কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরও বেশি পরিবেশবান্ধব করার অঙ্গীকার এসেছে ‘ওয়ান প্ল্যানেট’ সম্মেলনে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার একটি হলো দূষণ কমানো। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ১০০ প্লাস’ এর উদ্যোগের অংশ হিসেবে পরিবেশ দূষণকারী তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলনের সাথে জড়িত শত কোম্পানিকে চাপ প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। তালিকায় রয়েছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি), শেভরন, মাইনিং গ্রুপ, আরসেলর মিত্তাল এর মতো বহুজাতিক কোম্পানি। ওই সম্মেলনে কয়লা খাতে জড়িত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্সের বিমা কোম্পানি এক্সা। তারা প্রায় তিনশ কোটি ডলার বা ২৪ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালের পর থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিনিয়োগ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এক কথায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে কার্বন নিঃসরণ কতটা কমানো যায় সেই প্রতিশ্রুতি ছিল ‘ওয়ান প্ল্যানেট’ সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও অংশগ্রহণকারী হিসেবে অঙ্গীকার করেছেন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার।
একইভাবে গত বছরের নভেম্বরে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনেও শীর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ। ক্ষতি মোকাবেলায় ‘উন্নত’ ও দায়ী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়ায় ক্ষোভও জানিয়েছিল। ঘটনা দুটি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে সত্যিই বুঝি বর্তমান সরকার পরিবেশ দূষণ হ্রাসে বদ্ধ পরিকর। তারা বোধ হয় কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে চায়। কিন্তু ভুল ভাঙতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি! প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সম্মেলনে করা অঙ্গীকারের মাত্র ক’দিনের মাথাতেই সংবাদকর্মীদের ঘুরিয়ে দেখানো হলো দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অগ্রগতির চিত্র।
পটুয়াখালীতে লাখ লাখ টন কয়লা পুড়িয়ে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে উৎপাদন করা হবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর আগে দেশের মানুষের তীব্র বিরোধিতার পরও সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা আমরা জানি। এরপরে আছে মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। মোদ্দাকথা, দূষণের কারণে চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ সবাই যখন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনছে; তখন বাংলাদেশ কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ জোর কদমে এগিয়ে নিচ্ছে।
জ্বীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম একটি হলো কয়লা, আর সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণও হয় কয়লা থেকে। খনি থেকে উত্তোলন ও ব্যবহারের মাধ্যমের বিষাক্ত সালফার ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। গত ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা দূষণ সইতে না পারে মুখে মাস্ক পড়ে খেলেছে। দিল্লির বাতাস এখন এতটাই বিষাক্ত যে কিছুদিন পর পর তাদের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছুটি ঘোষণা করতে হচ্ছে। বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ দশে দিল্লিকে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় অবদান রেখেছে কয়লার প্রবল ব্যবহার। চীনের অবস্থা তো আরও মারাত্মক। সেখানে বোতলের পানি কেনার মতো বিশুদ্ধ বাতাস কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। দূষণ থেকে বাঁচতে প্রায় ১২’শ কয়লা খনি বন্ধ এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কলকারখানা কমিয়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে দেশটি। যুক্তরাজ্যসহ প্রথম বিশ্বের অনেকগুলো দেশ এখন ধীরে ধীরে কয়লা থেকে বেড়িয়ে নবায়ণযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। তাহলে আমাদের শাসকেরা কেন একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠেছে? প্রতিবেশি দেশসহ বিভিন্ন দেশে কয়লা ব্যবহারের বিপদ দেখেও কেন তারা উল্টো পথে হাঁটছে? বৈশ্বিক সম্মেলনে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনার অঙ্গীকারের পরও কেন এমন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার? এর কোনো সদুত্তর নেই।
বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭’ প্রতিবেদন বলছে, পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতিবছর ৪২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি। একইসাথে বাড়ছে অকাল মৃত্যুসহ মানুষের রোগবালাই। বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রা এখন এতটাই ভয়াবহ যে, বিশ্বের দূষিত শীর্ষ নগরীগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ সিসা দূষণের শিকার হচ্ছে। কয়লা পুড়িয়ে চলা ইটভাটাগুলো অর্ধেকের বেশি দূষণের জন্য দায়ী। সাথে যখন তখন রাস্তাঘাট খোড়াখুড়িসহ অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেও ধূলাবালিতে নাকাল রাজধানীবাসী। বছর জুড়ে চলা এসব উন্নয়নে ন্যূনতম প্রতিরোধক ব্যবস্থা না নেয়ায় জনস্বাস্থ্য আজ চরম হুমকিতে। এতে শীত-গ্রীষ্মে বায়ু দূষণ আর বর্ষাকালের জলাবদ্ধতাসহ পানি দূষণে বিপর্যয় যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পরিকল্পিত উদ্যোগেই চলছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড! এই যেমন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী সরিয়ে নিয়ে বুড়িগঙ্গার মতোই ধলেশ্বরী নদীকে মেরে ফেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
দূষণের কারণে পরিবেশের যখন এই বিপর্যয় তখন পরিবেশ রক্ষায় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে সরকার। আগামী ৫ বছর পরিবেশগত দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলাসহ ‘পরিবেশ সুশাসন’ -এর জন্য ৫৬ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে জাতীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা (সিআইপি) হাতে নিয়েছে সরকার। যদিও পরিবেশ রক্ষায় সরকার আন্তরিক হলে নিশ্চয় কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সচেষ্ট হতো, উড়াল সেতুসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করত। কিন্তু এসবের ধারা কাছে নেই বর্তমান সরকার। বিশাল অংকের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে আসলে জনগণের টাকা লুটপাট করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য।