জনমত উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় সব খাতে গ্যাসের দাম একধাক্কায় ২২.৭% বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আবাসিক খাতে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ৫০%-এর বেশি। এক বার্নার চুলার খরচ বর্তমানের ৬০০ টাকা থেকে ১ মার্চ ৭৫০ টাকা এবং ১ জুন থেকে ৯০০ টাকা হবে। দুই বার্নার চুলার খরচ বর্তমানের ৬৫০ টাকা থেকে পহেলা মার্চ ৮০০ ও পহেলা জুন ৯৫০ টাকা কার্যকর হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে, বাড়ি ভাড়া-গাড়ি ভাড়া, কৃষিকাজে ও শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়বে। যারা গ্যাস ব্যবহার করেন না, তাদেরও এর ফল ভোগ করতে হবে। মাত্র দেড় বছর আগে, সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে গ্যাসের দাম ২৬.২৯% বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবারের মূল্যবৃদ্ধিই শেষ নয়। ইতিমধ্যে ঘোষণা এসেছে, আগামীতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানো হবে। জনপ্রতিনিধিত্বহীন এই সরকার জনগণের দুর্দশার প্রতি বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না — এই স্বৈরতান্ত্রিক ঘোষণা তার প্রমাণ। এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনে আরো বেশি মূল্যবৃদ্ধির ফাঁস আমাদের গলায় চেপে বসবে।
এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক
- এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিটি সংস্থা লাভজনক অবস্থায় আছে। পেট্রোবাংলার অধিভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে সরকার প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা কর-লভ্যাংশ-রয়্যালটি বাবদ পেয়েছে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। এরপরও পেট্রোবাংলার নীট মুনাফা ১২৬৯ কোটি টাকার বেশি।
- সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, ৫ বছরে সরকার গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে ২৬ হাজার কোটি টাকা, এর মাঝে মুনাফার পরিমাণ ৩২০০ কোটি টাকা। এছাড়া, পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা আছে আরও ৩২৭২ কোটি টাকা।
- গ্যাসের দামের ৮১% অর্থই যায় সরকারের কোষাগারে, যার মধ্যে আছে সম্পূরক শুল্ক ৪০%-ভ্যাট ১৫%-অগ্রিম আয়কর-সম্পদ মূল্য-লভ্যাংশ-গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ইত্যাদি। এ বিপুল পরিমাণ কর-শুল্ক কিছুটা কমালেই স্বল্পমূল্যে গ্যাস দেয়া সম্ভব। বিদেশী কোম্পানি তথা আইওসির গ্যাস এতদিন ছিল শুল্ক-ভ্যাট মুক্ত। অথচ সে গ্যাস শুল্ক-ভ্যাটযুক্ত গণ্য করে পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
- বলা হচ্ছে, ‘কোন দেশে গ্যাস এত সস্তা নয়’। গ্যাস আমাদের নিজেদের সম্পদ। উৎপাদক দেশ বলে এখানে দাম কম থাকাই যুক্তিযুক্ত। যেমন — মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম। দাম বাড়ানোর বেলায় উন্নত দেশের উদাহরণ টানা হয়, কিন্তু সেখানকার মানুষের আয়ের সাথে তুলনা করা হয় না।
- যারা সিলিন্ডার বা লাকড়ি ব্যবহার করে, তাদের জ্বালানি বাবদ মাসিক খরচ ২৫০০-৩০০০ টাকা। এই বৈষম্য কমাতে পাইপলাইনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বলে কুযুক্তি করা হচ্ছে। অথচ, কোথাও দাম বেশি, তার সাপেক্ষে মূল্যবৃদ্ধি কি সঙ্গত? প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি, এটাকে দেখিয়ে কেউ সরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ বাড়ানোর অজুহাত তুললে জনগণ তা মেনে নেবে না। এলপিজির আমদানি ব্যয় যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী এলপিজি সিলিন্ডার ৪৫০ টাকায় দেয়া সম্ভব। অথচ তা না করে গৃহস্থালি গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এলপিজি ব্যবসায়ীদের অবাধ মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।
- দাম বাড়ানোর জন্য গ্যাস অপচয় রোধের অজুহাত দেয়া হচ্ছে, অথচ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি-অপচয় চলছে। বাসাবাড়িতে গ্যাসের অপচয় বন্ধের জন্য মিটার না বসিয়ে অপচয়ের দায় সবার ঘাড়ে তুলে দেয়া কেন? প্রতিদিন উৎপাদিত গ্যাসের মধ্যে মাত্র ১৩% বাসা-বাড়িতে ব্যবহার হয়। অথচ শিল্পকারখানা, সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোতে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয়। দুদকের অনুসন্ধানে পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে আইওসির গ্যাস ক্রয়, কম্প্রেসর স্থাপন, যন্ত্রপাতি আমদানি ও পরিচালনাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। ত্রুটিপূর্ণ মিটার ও মিটার টেম্পারিং, গ্যাস অপচয় এবং অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
- আমদানিকৃত এলএনজির বাজার সৃষ্টির জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা দরকার, এই বক্তব্যও আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমদানির আগেই এই সমন্বয়ের উদ্যোগকে বলা যেতে পারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের আগাম পকেট কেটে নেয়া।
কেন বারবার দাম বাড়ানো হয়
সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-পেট্রোবাংলার পরিবর্তে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে এবং তাদের কাছ থেকে বহুগুণ বেশি দামে গ্যাস কিনছে। পেট্রোবাংলা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস বাপেক্স-এর কাছ থেকে কেনে ২৫ টাকায়, আর বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কেনে গড়ে ২৫০ টাকায়। এভাবে জনগণের অর্থ দিয়ে দেশি-বিদেশি লুটপাটকারীদের পকেট ভরা হচ্ছে। আর এই লুটপাটের ফলে সৃষ্ট ঘাটতি পোষাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে, দাম বেশি থাকলে সরকার ট্যাক্স বেশি পায়। তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বারবার খরচ বাড়িয়ে যে লুটপাট চলছে তার ঘাটতি পোষাতে এই টাকা ব্যবহার হবে। সরকার গৃহস্থালি ও গণপরিবহনে সস্তায় গ্যাস দিতে চায় না। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বেশি দামে সেই গ্যাস বিক্রি করে মুনাফা বাড়াতে চায়। এজন্য একদিকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এলপিজি সিলিন্ডারের সমান করা হচ্ছে, অন্যদিকে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দিয়ে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের গ্যাস এদেশের জনগণের সম্পদ। জনগণের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করার জন্যই তা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু, সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি-তেল-পানি-শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করতে চায়। পুঁজিপতিদের মুনাফা লোটার সুযোগ করে দিতেই তাই তারা দফায় দফায় এসব সেবার দাম বাড়ায়। দেশের শাসনক্ষমতায় যখন যে দলই এসেছে সকলেই জনগণের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে এভাবে ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছে। জনগণের অধিকার রক্ষা করতে তাই দেশের মধ্যবিত্ত-গরীব-মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনই একমাত্র পথ। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক বাম র্মোচা, সিপিবি-বাসদসহ বামপন্থী দলগুলোর ডাকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৫ মার্চ জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাও হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।