‘বাবার মুখে মেয়ের ধর্ষণের কাহিনী বড় কষ্টের, বড় নির্মম’ – গত ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা পৌর শহীদ মিনার চত্বরে জেলা নারীমুক্তি কেন্দ্র আয়োজিত নারী নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনে এই বেদনার কথাই তুলে ধরলেন একুশে টিভির স্থানীয় প্রতিনিধি আফরোজা লুনা। তার আগেই হৃদয়হীন সমাজের এক বর্বরতার ইতিহাস বিবৃত করেছেন ধর্ষিতা রাবুর বাবা। মেয়েকে নিয়ে থানায় ধর্ণা দিয়েছেন দুবৃত্ত-ধর্ষকের বিচারের দাবিতে। অপরাধীর শাস্তি মেলেনি। মিলবে কি করে? যাদের উপর দায়িত্ব বর্তেছে মানুষকে রক্ষা করার, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তারাই আজ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে।
কিশোরী সীমার জীবনের ইতিহাসও সেই বর্বরতার করুণ সাক্ষ্য। রাতের অন্ধকারে অসহায় মেয়ে আশ্রয় চেয়েছিল গোবিন্দগঞ্জ থানায়। থানা হেফাজতেই ধর্ষণের শিকার হয় সে। এই পাশবিক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে সমস্ত বিবেকবান মানুষ। সীমাই তো শুধু নয় – রিক্তা, রোকসানা, ময়না, রাবুদের নামের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই দেখে দেখে মা-বাবাদের আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় সময় কাটে – মেয়েটি স্কুলে গিয়েছে, ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে পারবে তো? নাকি পথে বখাটেদের হাতে রিক্তার মতো পরিণতি হবে? এই দুর্বিষহ অবস্থার কি প্রতিকার নেই? আইন আছে, আইনের শাসন সমাজে নেই। অপরাধীরা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ঘুরছে। যেটুকু সাজা হয় বিভিন্ন সময় তাও লঘু। আবার, নারী নির্যাতনের প্রতিকার নিপীড়কের শাস্তি দিলেই কি শেষ হয়ে যাবে? না। দিনে দিনে সমাজে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে। এর কারণ কি? মূল কারণ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ব্যক্তিগত মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত এই সমাজে নারীও পুরুষের সম্পত্তি বিশেষ। সম্পদ মানুষ যেমন ভোগ করে, নারীকেও দেখে সে ভোগেরই দৃষ্টিতে। টিভিতে নারীদেহকে কেন্দ্র করে অশ্লীল বিজ্ঞাপন, পর্ণোগ্রাফির বিস্তার, মদ-জুয়ার আসরের প্রসার ঘটছে সরকারের ছত্রছায়ায়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাজনীতি আর ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে এভাবে যুবসমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয়া হচ্ছে। এই কারণে সমাজে নারী নির্যাতন বাড়ছে। তাই নির্যাতন বন্ধ করতে অশ্লীল নাচ, মদ জুয়ার আসর বন্ধ করা দরকার। অথচ সবই সরকারের নাকের ডগায় ঘটলেও কেউ দেখছে না।
চোখের সামনে সন্তানের মতো ছেলেরা বিপথগামী হচ্ছে – এই কষ্টকে প্রতিবাদের ভাষা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন শুভাসিনী দেবী। নারীমুক্তি কেন্দ্র গাইবান্ধা জেলা শাখার সহ-সভাপতি শুভাসিনী দেবী প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিলেন। দুবৃত্তরা হামলা করে সভা পণ্ড করে দেয়। এতে শুভাসিনী দেবী সহ কয়েকজন আহত হয়। একই ভাবে রিক্তা ও ময়নার ধর্ষণের প্রতিবাদেও নারীমুক্তি কেন্দ্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নারী নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনের আয়োজন করে। ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগীতায় অস্থির দেশের রাজনীতি। সারাদেশে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি। ফলে কোনো যানবাহন চলেনি। ককটেল-বোমা এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগে মানুষ মরছে প্রতিদিন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা। এতসব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ জমায়েত হয়েছিল জেলা শহরের পৌর শহীদ মিনার চত্ত্বরে। অবরোধের কারণে জমায়েত হতে দেরী হয়। ফলে দুপুর ১২টায় তিন শতাধিক নারী ব্যানার, ফেস্টুন এবং লাল পতাকা হাতে গোটা শহরে মিছিল করে।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের লেংগা বাজার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এখান থেকে নারী মুক্তি কেন্দ্রের জেলা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য পদে। গত কয়েক দিন ধরেই এখানে রাতের বেলায় চলছিল মদ, জুয়া এবং অশ্লীল নৃত্যের আসর। বিক্ষুব্ধ হয় এলাকার জনগণ। সেখান থেকে কনভেনশনে এসেছিল শুভাসিনীর নেতৃত্বে ২৯ জন নারী সহ মোট ৩৫ জন। অর্ধেক রাস্তা রিক্সায় এবং বাকী অর্ধেক রাস্তা পায়ে হেটে মিছিল করতে করতে। শহর তলীর খোলাহাটী ইউনিয়নের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী রিক্তাকে গণধর্ষণ করে হত্যা করে নরপশুরা। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে ব্যানার সহ মিছিল করতে করতে রিক্তার মার নেতৃত্বে ২৫ জন নারী কনভেনশনে অংশ নেয়। কোন ভীতি এবং অবরোধ কর্মসূচীর প্রতিকূলতা এদের আটকাতে পারেনি। ফুলছড়ি উপজেলার মদনের পাড়ার প্রতিবন্ধী শিশু ময়না ধর্ষণের শিকার হয় এক নরপশুর দ্বারা। শিশুটির বাবা-মা একদমই হত দরিদ্র। অপর দিকে ধর্ষক প্রভাবশালী। ভয়ে মুখ খুলতে পারছিল না নির্যাতিতার পরিবার। ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসীরা দুই দুইবার রাস্তা অবরোধ করে। বিচার হয় নি। এই বর্বরতার বিচার চেয়ে এ অঞ্চল থেকে ১৬ জন নারী সহ মোট ২২ জন ব্যানার হাতে উপস্থিত হয় কনভেনশনে।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিমি দূরে সাদুল্যাপুর উপজেলার একটি অঞ্চলে নির্যাতিত কলেজ ছাত্রী রাবুদের বাড়ি। কোন যানবাহন না থাকায় আসার প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও খানিকটা পথ রিক্সা, ভ্যানে বাকিটা পায়ে হেটে রাবুর বাবাসহ ৬ জন এসেছিলেন। ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেষে গিদারী ইউনিয়ন। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাসদ জেলা কমিটির সদস্য প্রভাষক গোলাম ছাদেক লেবু। যোগাযোগ খুব ব্যয়বহুল, তারপরেও এ অঞ্চলের নারী কমরেডরা কনভেনশনে আসার প্রস্তুতি হিসেবে গত এক মাস ধরে বাড়িতে মুষ্ঠির চাল রেখেছে। সেই চাল বিক্রি করে ৩৮ জন নারী সহ ৪২ জন অংশ নিয়েছিলেন। সদর উপজেলার মালিবাড়ী থেকে ৪১ জন, ঘাগোয়া থেকে ১২ জন, দারিয়াপুর থেকে ৫০ জন, রামচন্দ্রপুর থেকে ১৫ জন,পুলবন্দি থেকে ৬ জন নারী অংশ নিয়েছিলেন কনভেনশনে। অবরোধের কারণে সবাইকে শহরের প্রবেশ মুখে রিক্সা-ভ্যান থেকে নেমে ৩ কিমি রাস্তা পায়ে হেটে আসতে হয়েছে।
মায়েরা এসেছেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তাদের সন্তানদের। অনেকেই কোলের শিশু সন্তানকেও নিয়ে চলে এসেছেন বিবেকের টানে। সাতমাস বয়সী সন্তানকে অন্যের হেফাজতে রেখে চলে এসেছেন গৃহীণী পারুল। কেন এসেছেন শোনাচ্ছিলেন সেই কাহিনী Ñ “আমার উপরও তো যে কোনো সময় আক্রমণ নেমে আসতে পারে। আজকে আমি না আসলে আরেকদিন আমার পাশে কে দাড়াঁবে?”
অধ্যাপক রোকেয়া খাতুনের সভাপতিত্বে কনভেনশনে প্রধান বক্তা ছিলেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। আরো বক্তব্য রাখেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ওবায়দুল্লা মুসা, জেলা আহ্বায়ক আহসানুল হাবীব সাঈদ, নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী, শুভাসিনী দেবী, হালিমা খাতুন, গাইবান্ধা জেলা নাগরিক পরিষদের আহ্বাযক সিরাজুল ইসলাম বাবু, একুশে টিভি’র জেলা প্রতিনিধি আফরোজা লুনা, নির্যাতিত কলেজ ছাত্রী ইসরাত জাহান রাবুর পিতা আব্দুর রউফ এবং নির্যাতনে মৃত্যুবরণকারী রিক্তার পিতা জহুরুল ইসলাম ।
কনভেনশন থেকে নারী নির্যাতন রোধে সঠিক আদর্শের ভিত্তিতে সর্বব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সর্বস্তরের গণতন্ত্রমনা মানুষকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।