Wednesday, November 20, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধগণ আন্দোলন - ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য চাই উন্নত চরিত্র -...

গণ আন্দোলন – ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য চাই উন্নত চরিত্র – মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

Mubinul

কমরেড সভাপতি, সারাদেশ থেকে আগত সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের প্রতিনিধিবৃন্দ, মঞ্চে উপবিষ্ট আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী)-র নেতৃবৃন্দ, ভারত থেকে আগত ছাত্রনেতৃবৃন্দ- সকাল থেকেই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ছাত্রনেতারা শিক্ষা সম্পর্কিত নানা চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটু আগে কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তীও আলোচনা করলেন। তাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কী কী সংকট বিরাজমান – এসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আমি আর যাচ্ছিনা।

কেবলমাত্র শিক্ষা নয়, সমস্ত ক্ষেত্রই আজ ভয়াবহভাবে সংকটগ্রস্ত। সমাজজীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আজ আর বিকাশের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। এ অবস্থার কারণ কী? দেশের এই অবস্থা বোঝার জন্য প্রথমত রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বোঝা দরকার কোন সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলবৎ থাকার কারণে দেশের সমস্ত ক্ষেত্রই আজ সংকটগ্রস্ত, সমস্ত ক্ষেত্রই আজ বন্ধ্যা। দেশের অবস্থা নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সেই শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সংকটের শত শত দিক নিয়ে আলোচনা করলেও এই মূল বিষয়ে কখনও আলোকপাত করেন না। স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে আর এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাই সকল সংকটের কারণ। সকালবেলা অধ্যাপক চৌধুরীও একই কথা বলেছেন। দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা, হতাশা- এ সমস্ত কিছুর উৎপত্তি কোথায় তাকে তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন। আমি এ কারণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

কমরেড, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাই দেশের সমস্ত রকম সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী। এ ব্যবস্থায় একদিকে রয়েছে অল্প সংখ্যক পুঁজিপতি-ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, অন্যদিকে বিরাট সংখ্যক মেহনতি মানুষ। এই দুই শ্রেণীর প্রয়োজন এক নয়। পুঁজিপতিদের প্রয়োজন আর ব্যাপক শোষিত মানুষের প্রয়োজন পরস্পরবিরোধী। এমন কোনো উন্নতির ধারণা এই সমাজে নেই, যেখানে একই সাথে দুই শ্রেণীর কল্যাণ হয়। ফলে দেশ আজ দুইভাগে বিভক্ত। আমাদের দেশে আজ আর অবিভাজ্য কোনো জাতি নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে- এই প্রশ্ন দিয়ে আমরা আজ আর জাতিকে চিহ্নিত করতে পারিনা। আমাদের দেশে একদিকে আছে শোষিত-নির্যাতিত মানুষরা, আর অন্যদিকে আছে সাম্রাজ্যবাদীদের, বিশেষ করে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের শোষক পুঁজিপতিরা।তারা দেশে এক ধরনের পুঁজিবাদী সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। আজকের যুগে শিল্পোদ্যোগ সৃষ্টি করে পুঁজিবাদকে সম্প্রসারিত করার মতো বাস্তবতা বিশ্বের আর কোথাও নেই। বাংলাদেশেও নেই। এ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশও সেই পথে ঘটেনি। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন সংকটের কারণে সস্তা শ্রমের দেশ হিসেবে, সাম্রাজ্যবাদী  দেশগুলোর আউটসোর্সিংয়ের এক বিরাট ক্ষেত্র হিসেবে এদেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে এভাবেই পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটছে। গ্রাম-শহরের সর্বত্রই রয়েছে এই পুঁজিবাদ। গ্রামের চাষীরা তাদের ফসলের উৎপাদনমূল্যও পাচ্ছেনা। আস্তে আস্তে সহায়-সম্পত্তি, ঘর-বাড়ি সবকিছু হারিয়ে এই চাষীরা গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। সর্বহারা হয়ে তারা শহরে আসছে। শহরেও কোনো কাজ নেই। এই সব সর্বস্বান্ত মানুষেরা তখন ভাসমান শ্রমিক হয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। বৈধ পথে যারা যেতে পারছে না তারা অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। কখনও তারা রাস্তায় মারা যাচ্ছে, কখনও মাঝরাস্তায় ধরা পড়ে কোনো দূর দেশের জেলের অন্ধকারেই জীবন পার করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হলো। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনেকের লাশের খোঁজ পাওয়া গেলো। দালালরা তাদের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো এবং তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো। মাঝপথে বাঁধার কারণে এদেরকে সেখানেই মেরে গণকবর দিয়ে দেয়। এই হচ্ছে দেশের অবস্থা। দেশের গরীব মানুষের গন্তব্য।

cover onnushilon copyআর যারা বৈধ পথেও বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছে তারাও প্রকৃতপক্ষে দাস শ্রমিক হিসেবে খাটছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। অথচ সরকার বারবার দেশের উন্নতির ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ নাকি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের এক কোটি শ্রমিক বিদেশে কাজ করছে। গত দশ বছরে ১৭ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ এসেছে দেশে। প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিকের লাশ আসছে। আর এই মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বয়সই ৩৯ বছরের নিচে। তাহলে কিসের উন্নয়ন? শিল্পোন্নয়ন হলে কাজ কোথায়? শুধু পেট চালানোর জন্য দেশের যুবকরা জীবন তুচ্ছ করে বিদেশে  ছুটছে কেন? দেশের উন্নতি বোঝার জন্য এর থেকে বেশি তথ্য প্রয়োজন কি?

এই হলো পুঁজিবাদী পথে দেশের উন্নতির নমুনা। এই বিরাট সংখ্যক শ্রমিকরা, যারা একসময় দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলো, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে মার খাওয়া অবস্থার সৃষ্টি হলো।

আবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া শুরু হলো। কারিগরি শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিবাদী চিন্তা আসেনা। এর মধ্য দিয়ে শুধু কিছু কাজ চালানোর মতো দক্ষ লোক বের হয়। প্রকৃত সেক্যুলার, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সমূহকে কো-রিলেট করে। যার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনার ভিত্তি তৈরি হয়। এর অনুপস্থিতিতে মানুষের মধ্যে যুক্তি ও বিজ্ঞানমনষ্কতার বিরুদ্ধে কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তার প্রভাব বাড়তে থাকে। ফ্যাসিবাদের জমিন তৈরি হয়। আমাদের দেশে তাই হচ্ছে।

