২০২৩ সালের শুরুতেই কানাডাভিত্তিক অনলাইন প্রকাশনা ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’ এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ততদিনে অর্থাৎ ২০২২ সালের মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতির আকার ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থনীতিতে কোন দেশের হিস্যা কতটুকু সেটা দেখানোর জন্যই এই রিপোর্ট। এই রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ইতিমধ্যে আইএমএফ তাদের রিপোর্টে প্রকাশ করেছিল, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দুটি দেশ বিশ্বের ৫০টি বৃহৎ অর্থনীতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে- তার একটি বাংলাদেশ, অপরটি ভারত।
এই কথাগুলো সরকারের পক্ষ থেকেও বুক ফুলিয়ে বলা হয়। আমরাও শুনতে শুনতে জেরবার। কিন্তু বাস্তব জীবনের সাথে তাকে মেলানো যায়না। আমরা বুঝতে পারিনা, এতে আমাদের কী লাভ হলো? সরকারি হিসেবেই দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশের উপরে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে, দেশের ১২ কোটি ১০ লক্ষ মানুষই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেনা। মানসম্মত খাবার কিনতে না পারা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হিসেবে গোটা বিশে^র মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ (অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০২৩)।
তাহলে এই ৩৫তম অর্থনীতি দিয়ে আমরা কী করবো? প্রশ্ন উঠে, অর্থনীতির এই সিদ্ধান্তগুলো যে সকল সূচকের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো কি তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত নয়? কী দেখে এই অর্থনীতির বৃদ্ধিকে বিবেচনা করা হয়?
তবে কারও উন্নতি হয়নি, ব্যাপারটা এমন নয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অল্পসংখ্যক মানুষ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। বছরে অতিধনী বৃদ্ধির হারে আমরা গোটা বিশ্বকে পেছনে ফেলে দিয়েছি, কোটিপতি বাড়ছে হু হু করে। ফলে বাড়ছে ধনী-গরিব বৈষম্য। একটা দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য কেমন সেটা বোঝা যায় গিনি সহগ দিয়ে। সত্তরের দশক এবং আশির দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির গিনি সহগ ছিল ০.৩৬। তখন অর্থনীতি ছিল ছোট। কিন্তু আয়বৈষম্য ছিল কম। এরপর অর্থনীতির আকার যতই বেড়েছে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর যতো তালি আমরা পেয়েছি, আয়বৈষম্য ততই বেড়েছে। গিনি সহগ বাড়তে থাকা মানে আয়বৈষম্য বাড়ছে এবং এটি যখন ০.৫ অতিক্রম করে, তখন বুঝে নিতে হয় যে, আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০২২ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ০.৪৯৯। অর্থাৎ এটি একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে।
তার মানে, দেশের অর্থনীতি দু’ভাগ হয়ে আছে এবং এক ভাগের সম্পদ বৃদ্ধিকেই অর্থনীতির বৃদ্ধি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তারা সংখ্যায় ছোট, কিন্তু সম্পদ তাদের বেশি। আর যারা সংখ্যায় বেশি, সম্পদ তাদের খুবই অল্প। তা না হলে বছরে ২৭৬৫ ডলার অর্থাৎ মাসে ২৫ হাজার টাকার উপরে মাথাপিছু আয়ের মালিক এই দেশের শ্রমিকরা ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে রাস্তায় পড়ে গুলি খান কেন?
গার্মেন্টস খাত নির্ভর অর্থনীতি
রপ্তানী আয়ের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় অংশ এখানে কাজ করেন। এই রপ্তানীনির্ভর শিল্পটি কি আদৌ স্থিতিশীল ও ক্রমবর্ধমান? এর সাথে এই কথা যুক্ত যে, এই ধরনের রপ্তানীমুখী শিল্প দিয়ে একটা দেশের অর্থনীতি বড় (শুধু আকারের কথাই যদি ধরি) হলে তাকে কি আদৌ বড় বলা যায়?
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত, গার্মেন্টস শিল্প যাত্রা শুরু করে সত্তর দশকের শেষে। তবে আশির দশকেই এটি প্রসারিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে এই গার্মেন্টস খাতের উপর। এর আগে বাংলাদেশ কাঁচাপাট রপ্তানি করতো। এদেশে ভাল জাতের পাট উৎপাদিত হতো। পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে প্রথম। এদেশের আদমজী জুট মিল ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল। পাটজাত শিল্প উৎপাদনও হতো তখন। সত্তরের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল রপ্তানী পণ্য ছিল পাট। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বিশ্ব্যাংব্যাংকের পরামর্শে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৩ সালে আদমজী পাটকল বন্ধ করা হয়, আর বাকিগুলোকে ধীরে ধীরে রুগ্ন করে ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সকল পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়।
ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনীতি হয়ে পড়ে গার্মেন্টস নির্ভর। গার্মেন্টসের কাপড় তৈরির কাঁচামাল এবং বিক্রির বাজার- কোনটাই আমাদের হাতে নেই। দেশে গার্মেন্টসের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর ইউরোপে। এসকল দেশের বাজারও অনেক বছর ধরেই কৃত্রিমভাবে চাঙা রাখা হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে কেনাকাটা করা ও পরবর্তীতে সেটা শোধ করার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সেখানে। এতে হাতে টাকা না থাকলেও লোকে পণ্য কিনতে পারে। ওইসকল দেশের মানুষের মনে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় যে ভোগবাদী সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে, সেটাই বাজারকে স্ফীত রাখে। ভোগ্যপণ্যই বাজারে অর্থ চলাচলের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে, এইসকল ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করে বাজার অর্থনীতি টিকে থাকে।
কিন্তু এটা তো অস্থিতিশীল বাজার, যে কোনসময় এতে ধ্বস নামতে পারে। ২০০৮ সালে আমেরিকায় যখন মন্দা হলো, বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি তখন হুমকির মুখে পড়েছিল। সেসময় ধারাবাহিকভাবে ভর্তুকি দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষা করা হয়েছিল। আবার গার্মেন্টসই বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারবেনা। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ৭ বছর ধরে প্রতিবছর ৩ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই গার্মেন্টসে। অথচ পরবর্তী বছরগুলোতে দেখবো, রপ্তানি বাড়লেও কর্মসংস্থান কমেছে। ২০১১ থেকে ২০২০ এই ১০ বছরে এই খাত কর্মসংস্থান দিতে পেরেছে প্রতিবছর মাত্র ৬০ হাজার লোকের। আগের ৭ বছরের সাথে তুলনা করলে এটা খুবই কম। (বিশ্বব্যাংক ২০১৭)
অর্থাৎ গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান কমছে। আবার অটোমেশনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ গার্মেন্টস শ্রমিকই চাকরি হারাবেন বলে মনে করা হয়। তাহলে কাজ কোথায়? অর্থনীতি বড় হচ্ছে, অথচ কর্মসংস্থান হচ্ছেনা। উৎপাদনমুখী কোন নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। বেশিরভাগ খাতই সেবামুখী। দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় ৮৯ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তারা আজ এখানে তো কাল ওখানে কাজ করেন। এই অর্থনীতির কি কোন ভিত্তি আছে?
সস্তা শ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোকে ভারত ও চীন থেকে এদেশে নিয়ে এসেছিল, আরও সস্তা শ্রম নিয়ে এখন ইথিওপিয়া, মিয়ানমার ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো তাদের ডাকছে। তারা যেখানে সস্তা শ্রম পাবে, সেখানে যাবে। বৃহৎ অর্থনীতি, ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশ তখন কী করবে?
মেগা প্রকল্পের অর্থনীতি
মেগা প্রকল্পগুলো ফ্যাসিবাদী সরকারের উন্নয়নের প্রোপাগান্ডার সর্বপ্রধান অস্ত্র। বড় বড় প্রকল্পগুলো দেশকে শিল্পোন্নত করার জন্য নেয়া হয়নি, এগুলো মূলতঃ অবকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্প। দেশে যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হয়, তাহলে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলি টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে কারা চলাচল করবে? যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়েছে জ্বালানী সক্ষমতা বাড়াবে না। কারণ কয়লা, গ্যাস ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিরাট সক্ষমতা নিয়ে জ্বালানী সংকটে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে কিংবা সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম উৎপাদন করছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ফলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ খরচ বাড়ছে। তাই মেগা প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে না, দেশকে শিল্পোন্নত করবে না। যদিও মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে, অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে- একথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে প্রকল্প চলাকালিন কিছুলোকের সাময়িক কর্মসংস্থান হয়, দীর্ঘস্থায়ী কর্মসংস্থান হয় না। সেটাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, যেখানে লিখিত চুক্তির কোন বালাই নেই, যে কোন সময় যে কাউকে কাজ বাদ দেয়া যায়। কাজগুলোতে বিদেশি কোম্পানি যুক্ত থাকায় তাদের কাছ থেকে প্রকল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করতে হয়, অনেকসময় শ্রমিকদের একটা অংশও তাদের দেশ থেকে আসে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে শত শত ভারতীয় শ্রমিক যুক্ত ছিলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা শ্রমিকরা যুক্ত ছিলেন।
কর্মসংস্থানের এই গল্প দিয়ে ১০০টি স্পেশাল ইকনোমিক জোন বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। অথচ এই মেগা প্রকল্পগুলো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক বাস্তবায়নে উচ্ছেদ হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। রামপালে জমি দখল ঠেকাতে ‘ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়েছে। রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালীতে জমি দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষি জমির কোন এককালিন ক্ষতিপূরণ হয় কি? সবচেয়ে বড় কথা, কর্মসংস্থান হলে মানুষ দলে দলে প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতো না। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে, এই উন্নয়ন তাকে রাস্তায় বসাবে। এর ফলে বেকারত্ব বাড়ে, স্থানীয় কৃষি অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এককথায় গোটা স্থানীয় অর্থনীতিটাই পাল্টে যায়। কিছু রোজগার করে মোটামুটি চলতে পারা পরিবারগুলো শরণার্থীর মতো অবস্থায় পতিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৭ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে- এতে শত শত পরিবার সব হারিয়ে বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন।
অর্থাৎ এই প্রকল্পগুলো কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, স্থানীয় জনগণকে উচ্ছেদ করে এবং এক ধাক্কায় অনেক মানুষকে বেকার করে দেয়। এরাই পরবর্তীতে গার্মেন্টসের সস্তা শ্রমিকে পরিণত হন।
দানবিহীন দাতারা
তারা ঋণ দেন, দান করেন নাÑকিন্তু তারা দাতা, দাতাসংস্থা। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়া হয়, একে আবার বলা হয় ‘দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা’। যে সহযোগিতার সুদ দিতে হয়, সেটা কী ধরণের সহযোগিতা, তা বলাই বাহুল্য। এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও বাস্তবে খোলাখুলি তারা সেদেশের বৃহৎপুঁজির স্বার্থরক্ষা করেন। এটা করার জন্য মানবাধিকার, গণতন্ত্র, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদÑ এইসকল আলোচনা তোলা হয়।
বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই, গত ৭ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বিভিন্ন তৎপরতাগুলো ভেবে দেখুন। ভারত এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আতঙ্কিত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চিন্তিত মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে। এই আপাত অর্থে রাজনৈতিক শব্দগুলো শুনলে যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়, অথচ এর পেছনে আছে সেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারÑ ব্যবসা। নির্বাচনের ৩ মাস আগে, সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশ সফরে আসলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। শেখ হাসিনা তাকে সাথে সাথে প্রতিশ্রুতি দিলেন, সরকার ফ্রান্সের ‘এয়ারবাস’ কোম্পানি থেকে ১০টি উড়োজাহাজ ক্রয় করবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যতম প্রভাবশালী এই সদস্য নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আর কোন শক্তিশালী অবস্থান নেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বিরুদ্ধে বছরব্যাপী চলা প্রবল গর্জন সমাপ্ত হলো বাংলাদেশে তাদের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মার্কিন কোম্পানি ‘বোয়িং’ থেকে উড়োজাহাজ কেনার তদবিরের মাধ্যমে। নির্বাচনের একমাস পার হওয়ার আগেই তিনি শেখ হাসিনার সাথে দেখা করলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে এই প্রত্যাশা করলেন আর বোয়িং কেনার তদবির করলেন। বললেন, বাংলাদেশ বিমানের ক্রয় প্রক্রিয়া যাতে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয় এবং এখানে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে যুক্ত রাখা হয়।
আর ভারত তো সবই পাচ্ছে, এখানে কোন যদি-কিন্তু নেই। গত ১০ বছরে ভারত থেকে আমদানি ৩ গুণ বেড়েছে। ভারত যে ৬২টি দেশকে ঋণ দেয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। প্রায় ৬২টি প্রকল্পে ৮০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও এর মধ্যে ১৪৯ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। এই সকল কাজে কেবলমাত্র ভারতীয় ঠিকাদাররাই অংশ নিতে পারেন, একতরফা দামেই কার্যাদেশ দিতে হয়। প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ (কিছু ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ) সেবা ভারত থেকে কিনতে হয়। এগুলোর নাম হলো ‘দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা’। এই সহযোগিতার উপর এখন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো দাঁড়িয়ে আছে। নিভু নিভু অর্থনীতির জ¦ালানী হলো এই সহযোগিতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬১ সালেই বলেছিলেন, “বিদেশি রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানো হলো মার্কিন রণনীতির এ অবিচ্ছেদ্য কৌশল যার সাহায্যে আমেরিকা সারা বিশ্বে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে।”
এটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের চেহারা, এই তার চরিত্র। ফলে দেশে গড়ে উঠা বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও দেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত), এই দুইপক্ষকে সেবা দেয়ার সবচেয়ে যোগ্য বলেই আওয়ামীলীগ আজ ক্ষমতায়। আবার ভারতের বিরোধী শিবিরে থাকা চীনকেও তারা খুশি রাখতে পেরেছেন, পেয়েছেন রাশিয়ার আশীর্বাদ। যুক্তরাষ্ট্র চেঁচামেচি করে তার ভাগ হয়তো একটু বাড়ালেন, জাপান তো বহু আগে থেকেই সাথে আছেন। এই তো! এই হলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা আর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই!
পরিশেষে. . .
এই পুঁজিবাদী অর্থনীতি কাজের সন্ধান দেবে কিনা, জীবনমান উন্নত করবে কিনাÑ এই প্রশ্নই অবান্তর। এটা সেই ব্যবস্থাই নয়। ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার মধ্য দিয়েই এ থেকে মুক্তি ঘটতে পারে। এ ছাড়া এই নির্মম শোষণ, দুঃসহ অত্যাচার আর ঐতিহাসিক অন্যায় থেকে মানবসমাজের মুক্তির আর কোন পথ নেই।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশের রফতানিমুখী ‘উন্নয়নের’ ঝুঁকি, মধ্যবিত্তের বিকাশ ও স্থানীয় শিল্পায়নÑ মাহা মির্জা
২. বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য: সমাধান কোন পথে? Ñ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম