গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে চা শ্রমিকদের আন্দোলন গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছিল। জীর্ণ-শীর্ণ চক্ষু কোটরাগত শ্রমিকরা সরকার আর মালিকশ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বুক টান টান করে দাঁড়ালেন প্রতিরোধের সারিতে। ‘রক্ত দেবো, জীবন দেবো, তবু জমিন দেবো না’ স্লোগানে চান্দপুর-বেগমখানের মাটি প্রকম্পিত করে নিজেদের ভূমি এখনও আগলে রেখেছেন চা শ্রমিকরা। তীর-ধনুকের ফলা আর বল্লম হাতে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো শ্রমিকের জীবনপণ লড়াইয়ের কাছে পিছু হটতে বাধ্য হল প্রবল প্রতাপশালী সরকার বাহাদুর। এই স্পেশাল ইপিজেডের নামে বরাদ্দকৃত হবিগঞ্জের চান্দপুর বেগমখান চা বাগানের ৫২০ একর ধানি জমি রক্ষার দাবিতে সংগঠিত এই প্রতিরোধ বাস্তবে চা বাগানে ভূমির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এই দাবিকে বাস্তবায়ন করতে হলে একদিকে সকল চা শ্রমিকদের মধ্যে তা যেমন ছড়িয়ে দিতে হবে, অন্যদিকে গোটা আন্দোলনকে দাঁড় করাতে হবে সঠিক যুক্তির উপর। চান্দপুর বেগমখানের আন্দোলনের শুরু থেকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন তার সাধ্যমত ভূমিকা নিয়েছে, শুধু তাই নয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন তার সূচনালগ্ন (২০০৬ সাল) থেকেই ভূমি অধিকারসহ নানা দাবিতে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করে আসছে।
গত দেড় শতাধিক বছর ধরে চা শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর মমতায় চা শ্রমিকরা গড়ে উঠেছে আজকের চা শিল্প। সুদূর অতীতে একদিন একটু ভাল জীবনের প্রত্যাশায়, সন্তান-সন্ততি নিয়ে একটু সুখে থাকার আশায় এখানে এসেছিলেন চা শ্রমিকরা। ব্রিটিশদের সেই ছলনা-মিথ্যা আশ্বাস বুঝতে বেশি দিন লাগেনি, কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই বাগানে থাকতে হয়েছে। তখনকার আসামের গহীন অরণ্য, আর পাহাড় ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে চা শিল্পে রূপ দিতে গিয়ে সেদিন মেনে নিতে হয় প্রায় দাসোচিত জীবন। তারপরও বুকের কোন এক নিভৃত কোণে জেগে ছিল সেই একটু ভাল থাকার স্বপ্ন। চা শ্রমিকদের এই দীর্ঘ পথ চলা মূলত বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাস, ধূঁকে ধূঁকে ক্রমে নিঃশেষ হবার ইতিহাস, কিন্তু এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে তাদের নিজেদের আপন ভুবন। বাগানের গেরুয়া পথ, জরাজীর্ণ ঘর আর চা শ্রমিকদের জীবনের মত সমস্ত গ্লানি বহন করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা টিলাগুলোর সাথে গড়ে উঠেছে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক।
ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান বিদায় নিল, বারবার চা শ্রমিকরা আশায় বুক বাঁধলেন, কিন্তু হতাশ হতে হলো বারেবারে। স্বাধীন দেশের ৪৫ বছর অতিক্রান্ত কিন্তু আজো চার পুরুষের ভিটেয় চা শ্রমিকদের কোন আইনি অধিকার নেই। মালিক চাইলেই বাগান থেকে যে কোন শ্রমিককে তুলে দিতে পারে, আর একবার যদি কেউ চা বাগান থেকে উচ্ছেদ হন তবে এ জগতে মাথা গোজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত নেই। আজ চা বাগানে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো তার কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই, অনিশ্চিত তার ভবিষ্যৎ। আর এই ভূমির উপর অধিকার না থাকায় কখনও স্টেডিয়ামের নামে, কখনও ইপিজেড এর নামে অবাধে চলছে চা শ্রমিকদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ। শুধু তাই নয়, জমির উপর মালিকানা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে চাকুরির ক্ষেত্রে তৈরি হয় নানা জটিলতা।
চা শ্রমিকদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে ইতোমধ্যে শুরু হতে চলেছে আরেক বাহারি প্রকল্প যার নাম ‘টি-ট্যুরিজম’। চা বাগানের আশপাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন রিসোর্ট তারই স্বাক্ষ্য বহন করছে। এই ‘টি-ট্যুরিজমের’ ফলে চা শ্রমিকরা নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে যেমন উচ্ছেদ হবেন, তেমনি শিকার হবেন ভোগবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্যুরিজমের ফলাফল তাই দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মুখে নিজেদের শ্রমিকবান্ধব সরকার বলে প্রচার করা বর্তমান সরকারের ২০১০ সালে গৃহীত ‘চা শিল্পের জন্যে কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা : রূপরেখা ২০২১’-এ স্পষ্ট করে ঘোষণা করছে চা বাগানের ভূমিতে লাভজনক বিভিন্ন প্রজেক্ট চালু করতে হবে। সরকারের এই ঘোষণা বাস্তবে চা বাগানে দেশি-বিদেশি পুঁজির শোষণের পথ উন্মুক্ত করেছে।
বর্তমান বাংলাদেশে চা বাগানের জন্যে বরাদ্দকৃত ১,১৬১৭২ হেক্টর জমির মধ্যে ৬৫,২১৭ হেক্টর জমিতে চা চাষ হয়। আর বাকি জমি ক্ষেতল্যান্ড, কারখানা, শ্রমিক বস্তি, পতিত জমি ইত্যাদি চা বাগানের আনুষঙ্গিক ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহত হয়ে আসছে (উন্নয়নের পথ নকশা : রূপরেখা ২০২১)। এই পুরো জমিটাই সরকারি জমি। শুধুমাত্র চা বাগান করার শর্তে দীর্ঘ মেয়াদী লীজ (অর্থাৎ ৩০-৯৯ বছর পর্যন্ত) এর মাধ্যমে তা মালিকদের বরাদ্দ করা হয়। আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সাধারণত ৬০ বিঘার উর্ধ্বে জমি রাখতে না পারলেও চা বাগানের জন্যে তা শিথিল করা হয়েছে, কিন্তু এ সীমা সর্বোচ্চ কতটুকু তাও নির্ধারণ করা হয়নি। এদিকে কৃষি ও অকৃষি জমির জন্যে যে উন্নয়ন কর ধার্য্য করা হয়েছে তাও চা বাগানের জমির জন্যে কার্যকর নয়। বরং চা বাগানের জন্যে তা স্বতন্ত্র, প্রতি শতাংশে ১.১০ টাকা হারে। আবার কোন বরাদ্দকৃত জমির অল্প কিছু অংশ যদি শিল্প বা আবাসিক কাজে ব্যবহত হয় তবে সম্পূর্ণ জমিটাকেই শিল্প-বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহত জমি হিসাবে ধরে উন্নয়ন কর নির্ধারিত হবে, কিন্তু চা বাগানের বরাদ্দকৃত জমি তারও অন্তর্ভূক্ত নয়। (উপরে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল থেকে প্রাপ্ত)
তাই এটা খুব স্বাভাবিক যে ভূমি সংক্রান্ত প্রশ্নে সারাদেশের প্রচলিত ধারণা আর চা বাগানের ধারণা এক নয়। ফলে সঙ্গত কারণেই চা শ্রমিকদের বসত ভিটা, কৃষি জমি কোন কিছুই না থাকলেও দেশের প্রচলিত আইনে সরাসরি তারা ভূমিহীন নন। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালের ৫৩ ধারায় ভূমিহীনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে ‘(ক) যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষি জমি কিছুই নাই, কিন্তু পরিবারটি কৃষি নির্ভর/(খ) যে পরিবারের বসতবাটি আছে কিন্তু কৃষি জমি নাই অথচ কৃষি নির্ভর/(গ) যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষি জমি উভয়ই আছে কিন্তু উহার মোট পরিমাণ ০.৫০ একরের কম অথচ কৃষি নির্ভর’ এবং এখানে কৃষি নির্ভর বলতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে বা বর্গা চাষি হিসেবে কাজ করে। এই সংজ্ঞা হিসেবে চা শ্রমিকরা যে ভূমিহীন নয়, তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু ভূমি ম্যানুয়লর ৮ম অধ্যায়ের ১৬০তম ধারায় বলা হচ্ছে “ চা বাগান, রাবার বাগান…কতৃর্ক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষি জমির এই উর্ধ্বসীমা প্রযোজ্য হইবে না। …” এখানে স্পষ্টতই চা বাগানের জমিকে ‘কৃষি জমি’ বলা হচ্ছে। চা বাগানের জমি যদি ‘কৃষি জমি’ হয় তবে চা শ্রমিকরাও ভূমিহীন। বাংলাদেশ সরকার সরাসরি চা শ্রমিকদের ভূমিহীন স্বীকার না করলেও শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারেনি।
আবার স্বীকার-অস্বীকারের চেয়ে বড় প্রশ্ন একটা আইন প্রণীত হবে কাদের জন্যে, কোন্ প্রয়োজনে? মানুষের প্রয়োজনে, চা শ্রমিকদের সার্বিক অগ্রগতির প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ভূমি আইনে সামান্য পরিবর্তন তো আসতেই পারে। যেমন করে সরকারের ‘গুচ্ছগ্রাম সৃজন’ বিষয়টি এসেছে (যদিও তা খুব কার্যকর কিছু হয়নি)। তাই চা শ্রমিকদের ভূমিহীন হিসেবে গণ্য করে খাস জমি বরাদ্দ করা যেতে পারে। কারণ সরকার ঘোষণা করছে “…খাস জমি চিহ্নিত করিয়া ভূমিহীন ও প্রায় ভূমিহীন চাষী পরিবারের মধ্যে বসতবাড়ী নির্মাণের জন্যে খাস জমি বিতরণ এবং বাস্তুহারা পরিবার সমূহের মধ্যে বসতবাড়ী নির্মাণের জন্য খাস অকৃষি জমি বন্টন ‘জাতীয় ভূমি সংস্কার’ কার্যক্রমের প্রাথমিক স্তর (ঐ ধারা ৪১)। এক্ষেত্রে চা বাগানের জন্যে বরাদ্দকৃত জমির যে অংশ সরাসরি চা চাষে লাগে না তা চা শ্রমিকদের বরাদ্দ করা যেতে পারে (এখানে খতিয়ানের নানা জটিলতা যদিও আছে)। উল্লেখ্য, এই জমিই চা বাগানের শ্রমিকদের বস্তি এবং ক্ষেতল্যান্ড হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে।
এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয নজরে রাখতে হবে যে, চা বাগানের মালিকানা সরকারি ও বেসরকারি দু’ধরণেরই আছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজে সরকারি বাগানের জমি চা শ্রমিকদের নামে বরাদ্দ করতে পারেন। আবার প্রায় প্রতিটি বাগানেই বরাদ্দকৃত জমির একটি বড় অংশ অব্যবহার্য্য আছে, তা সরকার পুনঃগ্রহণ করে চা শ্রমিকদের বরাদ্দ করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই মালিকদের অনেকেই লীজের শর্ত ভঙ্গ করে চা বাগানে অবৈধভাবে আবাসিক এলাকাসহ অন্যান্য নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এদিকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘advers possession’ বা দখলী স্বত্ব বলে একটি আইন আছে, অর্থাৎ ১২ বছরের অধিককাল কেউ যদি কোন জায়গায় অবস্থান করে তবে সেই জায়গার উপর তার একটা মালিকানা তৈরি হয়। আর চা শ্রমিকরা তো আছেন দেড়শতাধিক বছর থেকে। তাই ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের জীবনমানের একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটতে পারে, আর এটা গোটা চা শিল্পের জন্যে হবে ইতিবাচক পদক্ষেপ। তাই চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকারের দাবি শুধু যৌক্তিকই নয়, এর একটা ঐতিহাসিক ন্যায্যতাও আছে।
‘চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার পেলে চা বাগান থাকবে না, শ্রমিকরা তা বিক্রি করে দিয়ে চা উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বাঁধাগ্রস্ত করবে’ Ñ এই যুক্তি তুলে অনেকে ভূমি অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়ান। এই যুক্তির কথা যারা বলছেন তারা শেষ পর্যন্ত মালিকদের পক্ষে ওকালতি করছেন। বাস্তবে চা শিল্পে যদি আধুনিক গনতান্ত্রিক শ্রম ও কর্ম পরিবেশ, উপযুক্ত মজুরি এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ বির্নিমাণ করা যায় তবে ভূমি অধিকার নিশ্চিত করাই হবে চা শিল্পের জন্যে সবদিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ। এজন্যে চা শিল্পে বৃটিশদের পরিচালিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরিতে অধুনিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের কাছে দাবি জানাই।
চা শ্রমিকদের জীবন শোষণ-বঞ্চণার বৃত্তে আবদ্ধ হলেও বারেবারে নিজেদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করেছেন সবুজ শ্যামলের বিস্তৃত প্রান্তর। নিজের বুকের তাজা রক্তে জীবনের সব ক্লেদ, সব দীনতা মুছে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব আর আন্দোলনে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে তা যথাযথ পরিণতিতে পৌছায়নি। জমি রক্ষার দাবিতে হবিগঞ্জের চা শ্রমিকদের আন্দোলনসহ ভূমি অধিকার আদায়ে এগিয়ে এসেছে অনেক সংগঠন, এসেছে অনেক এনজিও। এদের মধ্যে চা শ্রমিকদের বন্ধু যেমন আছেন, তেমনি বন্ধু বেশে আছেন অনেক শত্রুও। যেকোন আন্দোলনে শত্রু-মিত্র চিনতে পারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অতীতে চা শ্রমিকদের অনেক সংগ্রামী অর্জন শুধু এই কারণেই হারিয়ে গেছে। আবার আর একদল আছেন যারা আন্দোলনের ফলাফলটা যখন আসতে শুরু করে তখন তা কৌশলে নিজেদের হস্তগত করতে তৎপর হয়ে উঠেন, এদের সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন শুরু থেকেই চা শ্রমিকদের মধ্যে ভূমি অধিকারসহ সুনির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে শ্রমিকদের যেমন সংগঠিত করছে, আবার শ্রমিকশ্রেণীর অংশ হিসেবে চা শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টা গোটা চা অঞ্চলে একটা সচেতনতা তৈরি করেছে, যা গত ১০ বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় নির্দ্বিধায় আমরা উচ্চারণ করতে পারি। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভূমি অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলতে আমরা সকল চা শ্রমিকদের প্রতি আহবান জানাই।
শ্রমিক বার্তা, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১৭