এরই সুযোগ নিয়ে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের মানুষের উপর চেপে বসেছে। আপাত নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে আনুষ্ঠানিকতা দেশে ছিল তা এখন আর নেই। পার্লামেন্ট এখন জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা- কিন্তু সেরকম কোনো প্রতিবাদ মূর্ত হচ্ছেনা। ফলে একটা বন্ধ্যা, সন্ত্রস্ত, মার খাওয়া অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এরকম কেন হলো? বিরাট লড়াই-সংগ্রাম করা এ জাতির আজ এই অবস্থা কেন? একদিন দেশের মা-বোনদের উপর ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের যুবকরা লড়েছে। বৃটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছে, পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল দেশের নারীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন নয় যে, যারা লেখাপড়া জানেনা, চিন্তা-চেতনায় এখনও সভ্য হয়ে ওঠেনি- বিষয়টি শুধু তাদের মধ্যে ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত- সর্বত্রই নারীরা লাঞ্ছিত, অপমানিত হচ্ছেন। কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই যৌন আকাক্সক্ষা উস্কে দেয়া হচ্ছে। একটি জরিপে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা শহরে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। তারা এসব দেখে, আলোচনা করে, আদান-প্রদান করে। এই ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কী?  প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই মানুষ মানুষ হয়েছে, আজ সেই প্রবৃত্তিকেই জীবনের পরম মোক্ষ বলে তুলে ধরা হচ্ছে। এসব কে করছে? করছে শাসকগোষ্ঠী, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য। আজ এই পুঁজিবাদ একদল বিবেকবর্জিত প্রবৃত্তির দাসত্ব করা মানুষ গড়ে তুলতে চায়। যদিও কোনো পিতা-মাতাই চান না যে তার সন্তান এমন হোক, কিন্তু এটি কারও চাওয়া না চাওয়ার উপর নির্ভর করেনা। এটি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। একটি বন্ধ্যা সমাজব্যবস্থা জোর করে টিকে থাকতে চাইলে সমাজের মানুষের নৈতিক মেরুদ- ভেঙে না দিয়ে পারেনা। কারণ সর্বস্ব হারানো মানুষ নৈতিকতার উপর, আত্মমর্যাদার উপর ভর করেই লড়াইটা করে। এটুকুও মেরে দিলে সে আর মানুষ থাকেনা। তখন সে শুধু জীবন ধারণ করার জন্য সকল প্রকার হীন কাজ করতে পারে। সমাজে এরকম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে- গণআন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, ভারতের এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ। তিনি বলেছিলেন, “দেশে চারিদিক থেকে এই যে একটা সর্বাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে জনগণ, ছাত্রসমাজ, মজুর-চাষী ও শোষিত জনগণের তরফ থেকে এইসব অন্যায় ও দুর্দশার বিরুদ্ধে কার্যকরী আন্দোলন গড়ে তোলার পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিচার করা যায়, তা হলে, আমার মতে, আর্থিক দুর্দশা ও অন্যান্য সংকটের চেয়েও সমাজের মধ্যে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সংকট ও অধঃপতন একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সমস্ত ক্ষেত্রে এটাই প্রধান সমস্যা- একথা আমি বলছিনা। কিন্তু আন্দোলন গড়ে তোলার দিক থেকে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কারণ একটি সঠিক আন্দোলন তো বটেই, এমনকী যে কোন একটা কার্যকরী আন্দোলন দৃঢ়চিত্ততা নিয়ে, একটা মনোবল নিয়ে, সাহসের সাথে একটা পরিকল্পনা নিয়ে, আত্মত্যাগ করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যদি গড়ে তুলতে হয়, তাহলে দেশের মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও সংস্কৃতিগত মানের প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নৈতিক মান ধ্বসে গেলে ‘মানুষ মার খেয়েই উঠবে, দাঁড়াবে’- এটা একটা কথার কথায় পর্যবসিত হয়। এ কখনও ঘটেনা। ‘সংকট দেখা দিলেই আন্দোলন দানা বাঁধবে’- আমাদের দেশে এরকম সব তত্ত্বও প্রচলিত আছে। আপনারা মনে রাখবেন, তা হয়না। না খেয়ে মরবার মতো অবস্থায় পড়ে বা চরম অভাবের মধ্যে পড়ে মানুষ দুটো পথই গ্রহণ করতে পারে। যদি নৈতিকতার একটা মান থাকে তবে সে যেমন আন্দোলনের রাস্তায় পা বাড়াতে পারে, আবার সেই নৈতিকতার মান না থাকলে সে ভিক্ষুক হতে পারে, ভ্রষ্টাচারী হতে পারে, নীতিহীন হতে পারে, ওয়াগন ব্রেকার হতে পারে- কিন্তু আন্দোলনকারী হতে পারেনা। খেতে না পেলেই, অভাব থাকলেই, মার খেলেই মানুষ লড়াকু হয়- একথা সত্য নয়।…. মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এসব জিনিস মানেনা। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের তত্ত্বেও মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের কোনো আস্থা থাকতে পারেনা। তাই, আমি এই কথাটার ওপর জোর দিতে চাই যে, আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে দৃষ্টি রেখে যদি সমস্ত সমস্যাগুলোকে বিচার করা যায়, তাহলে নৈতিক অধঃপতনের প্রশ্নটি, সংস্কৃতিগত নি¤œমানের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদের নৈতিক মেরুদ-কেই ভেতর থেকে খেয়ে নিচ্ছে এবং তা রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শেরও যা প্রাণসত্তা তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, পেছন থেকে তার সর্বনাশ করে চলেছে।”

আমি কমরেড শিবদাস ঘোষের যে উক্তিটি এখানে তুলে ধরলাম, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এই কথাটিকে বিচার করলে তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা ও কার্যকারিতা আপনাদের সামনে মূর্ত হবে। আমাদের দেশেও নীতি-নৈতিকতার এই সংকট দেশের গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। মানুষকে শুধু তার অভাব-দারিদ্র্য দেখিয়ে ক্ষেপিয়ে তুললেই আন্দোলন হয়না, জনগণের মধ্য থেকে উচ্চ নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিবেকবোধসম্পন্ন দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের উপযুক্ত সৈনিক বের করতে হয়। সেটি করে গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বিপ্লবী পার্টি। সেজন্য সেই পার্টিকে ছাত্রদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে, শ্রমিকদের মধ্যে যাওয়ার জন্য তার গণসংগঠনগুলোকে চরিত্রসম্পন্ন, মূল্যবোধসম্পন্ন, উচ্চ বিবেকবান কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হয়। এ না করে শুধু এই চাই, ওই চাই বলে বলে কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে কিছুদিন পরপর রাস্তায় নামলেই আন্দোলন গড়ে ওঠেনা, ওঠলেও টেকেনা। আপনাদের ছাত্রআন্দোলনও তেমনি। আপনাদের তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে, অনেকবার দেখেছেন। যে ছেলে দুটো নম্বরের জন্য মাস্টারের বাড়িতে প্রতিদিন ধর্ণা দেয়, যে ছেলে একটা চাকরির জন্য নিজের মর্যাদা বিকিয়ে দিতে পারে, যে ছেলে চোখের সামনে মেয়েদের বেইজ্জতি দেখলেও শব্দ পর্যন্ত করেনা, দেশের লোকের চরম সংকটের সময়ও যে নিজের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার কথা ভেবে স্থির থাকতে পারে- এই ছাত্রদের দিয়ে আপনারা দেশে কোনো গণআন্দোলন ভাবতে পারেন না। তার নীতি-নৈতিকতা-রুচি-মূল্যবোধ একই রকম রেখে শুধু তার ফি বাড়লো কেন এ নিয়ে তার যে বিক্ষোভ সেটা কাজে লাগিয়ে কিছুদিন তাকে হয়তো সঙ্গে রাখা যাবে- কিন্তু এই চরিত্র দিয়ে আন্দোলন হবেনা। গণআন্দোলনও হবেনা, ছাত্রআন্দোলনও হবেনা। এই কারণেই চরিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়ায় বড় আদর্শসমূহ যখনই সমাজে এসেছে, মানুষের মধ্যে ক্রিয়া করেছে- সকল আদর্শকেই তার পরিপূরক চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে। মানুষ প্রথমে চরিত্রকে বুঝেছে, তারপর আদর্শের প্রতি আস্থাবান হয়েছে। আপনাদের কিছুই যদি না থাকে, একেবারে সর্বস্বান্ত অবস্থায় এই চরিত্রকে সম্বল করে যদি আপনারা মানুষের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ান, আমি বলছি, আমাকে বিশ্বাস করুন, আপনারা সবই গড়ে তুলতে পারবেন। মিটিংয়ে ক’জন হলো তা নিয়ে ভাববেন না, ক’জন সত্যিকারের বিপ্লবী চরিত্র গড়ে তুলতে পারলেন তার উপরই নির্ভর করবে আগামী দিনে দেশে ছাত্রআন্দোলন এগোবে কিনা।

আপনারা মনে রাখবেন, গোটা দেশ আজ আপনাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা ব্যতিরেকে আজকের দিনে সমাজপ্রগতির সংগ্রাম এগুতে পারেনা। এদেশে এই মহান আদর্শের একমাত্র বাহক আপনারা। আপনাদের অনেক দায়িত্ব। এদেশের লোক ভীরু- একথা কেউ বলতে পারবেনা। তারা বারবার রাস্তায় নেমেছে, প্রাণও দিয়েছে। শুধু তাদের রুটি-রুজির দাবিতে প্রাণ দেয়নি। ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দিনাজপুরে ৭ জন যুবক প্রাণ দিয়েছিলো। এভাবে বোনদের বেইজ্জতি দেখে ভাইদের উন্মত্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দেবার ইতিহাস এদেশে আছে। আপনারা যদি আদর্শের শক্তিতে এই লড়াকু জনতাকে জাগিয়ে তুলতে পারেন, তবে কোনো বিরুদ্ধ শক্তিই একে দমাতে পারবেনা। মানব ইতিহাস বারবার এ প্রমাণ রেখে গেছে।

আমরা বামপন্থী শক্তিসমূহের কাছে বারবার আবেদন করছি, আবার করব, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের জ্বলন্ত সমস্যাসমূহকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তুলি। তবে যেকোন ঐক্য জনগণের জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে হতে হবে, তার স্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের দলকে আপনারা সামনের কাতারেই পাবেন।

বন্ধুগণ, আকাশের অবস্থা ভালো নয়। যেকোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। ভারতের খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় আমাদের আমন্ত্রণে এসেছেন। তিনি মানুষের দুঃখ-ব্যথা-সম্ভাবনা গানের মাধ্যমে চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। সেটা তিনি যাতে ঠিকভাবে করতে পারেন তা আমি চাই। তাই আমি আমার বক্তব্য আর দীর্ঘ করছিনা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলায় যখন আমি যাব কিংবা কমরেডরা যখন কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত স্কুলসমূহে আসবেন তখন আমি এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারব। আজ আমার বক্তব্য আমি এখানেই শেষ করছি।

(প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীতে তাঁর সম্পাদনা ও সংযোজনসহ বক্তব্যটি প্রকাশ করা হলো।)

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments