিকদের অবস্থা
হাজারীবাগের চেয়ে সাভারে কয়েকগুণ বেশি জমি দিয়ে মালিকদের প্ল্যান্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আছে ক্ষতিপূরণ ও ১০ শতাংশ প্রণোদনা। অথচ যে শ্রমিক হাত না লাগালে কারখানার চাকা ঘুরবে না — তাদের জন্য ন্যূনতম অধিকার এখানে নিশ্চিত করা হয়নি। আবাসন-হাসপাতাল-ক্যান্টিন কিছুই নেই। হাজারীবাগে যেসব শ্রমিক কাজ করতেন, তাদের বড় একটা অংশ ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। অন্য যারা সাভারে যুক্ত হয়েছেন, তারা এখনও হাজারীবাগ থেকেই বাসে বা লেগুনাতে যাতায়াত করেন। কারণ, ট্যানারি চালু হওয়ার পর সাভার এলাকায় বাসা ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। এ শিল্পে যুক্ত ২০ হাজার শ্রমিক মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। শ্রমিকরা নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে।

শ্রমজীবী-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষেরাই মূলত আক্রান্ত
পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। ১৯৭০ সাল থেকে এ শিল্পের বিকাশ ঘটলেও বর্তমানে সুষ্ঠু জাতীয় নীতির অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে এ শিল্প আজ সংকটের মুখোমুখি। শিল্প বিস্তার রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়, শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি এনজিও’র অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চামড়া চীন ছাড়া আর কেউ কিনছে না। অথচ এ ব্যাপারে কোনো বলিষ্ঠ উদ্যোগ সরকরের দেখা যাচ্ছে না। কারণ চামড়া তো চীনে বিক্রি হচ্ছে, সেটা থেকে লাভ তো আসছেই। আবার এই সংকটের দোহাই দিয়ে ব্যাংক ঋণ মওকুফসহ সরকারি সকল রকম প্রণোদনা পাওয়া যাবে। সকল রকম অন্যায় করে বলা যাবে, আমরা খুব সংকটে, শিল্পটাকে বাঁচান। আর এই শ্রেণিবিভক্ত রাষ্ট্রে শিল্প বাঁচানো মানে শিল্পমালিকদের বাঁচানো; আর যারা শিল্পের প্রাণ, সেই শ্রমিকসহ কাঁচামাল আসার প্রক্রিয়ায় যত মানুষ প্রকৃতই শ্রম দেয়Ñতাদের আরও মানবেতর জীবনে নিক্ষেপ করা।

সাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments