চা শ্রমিকদের আন্দোলনের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিকে উপেক্ষা করে ১৪৫ টাকার পক্ষে প্রহসনের চুক্তি করে মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রমিকদের দমিয়ে দিতে চেষ্টা করলেও শ্রমিকেরা রাজপথ ছাড়েনি। শ্রমিকদের আন্দোলনের চাপে মালিকপক্ষ ও সরকার এই প্রহসনের চুক্তিকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা চা শ্রমিকদের এই অনড় অবস্থানকে অভিনন্দন জানাই। আসুন, চা শ্রমিকদের বঞ্চনার দিকটা সম্পর্কে একটু খতিয়ে দেখা যাক।
কেন চা শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হলো
গত ৯ আগস্ট ২০২২ থেকে তিনশত টাকা মজুরি নির্ধারনের দাবিতে সারা দেশের চা শ্রমিকরা দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি শুরু করেছিল। কিন্তু তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করার জন্য সে সময় কোনো চা-বাগান মালিক বা মালিক সংগঠন অথবা সরকার বা তার শ্রম মন্ত্রণালয় বা শ্রম অধিদপ্তরের কোনো মহাপরিচালক শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে শ্রমিকদের মজুরি সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেনি। পেটের জ্বালায় শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি রাখে। পরবর্তীতে সারা দেশের ২৩১টি চা-বাগানে ১৩ আগস্ট শনিবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রমিকদের এই আন্দোলনের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যক্ত করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনসহ দেশের সকল প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনসমূহ। শুধু তা-ই নয়, সমর্থন ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে টিআইবি পর্যন্ত বহু গবেষণা সংগঠন, সামাজিক সংগঠন এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
টিআইবি বলছে শ্রমের পরিমাণের তুলনায় চা বাগান শ্রমিকদের যে সামান্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তা বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী। গত ১৬ আগস্ট মঙ্গলবার টিআইবি নির্বাহী পরিচালক এক বিবৃতিতে বলেন, সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে আট ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন চা শ্রমিকরা। দেশের অন্য যেকোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। প্রতি দুই বছর পর চা শ্রমিক ও বাগান কতৃর্পক্ষের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি নবায়নের রীতি থাকলেও উনিশ মাস ধরে চা শ্রমিকরা মজুরি চুক্তির বাইরে আছেন। এই উনিশ মাসে দুই পক্ষের তেরোটি বৈঠক হলেও কোনো বৈঠকেই তারা নতুন মজুরি নির্ধারন করেনি। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতির সময়ে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন চা শ্রমিকেরা। এর আগে তাদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে মাত্র ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা মালিকপক্ষ দিয়েছিল, তা চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞা ও উপহাসমূলক। তিনি চা শ্রমিকদের মধ্যে শ্রম আইনের পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিও করেন।
১৬ আগস্ট মঙ্গলবার মালিকপক্ষ ছাড়াই, সরকার পক্ষ নিজেরাই মালিকপক্ষ হয়ে মালিকপক্ষের ওকালতি দুইবার করে দুই দফা বৈঠকই ব্যর্থ করে দেন। সিদ্ধান্ত ছাড়াই দুটি বৈঠক শেষ হয়। আবার ঢাকায় বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয় পরের দিন। মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তারা শ্রমিকদের ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সুবিধা দিয়ে থাকেন। এটা হলো বাগানের জমিতে একটা লাউগাছ লাগানো বা একটা গাভী পালন করে দুধ বিক্রির সুবিধা। অথচ প্রচলিত আইনেই আছে নির্বাহী আদেশে দেওয়া কোনো সুবিধা মজুরি হিসাবে গণ্য হবে না। চা অ্যাসোসিয়েশন আরও বলছে, তাদের দৈনিক ২০ কোটি টাকার মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। পাতা তোলার ক্ষতি যে হবে, এটা তারা কি আগে জানতেন না? তাহলে ২৩ তারিখে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক কেন? কেন উনিশ মাস আগে হলো না? এখন ২৩ তারিখের কথা যে বলা হচ্ছে তা হলো, আলোচনা করতে করতে পিক সিজন পার করে দিয়ে পরে দাবি না মানার ফন্দি। চার দিন দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি যখন চলেছে, তখন যদি বুঝতেন চা শ্রমিকরা ধর্মঘটে গেলে ২০ কোটি টাকার লোকশান প্রতিদিন হবে, তা হলে বহু আগেই দাবি মেনে নিতেন। সিলেটের পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ বা মৌলভীবাজারের টাংগুয়ার হাওর বা হাকালুকি হাওরে যারা ধান কাটার কাজ করছে, সেই কামলাদের কারও রোজ মজুরি ৫০০ টাকার নিচে নয়। বাংলাদেশের কোনো প্রান্তেই দিন মজুরদের মজুরি ৫০০ টাকার নিচে নয়। চা বাগানেও চা শ্রমিক ফেডারেশনসহ অনেক শ্রমিক সংগঠনই ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি চা শ্রমিকদের জন্য দাবি করে আসছে। সে ক্ষেত্রে ইউনিয়ন যে তিনশত টাকা মাত্র চেয়েছে, এটা খুবই যৌক্তিক এবং মালিকদের প্রতি সহায়নুভূতির দাবি। এর চেয়ে নিচে কিছু চাইলে শ্রমিকের পেট বাঁচবে না। সে পরদিন পাতা তোলার জন্য এসে গাছের পাশে দাঁড়াতে পারবে না। কাজ করে না-খেয়ে মরার চেয়ে কাজ না করে না-খেয়ে মরাই ভালো–এই প্রেক্ষাপটে এই ধর্মঘট ডাক দেওয়া।
যেকোনো ভদ্রলোক শুনলে অবাক হবে যে, ১৬৭ বছর বয়েসের এই পুরানো শিল্পে শ্রমিকের মজুরি যদি এক টাকা করেও প্রতি বছর বাড়িয়ে দিত, তাহলেও শ্রমিকের মজুরি হতো ১৬৭ টাকা। অথচ আজ সেই মজুরি ১২০ টাকা। আর মালিক বাড়াতে চেয়েছিল আরও চোদ্দ টাকা। চা শ্রমিক তো পরের কথা, কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষেই এটা মানা সম্ভব হবে না। দুই বছর আগে যে পণ্য ১০০ টাকা দাম ছিল, তা আজ ২০০ টাকা। অথচ তারস্বরে চিৎকার করে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ বলা সরকার কিন্তু চা শ্রমিকদের মনুষ্যোচিত জীবন ধারণ নয় শুধু পশুর মতো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরিও দিচ্ছে না।
ফিরে দেখা ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলন
১৯২১ সালের ২০ মে আজ থেকে ১০১ বছর পূর্বে চা শ্রমিকরা প্রতারিত হয়ে তাদের নিজ এলাকায় ফিরে যেতে চেয়েছিল। তাদের ১৮ শতকের ৫ম ও ৬ষ্ট দশকে ভারতের কিছু হতদরিদ্র এলাকা থেকে চা চাষের বাগান তৈরির জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন তাদের বলা হয়েছিল তোমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে গিয়ে তোমরা গাছ হিলালেই টাকা পাবে। যেন গাছেই টাকা ধরে। “গাছ হিলায়গা তো পয়সা মিলায়গা।” তারা এখানে আসাম, সিলেট এলাকায় আসার পরে বুঝল যে, তাদের কাজ অনেক কঠিন। বাঘ, ভালুক, সাপ ইত্যাদি মোকাবেলা করে জঙ্গল পরিষ্কার করে চা গাছের চাষ করতে হবে। তারপর সে গাছ বড় হলে পাতা তুলে দিতে হবে। সে পাতা থেকেই উপাদেয় চা হলেও শ্রমিক পেট চালানোর মতো পয়সা পেল না। তাই তারা নিজ এলাকায় অর্থাৎ মুল্লুকে ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন ইংরেজরা তাদের ফিরে যাওয়া বাধা দিতে গুর্খা সৈন্য লেলিয়ে দিয়েছিল শ্রমিকদের উপর। সেই সৈন্যরা তাদের সিলেট স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে দেয়নি। কিন্তু এই হাজার হাজার শ্রমিক আসামের বাগানে ফিরে না এসে পায়ে হেটে চাঁদপুর গিয়ে স্টিমার ধরে মুল্লুকে চলে যাওয়া মনস্থ করেছিল। এতে চাঁদপুরে যাবার পর তাদের স্টিমারে উঠতে গুর্খা সৈন্যরা বাধা দিল। তারা না মানলে তাদের উপর নির্মম বর্বরতায় গুলি চালানো হলো। হাজারো শ্রমিকের রক্তে মেঘনা নদী লাল হয়ে গেল। এই ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন পণ্ডিত দেওশরন ও গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত নামের দুই চা শ্রমিক নেতা। এই হলো তাদের ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলন। আজও আমরা এই দিনকে চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের শপথ নেবার দিন হিসাবে গণ্য করে ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসাবে পালন করি।
কিন্তু আজও চা শ্রমিকদের পয়সা মেলেনি। সেদিনের চেয়ে আজ তাদের দুর্গতি আরও বেড়েছে। সেদিন তাদের মুল্লুকে যাওয়ার উপায় ছিল, আর আজ এই শতবর্ষ পরে মুল্লুকেও তাদের কেউ নেই। তাই যাবার উপায় নেই। আর এদেশেও এই ১৬৭ বছর পরে তাদের মজুরি ১৬৭ টাকাও হয়নি, তারা এখন মজুরি পায় মাত্র ১২০ টাকা। বাংলাদেশের যেকোনো গ্রামাঞ্চলে কামলার রোজ মজুরিও এখন ৫০০ টাকার নিচে নয়। অথচ ওদের ১২০ টাকা দিয়েই চলতে হয়। আমাদের নিকটে ভারতের ব্রহ্মপুত্র ভ্যালিতে চা শ্রমিকরা মজুরি ৩০৭ ভারতীয় রুপি পায়, তার সাথে মুদ্রা মূল্য অর্থাৎ আমাদের ৫০০ টাকা খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। চীন বা ভিয়েতনামে তো আমাদের দেশের তুলনায় মজুরি ও সুযোগ—সুবিধা আকাশ-জমিন বেশি। বর্তমানের ১২০ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষ বলবে। ১৬৭ বছর যে জমিতে ওরা কুঁড়েঘর করে বাস করল সেই ভূমির মালিকানা তাদের নেই। সংবিধানে তাদের জাতিসত্তার, ভাষার কোনো স্বীকৃতি নেই। ফলে তাদের যাবারও উপায় নেই, থাকারও উপায় নেই, কোথাও তাদের কেউ নেই।
চা শ্রমিকদের বঞ্চনার শেষ কোথায়
এখন এই দুর্দশাগ্রস্ত ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৩৬৪ জন শ্রমিক করবে কী? ২০১৭-১৮ সালেই গ্রাচুইটি দেওয়ার চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও আজ অবধি কোনো শ্রমিক গ্রাচুইটি পান না। করোনা মহামারির সময় ভারতে ৮৮১টি চা বাগান বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশে কোনো চা বাগান বন্ধ থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম থাকলে সেখানে করোনা হবে না। অথচ চা বাগানে ২০২০ সালেই করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২৩ জন, মৃত্যুবরণ করেছে ৫ জন। আমাদের দেশের বাগানগুলি খোলা ছিল সবসময়। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল ৮ মার্চ থেকে আর বাগানে পাতা উত্তোলন শুরু হয়েছিল ১৪ এপ্রিলের পর। ফলে কোনো উৎপাদনের ক্ষতি ছাড়াই বাগান বন্ধ রাখা যেত, যা মালিক বা সরকার বা বহুজাতিকরা করেনি। এসব ক্ষেত্রে যদিও চা শ্রমিকদের মজুরি দুই বছর পর পর রিভিউ করার কথা কিন্তু গত ১৯ সালের মজুরি বোর্ড তিন বছর পর পর রিভিউয়ের কথা বলেছে। যা অন্যায় কিন্তু ইউনিয়নকে জোরদার প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। ২০১৯ ও ২০২০–দুই বছরই রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন করেছে চা সেক্টরের কর্মীরা, অথচ তারা করোনা দুর্যোগের কোনো অনুদান বা প্রণোদনা পায়নি।
যতটুকু আইনে আছে, বাস্তবে তা-ও নেই
বাংলাদেশের শ্রম আইনের ২নং ধারার ৪৫নং উপধারা মোতাবেক বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা ও অন্যান্য নির্বাহী আদেশে প্রাপ্ত সুবিধা মজুরির অন্তভুর্ক্ত করা যাবে না। অথচ ২০১৯-এর মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষ আঙিনায় শাকসবজি চাষ, গরু-বাছুর পালন পর্যন্ত হিসাবে এনে ৪০৩ টাকার সুবিধা তারা শ্রমিকদের দেন–এই বয়ান দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে চুলচেরা হিসাব করলেও শ্রমিকরা ১০০ টাকার বেশি সুবিধা কোনো মতেই পান না। কিন্তু আবার শ্রমিকপক্ষ যদি বলে, ঠিক আছে আমরা চারশত টাকার সুবিধাই মেনে নিলাম, পেনশনের ক্ষেত্রে তাহলে এই চারশত টাকাসহ মোট মজুরি ধরে যে ১২০ টাকা নগদ দিচ্ছেন, তাকে মূল মজুরি ধরে পেনশন ধরুন, তবে তো পেনশন আসে ১২০*৩০ = ৩৬০০ টাকা। তা কী পেনশন দিচ্ছেন। না পেনশন দিচ্ছেন সপ্তাহে দেড়শত টাকা ধরে চার সপ্তাহে ৬০০ টাকা মাত্র। একই মজুরিতে এই দুই বিধান চালানো কি ঠিক হচ্ছে? শ্রম আইন অনুযায়ী নিট মুনাফার ৫% শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় হবে। অথচ মজুরি বোর্ড নতুন করে প্রস্তাব দিয়েছে চা বিক্রির ০.৩০% অর্থাৎ ১%-এরও অনেক কম শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে মালিকরা দিক। তাও কি দেয় কি না কে খোঁজ রাখে?
বাংলাদেশে শ্রম বিধিমালার ৫ম তফসিলের ৯নং অধ্যায়ে বলা আছে, চা বাগানের দীর্ঘদিনের সুযোগ-সুবিধা ও প্রথা কার্যকর রাখতে হবে। আর মজুরি বোর্ড প্রবেশনারী পিরিয়ড তিন মাসের জায়গায় ৬ মাস করল। মৃত্যুর পর শ্রমিকের যেকোনো পোষ্য বা পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় তার স্থলে চাকুরী পাবার প্রথা মজুরি বোর্ড রদ করে শুধু ছেলেমেয়ে পাবে করল। এটাও বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অধিকার আদায়ে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন, আওয়াজ তুলুন
এসব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কার্যকর সংগ্রাম করতে চা শ্রমিকদের তাদের নিজেদের সংগঠন ও তার প্রাণের দাবির সাথে পরিচিত হতে হবে। এবং সে দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করতে হবে। এছাড়া গরিব মানুষের বাঁচার আর কোনো পথ নেই। মজুরির দাবি ছাড়াও নিম্নোক্ত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন:
১. অবিলম্বে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা ঘোষণা কর। চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার ও সংখালঘু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে। ১,১৫,০০০ হেক্টর সরকারি খাস জমির ৪৫% চা আবাদ হয়, বাকি জমির ১২,১৪১ হেক্টর ক্ষেতল্যান্ড বা কৃষিজমি। অবিলম্বে চা শ্রমিকদের স্থায়ী আবাসনের বন্দোবস্ত করা হোক। ১৫০ বছর লেবার লাইনে বসবাসের পরও সে জমিতে তার মালিকানার অধিকার নেই, এটা হৃদয়বিদারক। চা জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভূমিহীন হিসাবে সরকারি তালিকাভুক্ত করে তাদের মধ্যে এই সরকারি কৃষি খাস জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে হবে। চা বাগানের জলাশয় শ্রমিকদের লিজ দিতে হবে। প্রতি কেয়ার বা ৩০ শতক লেবার লাইনের বসতবাড়ির খাসল্যান্ড ছাড়া অন্য ক্ষেতল্যান্ড ব্যবহারের লিজডিড সরকারের ভূমি রাজস্ব বিভাগের নিয়মে ভূমি কর সরকারকে সরাসরি ব্যবহারকারী শ্রমিকের নামে দেবে মালিকের নামে নয়। খাজনার রশিদ সরাসরি শ্রমিকের নামেই হবে, এটা লিজডিডে উল্লেখ করতে হবে। ভূমি অধিকার সংক্রান্ত আইএলও সনদ ১৬৯ অনুসমর্থন স্বাক্ষর বাস্তবায়ন করতে হবে। পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে, সংবিধানে তাদের বাঙালি করা চলবে না। ভারতের সংবিধানের ৫ম ও ৬ষ্ঠ তফসিলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র। স্পেশাল ইকোনমিক জোন বাগানের গরিবের জমিতে গ্রহণযোগ্য নয়। পর্যটন করতে চান, বাগান না থাকলে পর্যটন হবে না। চা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর ২.৫% হারে বাধ্যতামূলকভাবে বাগান কতৃর্পক্ষ চা গাছ লাগিয়ে সম্প্রসারণ করবে, কিন্তু তা করেনি। ৫০ বছরের পুরাতন গাছে ভালো পাতা হয় না। তাই ৪৪টি বাগান রুগ্ন, ২১টি বাগানে উৎপাদন বন্ধ। সরকার এসব বিষয়ে কী করে? বাগানের যে সব উঁচু জমিতে এখন মনোকালচার প্লানটেশন–রাবারও অন্যান্য করার চেষ্টা হচ্ছে, তা না করে ঐ জায়গায় চা চাষ সম্প্রসরিত করতে হবে। ২০ মে চা শ্রমিক দিবস পালন করতে হবে। সে দিন সরকারি ছুটি থাকতে হবে। প্রত্যেক বাগানে শহিদ মিনার নির্মাণ করতে হবে।
২. সপ্তাহে ৬ জনের পরিবারকে ২৫ কেজি চাল/আটা মাথাপিছু ৩.৫ কেজি হিসাবে মাসে ২ কেজি চা পাতা, তেল, ডাল, চিনি, রেশনে দিতে হবে। রেশন পচা হওয়া চলবে না। সকল পোষ্যদের ১৮ বছর পর্যন্ত রেশন দিতে হবে ১২ বছর নয়। এবং ১.৫ কেজি নয় পোষ্যরা অর্ধেক এর কম খাবে না। ক্ষেতল্যান্ড বরাদ্দের বিপরীতে রেশন কাটা চলবে না। বছরে দুইটি পূর্ণ বেতনসম উৎসব বোনাস দিতে হবে। অস্থায়ীদের শ্রম আইনের নির্ধারিত সময় ছয় মাস নয়, তিন মাসে স্থায়ী করতে হবে। নিরিখের অতিরিক্ত কাঁচা পাতার দ্বিগুণ মূল্য ও আট ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। সকল নিয়মিত শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রদান এবং তা ১৫% হারে বাড়ানো প্রয়োজন। শ্রমিক অবসর নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অন্যান্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। শ্রম আইনের ধারা ২৩৪ অনুযায়ী লাভের ৫% পাবে শ্রমিক। এ নিয়ম চা বাগানে আগেও ছিল কিন্তু বাস্তবে শ্রমিক কখনও এ টাকা পায় নি–এবার যাতে পায় সে দাবি করছি। বাগানের শিক্ষিত বেকারদের চাকুরি অন্যথায় বেকার ভাতা দিতে হবে। প্রতি বাগানে ন্যায্যমূল্যের দোকান চাই।
৩. অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিতে হবে। সংগঠিত হওয়ার সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে ১৯৪৮ সনের আইএলও কনভেনশন ৮৭-এর ‘ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব দি রাইট টু অরগানাইজ’ পুরোপুরি চালু করতে হবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রমিককে বাধ্য করে কাজ করানো চলবে না। শ্রমিকের বার্গেনিং ক্ষমতা লেবার হাউজ থেকে বাগান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে। সুদূর চট্টগ্রামে নয়, প্রতি ভ্যালিতে আলাদা শ্রম আদালত করে শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যন্য সেক্টরের মতোই চা শ্রমিকদেরও ১০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি দিতে হবে। অন্যরা ১৮ কর্মদিবসে একদিন অর্জিত ছুটি পায়, চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তাই হতে হবে, ২২ দিনে একদিন হওয়া চলবে না। শ্রম আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সকল প্রাপ্য ছুটি দিতে হবে।
৪. শোভন কর্ম পরিবেশ চাই। চা বাগানে শিশু শ্রম চলবে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ভ্যালির শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রেই এখন ডাক্তার থাকার কথা সত্ত্বেও থাকে না। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৮৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি বাগান ও ফাঁড়ি বাগানে ডাক্তার, ঔষধ, ডিসপেনসারি ও রোগী কক্ষ চাই। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কীটনাশক বাগানে ব্যবহার করা চলবে না। কীটনাশক প্রয়োগকারীকে দস্তানা, মুখোশও ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে। অন্তঃসত্তা নারীকে জোরপূর্বক ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করাতে বাধ্য করা চলবে না। চা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, প্রসূতিভাতা, ঔষধ, চিকিৎসা, পুষ্টিকর শিশুখাদ্য ও পর্যাপ্ত খেলনাসহ ‘শিশু দিবা যত্ন কেন্দ্র’ দিতে হবে। পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির ভালো ব্যবস্থা চাই। লেবার লাইনের প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ দিতে হবে। লেবার লাইনে প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য তিন কক্ষের আসবাবপত্রসহ পাকা বাসস্থান শ্রম আইন অনুযায়ী দিতে হবে। প্রতি ভ্যালিতে হাসপাতাল চাই। ১৫৬ বাগানের মধ্যে সরকারি প্রাইমারি স্কুল ৬টা, মাধ্যমিক বিদ্যালয় তিনটা, এছাড়া বাগান কতৃর্পক্ষের কিছু স্কুল আছে বটে কিন্তু বসবার পর্যাপ্ত বেঞ্চও নেই। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, টিউবওয়েল আসবাবপত্র এমনকি প্রতি শ্রেণির জন্য একটা করে হাজিরা খাতাও কোনো কোনো স্কুলে নেই। শিক্ষার্থীর বেশির ভাগেরই পরীক্ষার ফি দেবার সামর্থ্য নেই, ওদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তাদের ভাষা পরের প্রজন্মে পৌঁছতে পারে। সকল বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চাই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় চা শ্রমিক সন্তানদের ভর্তির কোটা চাই। শিক্ষার খরচ বাগান মালিককে বহন করতে হবে।