মেয়েটির নাম স্বপ্না আক্তার। হয়তো জন্মের সময় তাকে ঘিরেই ডানা মেলেছিল বাবা-মায়ের স্বপ্ন। তাই নাম রেখেছিল স্বপ্না। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফিকে হতে সময় লাগেনি বেশি। দিনে দিনে আর্থিক অনটনে ভালো স্বপ্নগুলো ধূসর হয়ে যায়। একদিন বাবার হাত ধরে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে ঢাকায় আসে। একটি পরিবারে গৃহ শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত হয়। বয়স কতো হবে? ১৪/ ১৫ বছর। এই বয়সে একটু সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। পড়ালেখা করছে, ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বীজ বুনছে। স্বপ্না সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে রয়ে যায় ঢাকার চার দেয়াল ঘেরা একটি পরিবারে। প্রতিদিন সূর্য উঠার আগে তার ভোর হয়। সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই তৈরি করতে হয় সকালের খাবার। তারপর ঘর ধোয়া-মোছা, কাপড় ধোয়া, দুপুরের খাবার তৈরি, গৃহকর্তার ছেলেটিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসা, বিকালে আবার ঘর মোছা, রাতের খাবার তৈরি ইত্যাদি চলেই। সারাদিন এমনি কাজ করে করে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চোখ দু’টো লেগে আসলেই গৃহকর্ত্রীর অশ্রাব্য গালাগাল। প্রায় মায়ের বয়সী— হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে। সূদূর ভৈরবে এখন মধ্যরাত। এতক্ষণে একঘুম হয়ে গেছে। আর এখানে? এই মাঝ রাতেও ফুট-ফরমাস খাটতে খাটতে শরীর আর চলে না। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবেই তাকে ঘুমাতে হবে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কখন কার কী প্রয়োজন হয়?
এরকম হাজারো স্বপ্নার প্রতিদিনের দিনলিপির চিত্র এটি। বাংলাদেশে কী পরিমাণ গৃহ শ্রমিক রয়েছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন শৈশব-বাংলাদশে পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই ৩ লাখ শিশু গৃহ শ্রমিকের কাজের সাথে যুক্ত। যার শতকরা ৮০ ভাগ হচ্ছে মেয়ে শিশু, বাকী ২০ শতাংশ ছেলে শিশু। যাদের বয়স ৯ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। আবার ঢাকা শহরে গৃহ শ্রমিক হিসাবে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ২৫ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা যে বহুগুণে বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টে’র এক গবেষণায় দেখা যায়, একজন নারী প্রায় ১৬ ঘন্টা গৃহস্থালী কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এই শ্রমঘন্টা হিসাব করে একজন নারীর গৃহস্থালী কাজের মাসিক যে মূল্য পাওয়া গেছে তার পরিমাণ হচ্ছে ১০ হাজার ১৬৭ টাকা। যা বাৎসরিক হিসাবে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার ৯৯৬ টাকা। এভাবে হিসাব করলে দেশের ২৪.৫ মিলিয়ন (বিবিএস তথ্যানুসারে) পূর্ণ সময়ে গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত শহরের নারীরা বাৎসরিক ২৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯১৪ মিলিয়ন টাকা বা ৪২.৭ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্য কাজ করছেন। শহরে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন পূর্ণসময় কর্মজীবী নারী রয়েছেন। তাদের অর্ধেক সময় যদি গৃহাস্থলী কাজে ধরা হয় তবে এর পরিমাণ দাঁড়াবে বাৎসরিক ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৬ মিলিয়ন বা ২.১৮ বিলিয়ন ডলারের সম পরিমাণ। এ কাজের অর্ধেক যদি গৃহ শ্রমিকেরা করে থাকেন তাহলে জাতীয় অর্থনীতিতে গৃহ শ্রমিকের অবদান কয়েক মিলিয়ন ডলার তা বলাই বাহুল্য।
সাধারণত দুই ধরনের গৃহ শ্রমিক আছেন। স্থায়ী ও অস্থায়ী। অস্থায়ী গৃহ শ্রমিকেরা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় এসে কাজ করে দিয়ে যান। আর স্থায়ী শ্রমিকেরা সব সময়ই কাজ করেন। এদের মাসিক বেতন ১০০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। এদের বিশ্রামের জন্য আলাদা কোনো ঘর নেই। পৃথক বাথরুম নেই। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। এরা সবার পরে খায়। সবার পরে ঘুমায়। বিয়ে বা সন্তান ধারণ করলে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে বিদায় নিতে হয়। এতো পরিশ্রমের পরও পান থেকে চুন খসলেই বা কোনো কাজ পছন্দ না হলেই নেমে আসে বর্বরোচিত নির্যাতন। কিছুদিন আগেই আমরা পত্রিকায় দেখেছি, গৃহকর্মীকে গরম খুন্তি দিয়ে নির্যাতনের ঘটনা। এমন নির্যাতনের ঘটনা ক’টিই বা আর পত্রিকায় আসে। শারীরিক নির্যাতনের বাইরে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, মানসিক নির্যাতন তো আছেই। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে এদেশে গৃহকর্মী হত্যা হয়েছে ২২ জন; যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও বিয়ের প্রলোভনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৫ জন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর অনুসন্ধান মতে, বিগত সাত বছরে গৃহকর্মীদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ৬৪০টি। এই অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে বর্তমানে বাংলাদেশে এরকম গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। শুধুমাত্র ঢাকাতেই রয়েছে প্রায় দেড় লাখ গৃহকর্মী। অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেব মতে, গত দশ বছরে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭০টি, নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে ৫৬৫ জন, অথচ মামলা হয়েছে মাত্র ৫০০টি। দিনে দিনে নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলছে।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মজুরি নির্ধারণের কোনো উদ্যোগ নেই। গৃহ শ্রমিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করলেও তা কাগজ কলমেই রয়ে গেছে। প্রাচীন যুগের ক্রীতদাসদের গল্প আমরা ইতিহাসের বইতে পড়ি। কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে আজ একুশ শতকের আধুনিক ক্রীতদাসদের কান্না দেয়ালের ফাঁক গলে কান পাতলেই শুনব।