পৃথিবীর সর্বাধিক ভাষায় অনূদিত, সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রিত উপন্যাসের নাম ‘মা’। পৃথিবীব্যাপী প্রভাব বিস্তারকারী এই উপন্যাস কোটি কোটি মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যে পটভূমিতে ‘মা’ উপন্যাসটি রচিত হয় সেই পরিস্থিতির ঘূর্ণাবর্তে গোর্কি নিজেও ছিলেন। ১৯০৬ সালে জার সরকারের গ্রেফতারি পরওয়ানার কারণে তিনি প্রথমে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যাণ্ডে যান। পরে সুইজারল্যাণ্ড হয়ে আমেরিকায়। সেখানেই রচিত হয় অবিস্মরণিয় ‘মা’ উপন্যাসটি। দুনিয়া কাঁপানো নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বেকার উত্তাল রাশিয়ার জনজীবন হচ্ছে এই উপন্যাসের পটভূমি। জার শাসিত রাশিয়ায় সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার ছিল না। ১৮৬১ সালে ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি কৃষককে জমিদারের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, তারা রয়ে গেল জমিদারের আজ্ঞাবহ। বেগার খাটতে হতো, জমিদার ইচ্ছেমত খাজনা নিত। ফলে কাজের সন্ধানে অধিকাংশ শহরে চলে এসে দুঃসহ বেকারত্ব বা স্বল্পমজুরি কাজের মধ্যে পড়ে। এ নিয়ে মানুষে মানুষে চলে হানাহানি। এই সময়ে জাপানের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ ও যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ঘটে ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়। শহরগুলোতে চলে ব্যাপক ধর্মঘট। এক পর্যায়ে ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি দেড় লক্ষ শ্রমিকের এক বিশাল সমাবেশ শীত প্রাসাদ অভিমূখে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা নিয়ে এগোলে জারের প্রাসাদ থেকে সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ হয়। নিহত হয় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক। এই দিন রাশিয়ার ইতিহাসে ‘রক্তাক্ত রোববার’ হিসেবে পরিচিত। শহরে শ্রমিকরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে তিনদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই করে। একই সাথে দেশজুড়ে ধর্মঘটের বন্যা বয়ে চলে। এই উত্তাল জনবিদ্রোহ গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। জমিদারের প্রাসাদ পুড়িয়ে দেয়া, শস্য লুট করে ক্ষুধার্ত র্কষকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া, জমি দখল ইত্যাদি চলতে থাকে। জুন মাসে কৃষ্ণ সাগরে অবস্থানরত নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘পটেমকিন’-এর নাবিকরা বিদ্রোহ করে।
শেষপর্যন্ত নেতৃত্বের অভাব, সমন্বয়হীনতা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী স্তপিলিন প্রচণ্ড দমননীতি গ্রহণ করে এ সর্বাত্মক বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্রোহীদের ফাঁসি দেয়, কারারুব্ধ করে। এ পটভূমিতে ১৯০৬ সালে লেখা হয় ‘মা’ উপন্যাস।
‘মা’ উপন্যাসে আমরা দেখি একটা সাধারণ শ্রমিক পরিবারের সর্বক্ষণ স্বামী কর্তৃক নির্যাতিতা রাত্রিদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে ও ‘ভয় দিয়ে গড়া’ একজন নিতান্ত ক্লান্ত শ্রান্ত নারী। অথচ ছেলে পাভেলের বিপ্লবী পরিবর্তনে সাথী হতে গিয়ে নিজেও আমূল বদলে গিয়েছেন। এ রুপান্তর কোনো একক মায়ের নয়, গোটা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের অনিবার্য পরিবর্তনের প্রেরণাদায়ী চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। বিপ্লবী গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে পাভেল যেভাবে চিন্তাশীল দায়িত্বশীল, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও উদ্দেশ্যমূখীন হয়ে উঠে, মাও অনেক তর্ক-আলোচনা, গ্রহণ-বর্জনের পথে বিপ্লবী মা হয়ে উঠেন। মা খেয়াল করেন, ‘ছেলের মুখখানা দিনে দিনে ধারালো হয়ে উঠছে, চোখ দুটির গাম্ভীর্য বাড়ছে, আর ঠোট দুটি যেন একটি কঠিন রেখায় অশ্চর্য সংবদ্ধ’। ফলে মা হয়ে উঠেন তার সহযোগী। একই সাথে মা যখন ভাবেন, দিনের পর দিন অনবরত স্বামীর মার খেয়েছে। তবু এসব কথা বলতে গিয়ে মনে কোনো রাগ-দুঃখ নেই মায়ের। শুধু ঠোটের কোনে অনুতাপের হাসি। কোনো কিছু ব্যক্তিগত অপমানে না নিয়ে সমস্যাগুলো সামাজিক ও নৈব্যক্তিকভাবে নেয়ার শিক্ষা তুলে ধরে। আলাপ-আলোচনা আর কাজ করতে করতে মা জীবনের সত্য, সমাজের সত্য বুঝতে পারে। সে দেখতে পায়, মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা, লাভের জন্য সর্বস্ব শুষে নেয়া। মা দেখে, দুনিয়ার অজস্র ধন-সম্পদ, তবু মানুষ সর্বত্র অভাব-অনটনে দিন কাটায়। শহরে গীর্জাগুলো সোনা-রুপায় ভর্তি অথচ ভগবানের এসব কোনো দরকার নেই। দরকার গীর্জার সম্মুখে হাত পেতে দাঁড়ানো ঐ অসহায় ভিখিরির দলের। তখন তার রীবিনের কথা মনে পড়ে–‘দেবতার নামে ও ব্যাটারা আমাদের ঠকিয়েছে’।
আবার নিকোলাই মায়ের সামনে সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আরেকটা সত্য উম্মোচিত করে, ‘জুলুম করার এ লোভ ওদের ব্যাধি। সমস্ত মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দিচ্ছে। এ পশুসুলভ সমাজব্যবস্থায় বাধ্য হয়ে আপনা থেকে মানুষকে জানোয়ার হতে হয়।
বিপ্লবীদের জীবনে জ্ঞানচর্চা এত গুরুত্ববহ কেন? বই পড়ায় মশগুল দেখে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে পাভেল বলছে, সত্য জানতে চাই বলে পড়ি। প্রথমে নিজে জানবো, তারপর অন্যদের জানাবো। শত বছর ধরে শ্রমিকদের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখতে চেয়েছে,আজও অন্য সব দেশের মত আমাদের দেশেও শাসকগোষ্ঠী শ্রমিক-কৃষক-গরীব জনসাধারণকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে চায়। কারণ এটাই শাসকগোষ্ঠীর শক্তি। তাই উপন্যাসের আরেকটা চরিত্র বলে, “আমাদের সবকিছু জানা দরকার। আমাদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালালে তবেই তো যারা আঁধারে আছে তারা আমাদের দেখবে।”
পাভেল বলছে, ‘শুধু একপেট খেতে পাওয়াটাই আমাদের সব নয়। যারা আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে, আমাদের চোখে ঠুলি এটে রেখেছে, এদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। … জ্ঞানের মাপকাঠিতে তাদের সমান হতে বাধা নেই, এমনকি তাদের থেকে বড় হতেও …।’
শ্রমিকদের মধ্যে আত্মমর্যাবোধ জাগিয়ে তোলো, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে গোর্কীর এ বক্তব্য এখনও প্রাসঙ্গিক। অথচ আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে শ্রমিকদের পুরোনো ‘এক পেট খেতে পারা’ জীবনে আটকে রাখে।
রাজনীতি সচেতন, ইতিহাস সচেতন আর বিপ্লবী ধারার কর্মকাণ্ডের দিকে গোর্কী তাঁর অবস্থান নির্দেশ করে গেছেন।
সমাজতন্ত্র এমন এক আদর্শবোধ যা শ্রমিক শ্রেণিকে আন্তর্জাতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পাভেলের বন্ধু খখল যখন মা কে বলে, ‘আমরা সবাই এক মায়েন ছেলে। সেই মা হলো এক দুর্নবার ভাবনা, সারা দুনিয়ার শ্রমিক ভাই ভাই। এই আমাদের অক্ষয় মন্ত্র। এই মন্ত্র আমাদের বুকের বল, প্রাণের আগুন।। ন্যায়ের আকাশে এই সূর্যই জ¦লছে ঝলমল করে। … সমাজতন্ত্রী হলে সে নিজেকে যাই বলুক না কেন সে আমাদের ভাই। এক ভাবনায় বাধা সত্যিকারের ভাই। কালকের, আজকের, চিরকালের ভাই। এই বক্তব্য শুধু মায়ের দৃষ্টিসীমা প্রসারিত করে তোলে না, পাঠক মনেও আন্তর্জাতিকতাবোধের এক নতুন জগৎ নির্মাণ করে।
বিপ্লবীদের জীবনেও নর-নারীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণ তৈরী হয়। কিন্তু একজন বিপ্লবী একে কিভাবে নেবে? পাভেলের কথায় আছে এর উত্তর। পাভেল খখল-এর কাতরভাব লক্ষ করে বলে, ‘প্রেম ভালোবাসা জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়া চাই। ভালোবাসা পায়ে শিকল বেধে পিছন দিকে টানবে অমন ভালোবাসা আমি চাই না।” নিজেকে বিশ্লেষণ করে মা বুঝতে পারেন জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসাই একমাত্র খাঁটি ভালোবাসা। মা বোঝেন, ‘আমরা শুধু ভালোবাসি নিজেদের যতটুকু দরকার, তার উপরে যেতে পারিনে। … যে সব ছেলে জেলে পচছে, সাইবেরিয়ায় যাচ্ছে, কেন? না, দুনিয়ার মানুষের জন্য … জান দিচ্ছে সব। কচিকচি মেয়েগুলো হিমের রাত্রিরে জল-কাদা-বরফ ভেঙোগ ক্রোশের পর ক্রোশ একলা হেটে শহর থেকে এখানে আসছে, কেন? কেন এত কষ্ট সয় ওরা? কে এসব করায় ওদের? না ওদের বুকের ভেতর আছে খাঁটি ভালোবাসা।’
অনেকে বিপ্লবী জীবনে অর্থসংস্থানের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত থাকে। অথচ সেই সময় ‘মা’ উপন্যাসের আরেক চরিত্র খখল বলছে, ‘কিভাবে চলছি জানেন? চলছি অন্য লোকের টাকায়। নিকোলাই পচাত্তর রুবল পায় মাসে। তা থেকে পঞ্চাশ রুবল দেয়। অন্যরা তাই করে। কত সময় ছাত্ররা আধ পেটা খেয়েও এক এক কোপেক জমিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেয়। তা ভদ্দরলোক নানা রকম আছে। কেউ তোমাদের দিকে ফিরে চাইবে না, কেউ ঠকাবে, কিন্তু যারা সেরা তারা আমাদের দলে ভীড়ে যাবে।’
পারিবারিক জীবন বিপ্লবীদের উদ্যোগকে ক্ষুণ্ণ করে। অভাব অনটন ছেলে পুলে নিয়ে তারা কী খাবে সেই চিন্তা তাদের খেয়ে ফেলে। সমস্ত কর্মশক্তি এতে বরবাদ হয়ে যায়। অথচ বিপ্লবীদের শক্তি বাড়ানো দরকার। আরো গভীর আরো বিস্তৃতভাবে। এটা যুগেরই দাবী। সবার চেয়ে আগে আগে আমাদের চলতে হবে, কারণ আমরা শ্রমিক পুরানো পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে নতুন পৃথিবী পত্তন করার কাজে ইতিহাসের ডাক আমাদের কাছে। … আদর্শের হানি না ঘটিয়ে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারি এমন সঙ্গিনী তো নেই।’ আবার পারিবারিক আবেগ সম্পর্কে একজন বিপ্লবীর সংগ্রামের যথার্থ রূপ সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই যখন খখল পাভেল সম্পর্কে বলে,‘ জেনে শুনেই সে গেছে। অন্ধকারে ঝাপ দেবার ছেলে সে নয়। … ও মানুষই আলাদা। জেনে শুনেই গেছে, সে হয় বেয়নেটে খেঁাচা দেবে। নয় ঠেলে দেবে সাইবেরিয়ায়। তবু এগিয়ে গেল। ওর মা পথ আগলে শুয়ে থাকলেও ডিঙ্গিয়ে চলে যেত ও।’
সাশা যখন সিজভকে বলে, ‘আমার বাবার চাইতে আমার কাছে ন্যায় বড়।’ তখন একই সুর বেজে উঠে। বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত থেকে এ ধরণের উচ্চ ন্যায়নীতি অর্জন করা যায়।
‘মা’ উপন্যাস পাঠকমনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে একটা স্বপ্ন বুনে দিয়ে যায়, ভবিষ্যতের সে স্বপ্নের কথা বলে এ লেখার ইতি টানছি।
‘আমি জানি, সময় আসবে যখন প্রতিটি মানুষ আর সকলের কাছে তারার মত হয়ে উঠবে। তাদের রূপে তারা নিজেরা মুগ্ধ হবে। পৃথিবীর বুকে থাকবে শুধু মুক্ত মানুষ। মুক্তি তাদের মহিমা দিয়েছে। প্রত্যেকটি হৃদয় খুলে যাবে। কারো মনে হিংসা-দ্বেষ থাকবে না। জীবন রূপ পাবে মানুষের সেবায়। মানুষের মূর্তি পাবে স্বর্গের দেউল। কিছুই মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়। মানুষ সেদিন সুন্দর হবে। সত্য আর সুন্দরের মুক্তিতে পাবে সে তার বীজমন্ত্র। আর সে মানুষ সারা পৃথিবীকে কোল দিতে পারবে। তাকে সবচেয়ে ভালোবাসবে, সর্ববন্ধন মুক্ত সে মানুষ হবে নরোত্তম, কারণ সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য সে মুক্তিতে। এ নবজীবনের মানুষই রচনা করবে মহাজাতি।’