Friday, December 27, 2024
Homeফিচারগ্রিসের না ভোট — নয়া উদারনৈতিক বিকল্পের ব্যর্থতাকে প্রকট করল

গ্রিসের না ভোট — নয়া উদারনৈতিক বিকল্পের ব্যর্থতাকে প্রকট করল

greece

৫ জুলাই গণভোটে গ্রিসের জনগণের রায় ঐতিহাসিক। আরও ঋণ পেতে হলে গ্রিস-কে যেসব শর্ত মানতে হবে বলে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কর্তা জার্মানি-ফ্রান্স হুকুম দিয়েছিল, গ্রিসের জনগণ বিপুলভাবে জানিয়ে দিল — না, এই সব শর্ত আমরা মানব না। সন্দেহ নেই, শুধু ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কর্তাদের ক্ষেত্রেই নয়, তাবড় সাম্রাজ্যবাদীদের ক্ষেত্রেও, বিশেষত নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদী মডেলের প্রবক্তাদের কাছে এ এক বিরাট ধাক্কা, যাকে পরাজয়ও বলা যায়। পটভূমি দেখে নেওয়া দরকার। ২০১০ সাল থেকেই প্রবল ঋণ সংকটে ভুগছে ইউরো জোনের বিভিন্ন দেশ। এই ঋণ সংকটের মধ্যমণি এখন গ্রিস। ইউরো জোনের মধ্যে এই দেশের ঋণের পরিমাণ ও বাজেট ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। গত কয়েকবছর ধরে আই এম এফ, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং গ্রিসের সরকার এই ঋণের কবল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই সব পরিকল্পনা যত কার্যকর হয়েছে, দেখা গেছে গ্রিস সরকার তত আরও বেশি বেশি করে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে এবং বর্তমানে অবস্থা এমন জায়গায় দাড়াঁয়, ৩০ জুনের মধ্যে আই এম এফের পাওনা ১৬০ কোটি ইউরো পরিশোধ করতে না পারলে গ্রিস দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

কিন্তু গ্রিসের সরকারের ভাঁড়ারে কানাকড়িও নেই। তা হলে উপায় কী? সামনে উপায় দুটো। প্রথমটা হল, গ্রিসের জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের উপর বাড়তি করের বোঝা না চাপানো, কৃচ্ছ্রসাধনের মোড়কে মজুরি, পেনশন সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাঁটাই না করা, দুই – সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ধারকবাহক আই এম এফ, ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ভয়ঙ্কর শর্ত মাথা পেতে মেনে নিয়ে গ্রিসের জনগণের উপর শোষণ-অত্যাচারের স্টিম রোলার চাপানো।

সংকট ঘনীভূত হওয়ার সাথে সাথেই গ্রিসের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। একদিনেই আমানতকারীরা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়েছে ১৫০ কোটি ইউরো। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহেই তুলে নিয়েছে ৫০০ কোটি ইউরো। সংকটের কালো ছায়া আজ গ্রিসের সমগ্র ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকেই গ্রাস করতে চলেছে।

ঋণ সংকটে পড়া এবং তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আবার বড় মাপের ঋণ করা বা দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ঘটনা বলেই এতদিন জানা ছিল। কিন্তু গ্রিসের ঘটনা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে — ঋণের এই ফাঁদ থেকে আজ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর রেহাই নেই। পুঁজিবাদের সর্বাত্মক সংকট আজ তাদের গ্রাস করছে। তাদের অর্থনীতিরও টালমাটাল অবস্থা। তারাও আজ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঋণ বাজারে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করছে। কিন্তু বাঁচার পথ তারা খুঁজে পাচ্ছে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া সম্ভবও নয়।

পুঁজিবাদী সংকট প্রসঙ্গে মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের একটা শিক্ষা আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা এবং তার ভিত্তিতে উৎপাদন এবং সেই অনুযায়ী বণ্টন — এ পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধরনই নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধরন হচ্ছে — বাজারের চাহিদা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, আমি বিক্রি করে কত লাভ করব, সোজা কথায় এই হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বুনিয়াদ। তাই বাজারের যদি স্থায়িত্ব না থাকে তা হলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি টলটলায়মান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত, হাজার সংকট সত্ত্বেও বহু মন্দা সত্ত্বেও, পুঁজিবাদী বাজার বরাবর একটা আপেক্ষিক স্থায়িত্ব রক্ষা করেছে। কিন্তু এবার বিশ্বযুদ্ধের পরে যে সংকট সে এবেলা ওবেলার সংকট। পূর্বেকার আপেক্ষিক স্থায়িত্বের নিয়ম পুঁজিবাদী বাজারে আজ আর নেই। সেটা শেষ হয়ে গেছে’ (রচনাবলী, খ–৪,পৃ:-৩৪)। পুঁজিবাদী বিশ্ব বাজারের যেকোনও সংকটকে বোঝার ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষাকে মনে রাখা দরকার। গ্রিসের সংকটও তার ব্যতিক্রম নয়।

আয়ের থেকে যখন ব্যয় বেশি হয় তখন মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়। এই ঋণ পরিশোধের জন্য সে সম্পত্তি বিক্রি করে, উচ্চ সুদে টাকা ধার করে, এইভাবে সে ক্রমাগত ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে থাকে — সর্বস্বান্ত হয়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের সাথে সরকারের পার্থক্য আছে। সরকার টাকা ছাপতে পারে, বাজারে ঋণপত্র ছাড়তে পারে। এই ঋণ আভ্যন্তরীণও হতে পারে, আবার বৈদেশিকও হতে পারে। কিন্তু সরকার যদি আয় ব্যয়ের পার্থক্য কমাতে না পারে, যদি এই পার্থক্য ক্রমাগত বাড়তেই থাকে তবে স্বাভাবিকভাবেই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে এবং সরকারকেও আরও বেশি বেশি ধার করতে হবে। এইভাবে সরকার ক্রমাগত ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য আরও বেশি ঋণদাতাদের দুয়ারে গিয়ে হাত পাততে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যে এই ঋণের ফাঁদ থেকে সরকার আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। কিন্তু সরকারের এই সর্বনাশ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর পক্ষে পৌষমাস। তারা সরকারের এই সংকটকে আরও মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবহার করবে, আরও নতুন নতুন শর্ত চাপাবে, আরও ঋণের ফাঁস সরকারের গলায় জোর করে পরিয়ে দেবে। একের সংকট অন্যের মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত হবে। গ্রিসের ক্ষেত্রেও এটাই দেখা যাচ্ছে।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত গ্রিসের ব্যবসা বাণিজ্যের শতকরা ৭৫ ভাগ ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। অন্যান্য ক্ষেত্রও কড়া সরকারি নজরদারির অধীনে ছিল। এই বছরই গ্রিস তাদের জাতীয় মুদ্রা হিসাবে ‘ইউরো’-কে গ্রহণ করে। সাথে সাথে বিশ্বায়নের নানা শর্তও তার অর্থনীতিকে গ্রাস করতে থাকে। অর্থনীতির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত আলগা হয়, বেসরকারিকরণের রাজত্ব শুরু হয়, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো এক এক করে চলে যেতে থাকে গ্রিসের বহুজাতিক পুঁজির হাতে। তাদের উপর আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক ক্রমাগত কমতে থাকে। গ্রিসের বহুজাতিক পুঁজিকে ঢালাও সুবিধা দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অন্যদিকে জনগণের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকে ট্যাক্সের বোঝা, বাড়ে বেকারি ও জিনিসপত্রের দাম। লক্ষণীয়ভাবে গ্রিসের সামরিক বাজেটও বাড়তে থাকে। এই বাজেটের বেশি অংশই ব্যয় হয় ফ্রান্স থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র কিনতে। ফলে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে ঘাটতি বাজেটের বোঝা। আর এই ঘাটতি মেটাতে গ্রিস সরকার দেদার হস্তে ঋণ গ্রহণ করতে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থার কাছ থেকে। দেখা যায় গ্রিসের জাতীয় উৎপাদন থেকেও তার ঋণের পরিমাণ বেশি। ২০০১ সালে গ্রিসের ঋণ ছিল জাতীয় উৎপাদনের ১০৬ শতাংশ, ২০০৯ সালে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৬ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে হয় জাতীয় উৎপাদনের ১৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যত দিন যাচ্ছে তত বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। যত বাজেট ঘাটতি বাড়ছে তত বেশি বেশি ঋণ করতে হচ্ছে। আবার সেই ঋণ শোধ করতে আরও বেশি ঋণ করতে হচ্ছে।

সংকটগ্রস্ত, ঋণগ্রস্ত গ্রিস অর্থনীতিকে উদ্ধার (বেল আউট) করার জন্য ইতিপূর্বে ঋণদানকারী সংস্থাগুলো গ্রিস সরকারকে ২৪০ কোটি ইউরো ধার দিয়েছিল। বিনিময়ে গ্রিস সরকারকে ওদের নির্দেশ মতো কৃচ্ছ সাধনের যে নয়া উদারনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল তার ফলে গ্রিসের যুবকদের ৬০ শতাংশ এখন বেকার, সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে আত্মহত্যার পরিমাণ হয়েছে দ্বিগুণ, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা হয়েছে অগুন্তি আর ৩৩ শতাংশ শিশু বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে গ্রিসই এখন গরিব দেশগুলোর অন্যতম।

কিন্তু ঋণদাতা সংগঠনগুলোর শর্তানুযায়ী কঠোর কৃচ্ছ সাধন করেও সংকট থেকে মুক্ত হতে পারল না গ্রিস। বরং সে গিয়ে পড়ল আরও বড় সংকটের গহ্বরে। তার অবস্থা এমন যে এখনই ৭২০ কোটি ইউরো দরকার। ঋণদাতা সংস্থাগুলো যে ঋণ দিতে অরাজি তাও নয়। তারা আগামী পাঁচ মাসে ১২০০ কোটি ইউরো দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। এর মধ্যে ১৮০ কোটি ইউরো তারা এখনই দিতে রাজি। কিন্তু এই অর্থ পেতে হলে গ্রিসকে কয়েকটা কড়া শর্ত মেনে চলতে হবে। এই শর্ত হল পেনশন কমানো, যুক্তমূল্য কর বাড়ানো, ব্যাপক বেতন কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব অর্থাৎ শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি হ্রাস। এসবের সাথে বড় হুমকি — শর্ত না মানলে ঋণ পাবে না, ঋণ শোধ দিতে না পারলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা যাবে না।

এই প্রস্তাব গ্রিসের বর্তমান সিপ্রাস সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। করের বোঝা কমানো, ছাঁটাই না করা, মূল্যবৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি জনকল্যাণকামী প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে সিপ্রাস সরকার। ইউরোপীয় জোনের ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কৃচ্ছ সাধনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে গ্রিসের জনগণের প্রবল বিক্ষোভ সিপ্রাস সরকারকেও প্রবল চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। সিপ্রাস সরকারের এখন উভয় সংকট। কঠিন শর্তে ঋণ না নিলে দেউলিয়া হতে হবে। আবার ঋণ নিলেও সংকট থেকে শেষ বিচারে রেহাই মিলবে না বরং বাড়তি পাওনা হবে জনগণের প্রবল ক্ষোভ ও অসন্তোষ। কৌশল করে সরকার তাই বল ঠেলে দেয় জনগণের কোর্র্টে। রায় দানের দায়িত্ব গ্রিসের জনগণের কাঁধে চাপিয়ে সিপ্রাস সরকার যে পরিত্রাণের পথ খুঁজলেন তাতে সরকার বাঁচতে পারে কিন্তু গ্রিসের অর্থনীতি বাঁচবে কি?

ইউরোপের ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা গ্রিসের এই সংকটের জন্য সেখানকার অর্থনীতির পরিচালকদের ঘাড়ে সমস্ত দায়ভার চাপাতে চাইছে। অর্থাৎ বিষয়টা যেন এমন পরিচালকেরা যোগ্য হলেই এই সংকটে পড়তে হতো না গ্রিসকে। যদি তর্কের খাতিরে ইউরো জোনের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যকে সঠিক বলে ধরেও নিই তা হলেও কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, ইটালি, স্পেন — এই সব দেশের অর্থনীতির পরিচালকেরা সবাই একসাথে অযোগ্য হয়ে পড়লেন! বোঝা যায়, অযোগ্যতার এই যুক্তি (!) ধোপে টেঁকে না। এ সমস্যার আসল কারণ থেকে জনগণের চোখকে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশলী পরিকল্পনা।

গ্রিসের ঋণ সংকট ও পরবর্তী ঘটনা দুটি বৈশিষ্ট্য দেখাল। প্রথমত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গঠনের সময় ‘এক ইউরোপ’কে অনেকটা ‘এক জাতি এক প্রাণ’-এর মতো করে প্রবক্তারা উপস্থিত করেছিল। এর দ্বারা ইউরোপীয় জনগণের জীবনে ‘প্রগতি ও উন্নতির’ জোয়ার বইবে এমন কথাও বলা হয়েছিল। আমরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মানদন্ডে দেখিয়েছিলাম, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বাস্তবে পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির একটি প্রতিক্রিয়াশীল জোট। এর সকল সদস্য রাষ্ট্রই সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে বলে ঐক্যের যে বেলুন ওড়ানো হয়, তাও ছিল মিথ্যের ফানুস। এধরনের পুঁজিবাদী জোটে সর্বদা সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরই কবজা বা কর্তৃত্ব কায়েম হয়, যার পুঁজির জোর বেশি। এক্ষেত্রে তাই জার্মান একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য কায়েম হয়েছে ই-ইউতে। এর সুযোগ নিয়ে জার্মানি তার ক্ষমতা ও আধিপত্য বাড়িয়েছে— গোটা পূর্ব ইউরোপে জার্মান পুঁজির আধিপত্য বেড়েছে। তার পরই আছে ফরাসি পুঁজির ও শক্তির দাপট। বাকি ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির কোনও ভূমিকাই নেই বলা যায়। তারা অনেকটা প্রজার মতো। এসব দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনও উন্নতিই ‘ই-ইউ’ গঠনের দ্বারা হয় নি, হওয়ার কথাও নয়।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মূলকথা — নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি। কেইনসীয় পুঁজিবাদী দাওয়াইয়ে সংকট যখন মেটানো গেল না, তখন এল এই দাওয়াই, যাকে সাহায্য করল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়, জনগণের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প নয় — সবই বেসরকারি মালিকানায় ও বাজারের উপর ছেড়ে দাও। পুঁজিপতিদের উপর কর কমাও, তাহলে পুঁজি বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। বাস্তবে কিছুই হল না। কারণ, পুঁজি উৎপাদন ছেড়ে ছুটল ফাটকায়। পণ্য উৎপাদন ছেড়ে পুঁজি এখন খাটছে টাকা কড়ির ব্যবসায়, রিয়েল এস্টেটে। টাকা কড়ির ও ঋণের ব্যবসায় ফাটকাবাজি ২০০৮ সালে বিশ্বজোড়া সংকট ডেকে আনল, মন্দার কোপে পড়ল সারা পুঁজিবাদী দুনিয়া। যার হাত থেকে বেরোবার পথ পাচ্ছে না বিশ্ব পুঁজিবাদ। কেইনসীয় ফর্মূলা রাষ্ট্রের যে ঋণগ্রস্ততা তৈরি করেছিল, তার হাত থেকে বেরোবার জন্য নয়া উদারবাদী ফর্মূলায় কাজ হল না কিছুই, উল্টে বাজার সংকট, অতি উৎপাদনের সংকট — মহান মার্কসের ব্যাখ্যাকে সত্য প্রমাণ করে বিকট আকারে দেখা দিয়েছে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ স্টিগলিজ, ক্রুবম্যানদের পরামর্শ মেনে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো কি আবার কেইনসে ফিরবে? একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনও পুঁজিবাদী ফর্মুলাই বিশ্ব পুঁজিবাদকে বর্তমান সংকট থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে না। গণভোটে সরাসরি ‘না’-এর পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করার জন্য গ্রিসের জনগণকে অভিনন্দন জানাই।

[সূত্র : সাপ্তাহিক গণদাবী, ১০-১৬ জুলাই ২০১৫]

সাম্যবাদ জুলাই-আগষ্ট ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments