তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ২২ জুলাই ২০১৭, জাতীয় প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে সরকারের বাংলাদেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (২০১৭-৪১)-এর বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত খসড়া রূপরেখা উত্থাপন করেছে।
প্রস্তাবিত রূপরেখায় বলা হয়েছে, ‘সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর আধিপত্য থেকে মুক্ত হলে দেশ ও জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি না করে সর্বোচ্চ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সম্ভব।’ প্রস্তাবে বলা হয় এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হবে, ‘সকল নাগরিকের জন্যে সুলভে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত, নিরাপদ-ঝুকিহীন ও পরিবেশসম্মত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ এবং জাতীয় সক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
সরকার ও জাতীয় কমিটির প্রস্তাবের তুলনামূলক অবস্থান তুলে ধরে এতে বলা হয়েছে, সরকারের পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো আমদানী ও রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণ নির্ভরতা। যা পরিবেশ বিধ্বংসী। সরকারের বিদ্যুৎ উৎপানের প্রধান উৎস হলো কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক এবং মূল চালিকা শক্তি হলো বিদেশি কোম্পানী অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও কনসালটেন্ট। এর বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, মূল বৈশিষ্ট্য হবে দেশের সম্পদ নির্ভরতা। রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণ মুক্ত ও পরিবেশ অনুকূল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস ধরতে হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে। মূল চালিকা শক্তি হবে জাতীয় সংস্থা, দেশিয় প্রতিষ্ঠান ও জনউদ্যোগ।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট নির্ধারণ করে সরকার ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তার বিপরীতে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে টার্গেট থেকে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রস্তাবে বলা হয়, বিদ্যুতের দামও এক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী (২০১৫-এর দামস্তর অনুযায়ী) ১২.৭৯ টাকা বিপরীতে ৫.১০ টাকায় আনা সম্ভব।
এখানে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত খসড়া রূপরেখার সার-সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো –
বাংলাদেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (২০১৭-২০৪১)
জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত খসড়া রূপরেখা
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
২২ জুলাই ২০১৭। ঢাকা
ভূমিকা
বাংলাদেশে এখনও শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ গ্রীড বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। যারা বিদ্যুৎ সংযোগের মধ্যে আছেন তারাও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। ট্রান্সমিশন বিতরণ ব্যবস্থা ভয়াবহ ত্রুটিপূর্ণ। যারা সৌর বিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম) পাচ্ছেন, তাদের দিতে হচ্ছে অস্বাভাবিক উচ্চ দাম। বিদ্যুতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলেও নিয়মিতভাবে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। এই অবস্থা মোটেই অর্থনীতির বিকাশ কিংবা জনগণের জীবনমান উন্নয়নের অনুকূল নয়।
বাংলাদেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, ২০৪১ সাল নাগাদ তা প্রায় ২২ কোটিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়ছে অর্থনীতির আকার, বিদ্যুৎ নির্ভর কৃষি, শিল্পসহ অর্থনৈতিক তৎপরতা বাড়ছে; জীবনযাপনেও বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এর ফলে আগামী ২০৪১ নাগাদ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে কয়েকগুণ। তাই সকল ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো এবং শিল্প কৃষির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন যাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে, যাতে দাম সবার সাধ্যের মধ্যে থাকে সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। সকল তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, দেশি বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর আধিপত্য থেকে মুক্ত হলে দেশ ও জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি না করেই সর্বোচ্চ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সাজানো সম্ভব।
দেশের সম্পদ, সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে, বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য দেশের জনগণ ও সরকারের কাছে আমরা এই বিকল্প মহাপরিকল্পনা উপস্থিত করছি। আমাদের এই মহাপরিকল্পনার কেন্দ্রীয় লক্ষ্য:
- দেশের সকল নাগরিকের জন্য সুলভে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
- দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সম্পদের জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করা ও তার সর্বোত্তম ব্যবহার।
- সবার জন্য নিরাপদ, ঝুঁকিহীন এবং পরিবেশসম্মত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্দেশ করা।
- জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামগ্রিক জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কয়েকটি অধ্যায়ে আমরা এই মহাপরিকল্পনা উপস্থাপন করছি
- বর্তমান পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিকাঠামো
- সরকারি মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬)র বৈশিষ্ট্য
- অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও পরিবেশ: বৈশ্বিক নতুন গতিমুখ
- বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদ, সরকারের ভূমিকা ও করণীয়
- বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর সম্ভাবনা ও বিতর্ক
- বিভিন্ন জ্বালানির তুলনামূলক খরচ
- বাংলাদেশের জন্য জাতীয় কমিটির রূপরেখা
- সরকারের সাথে তুলনামূলক অবস্থান
বর্তমান পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিকাঠামো
সরকারি ভাষ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের মোট স্থাপিত ক্ষমতা ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট, ডিরেটেড ক্ষমতা ১২,৫৭৮ মেগাওয়াট।1 ২০ জুলাই সর্বোচ্চ প্রকৃত উৎপাদন হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৮ মেগাওয়াট।2 সরকার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ সহ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থাপিত ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে বলে দাবি করে থাকে। প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন পিডিবি-র সর্বশেষ গড় হিসাবে কমবেশি ১০ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে শতকরা ৬৯ ভাগ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, তেল থেকে শতকরা ২১ ভাগ, শতকরা ১০ ভাগ আসে কয়লা, জলবিদ্যুৎ এবং আমদানি থেকে। বর্তমানে বছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩২৪ এবং মোট প্রাপ্তি বছরে ২৮১ কিলোওয়াট। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ চাহিদা হিসাব করা হয়েছে ১১ হাজার ৪০৫ মেগাওয়াট।3 ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লোকসান এখনও উচ্চ।
৮০ দশক থেকে বাংলাদেশে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমান্বয়ে দেশি বিদেশি মুনাফা ভিত্তিক ব্যক্তি মালিকানা খাতে রূপান্তর করার নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলছে। এরকম নীতিকাঠামো বিন্যাসে মূল নেতৃত্ব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ কতিপয় সংস্থা, যাদের প্রধান লক্ষ্য বিশ্বের বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা, এবং দেশে দেশে সম্পদ ও পরিষেবা খাতে তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। বিভিন্ন সরকার ও দেশের ভেতরের সুবিধাভোগীরা তাদের শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থে এদের আরোপিত নীতি গ্রহণ করেছে এবং তার বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন জাতীয় সংস্থাকে দুর্বল ও খন্ড খন্ড করে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেশের তেল-গ্যাস- কয়লা সম্পদ এবং বিদ্যুৎ খাত তুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।4 কোম্পানি স্বার্থে গ্যাস ও কয়লা রফতানিরও আয়োজন করা হয়েছিলো। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ বিনষ্ট করে, দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কয়লা খনি, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে বারবার। উন্নয়নের নামে ভুল জনস্বার্থবিরোধী নীতির কারণে ক্রমে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে, তৈরি হয়েছে ভুলনীতি-দুর্নীতি-ধ্বংসের দুষ্টচক্র। ভুলনীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না তোলা হয় সেজন্য ২০১০ সালে দায়মুক্তি আইন প্রনয়ন করা হয়। প্রথমে চার বছরের জন্য এটি করা হলেও এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২১ সাল পর্যন্ত নেয়া হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশকে একটি অভিশপ্ত সম্পদের দেশে পরিণত করবার সকল আয়োজন করা হয়েছিলো।5 কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে ব্যাপক জনসম্পৃক্ত প্রতিরোধ তৈরি হবার কারণে এই পরিকল্পনা পুরোমাত্রায় বাস্তবায়ন হতে পারেনি। সীমিত গ্যাস ও কয়লা সম্পদের দেশ থেকে রপ্তানির নামে গ্যাস ও কয়লা পাচার করবার প্রকল্প বাতিল হয়েছে, উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বাস্তবায়ন হতে পারেনি। সেই প্রতিরোধের শক্তিতেই সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লা প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনটি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐক্য ও সংহতি তৈরি করেছে।
বহু আগেই জাতীয় কমিটির ৭ দফায় (পরিশিষ্ট-১) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধানের রূপরেখা দেওয়া হলেও সরকার বরাবর কতিপয় দেশি বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় সর্বনাশা ব্যয়বহুল ঋণনির্ভর পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পকেই গ্রহণ করেছে।
সরকারি মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬)র বৈশিষ্ট্য
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য সরকার জাপানের জাইকার কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে ২০৪১ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা6 (পিএসএমপি ২০১৬) উপস্থিত করেছে। এই মহাপরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. এই ‘মহাপরিকল্পনা’ বিদেশি তহবিল ও বিশেষজ্ঞ নির্ভর। দলিলের ‘স্টাডি টিমের’ তালিকা এর প্রমাণ।7 ইংরেজিতে প্রণীত এই দলিলে জাপানী ব্যবসায়িক সংস্থার যুক্ততাও স্পষ্ট। এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে: Japan International Cooperation Agency (JICA), Tokyo Electric Power Services Company Limited, Tokyo Electric Power Company Holding, Inc.
২. এই ‘মহাপরিকল্পনা’য় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, জনবসতি, সম্পদের আপেক্ষিক অবস্থান, জাতীয় সক্ষমতা, পরিবেশগত ঝুঁকি, আর্থিক সামর্থ্য, এবং জনস্বার্থের প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।
৩. এই ‘মহাপরিকল্পনা’ প্রণয়নের আগেই তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন নতুন প্রকল্পের তালিকা থেকে এটি নিশ্চিত যে, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
৪. এই ‘মহাপরিকল্পনা’ অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি প্রকল্পই হবে বিদেশি কোম্পানি ভিত্তিক, আমদানি ও ঋণ নির্ভর। এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবেশ বিধ্বংসী উচ্চ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদনকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
৫. যথাযথ পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া, জনসম্মতির বিরুদ্ধে, অনিয়ম, বলপ্রয়োগ করে সুন্দরবনবিনাশীসহ প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ৭২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং সম্পূর্ণ আমদানি করা এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রকল্পকে যৌক্তিকতা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে এতে।
৬. এই ‘মহাপরিকল্পনা’য় দেশের স্থলভাগ এবং গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। এছাড়াও এতে দেশীয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক নীরবতার পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে সম্পূর্ণই আমদানিকৃত এলএনজি-র উপর নির্ভর করা হয়েছে। একদিকে দেশে গ্যাস সংকটের অজুহাত দিয়ে এলএনজি, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে, অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানির সাথে গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখেই একের পর এক চুক্তি করা হচ্ছে।
৭. একই কারণে মহাপরিকল্পনায় নিয়মিতভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে স্পষ্টই উল্লেখ করা আছে, ‘এলএনজি আমদানি ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক দাম বিবেচনায় প্রতিবছর ১৯ থেকে ২৯ শতাংশ হারে গ্যাসের দামবৃদ্ধি করতে হবে।’8
৮. সারাবিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের গতি অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পেলেও এই ‘মহাপরিকল্পনা’য় তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং আন্তর্জাতিক ভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যয় দ্রুতগতিতে কমে এলেও এই দলিলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ব্যয়ের চিত্রটি অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
৯. সরকারের মহাপরিকল্পনায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার অনেকগুলোই দেশের সংবিধান ও দেশের আইন পরিপন্থী।
অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও পরিবেশ: বৈশ্বিক নতুন গতিমুখ
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, কয়লা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। এরপর ক্রমে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কারের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এসব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমে কয়লা বিদ্যুতের পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান হওয়ায় বিকল্প নানা পদ্ধতির অনুসন্ধান বেড়েছে। বর্তমানে আমরা বিশ্বব্যাপী এক নতুন পর্বের মুখোমুখি হয়েছি যেখানে নবায়নযোগ্য উৎসসমূহ অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে একটি পরিচালিকা শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। আনুপাতিক হারে কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবহার অতি দ্রুত কমে আসছে। পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন শর্ত আরোপিত হওয়ায় কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্যও কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তারপরও বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ও পারমাণবিক ব্যবসার সাথে জড়িত বহুজাতিক পুঁজি এবং তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন নতুন ধারার অগ্রগতিতে বাধা দিচ্ছে এবং পুরনো বিপজ্জনক ধারাই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ‘গরীব’দেশে এসব পরিত্যক্ত প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয়ার নানাবিধ অপচেষ্টা এখনও জোরদারভাবে চলছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
বহু প্রতিবন্ধকতা ও লবিষ্টদের তৎপরতা সত্ত্বেও বিশ্ব জুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সর্বব্যাপী অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একমাত্র এই ধারাটিই বিকাশমান, যেখানে কয়লা ও তেলসহ জৈব জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবণতা দ্রুত পড়তির দিকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুত দ্রুত আরও বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী হচ্ছে, প্রযুক্তিগত বিকাশও হচ্ছে দ্রুত। এর ফলে হাতে গোণা কিছু দেশ ছাড়া সব দেশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেশে নীতিমালা পরিবর্তন করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান ও দক্ষতা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বর্তমানে ভারতে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা এখন ৫০,০১৮ মেগাওয়াট (বাঁধভিত্তিক বিদ্যুৎ ছাড়াই)।9 সম্প্রতি প্রকাশিত ভারতের ড্রাফট ন্যাশনাল ইলেকট্রিসিটি প্ল্যান থেকে জানা যায় যে, ২০২২ সালের মধ্যে এই ক্ষমতা ১ লক্ষ ৭৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে।10 অপরদিকে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যেই জলবিদ্যুৎ সহ সৌর, বায়ু এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকেই প্রায় ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।11 ভারত ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সৌর জোটও গঠন করেছে। সৌর বিদ্যুতের খরচ দিন দিন কমে আসছে। ভারতের জ¦ালানি গবেষক বিজ্ঞানী সৌম্য দত্তের মতে, ‘যদি ভারত তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়, এমনকি লক্ষ্যের ৭০ শতাংশও অর্জন করতে পারে, তাহলে আগামী অন্তত ১৫ বছরের জন্য ভারতে কোনো কয়লা, পারমাণবিক বা বৃহৎ বাঁধনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন হবে না।12 ভারতের সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিদ্যুৎ বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৭ সাল পর্যন্ত ভারতের নতুন কোনো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজন নেই।13
অপরদিকে চীন এ বছর নির্মানাধীন ১ লক্ষ ২০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার ১০৪’টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে।14 বায়ু দূষণ মোকাবেলায় রাজধানী বেইজিং শহরের সবকটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।15 শুধুমাত্র কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দূষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চীন সরকার ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছরে ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।16 বিশ্ব পরাশক্তির অন্যতম দেশ চীনের জন্য এই বিনিয়োগ তার প্রতিরক্ষা বাজেটেরও দ্বিগুণ। সেই সাথে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাতে ৩৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে ২০২০ সালের মধ্যেই ১ কোটি ৩০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান তৈরীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ।17
ডেনমার্কে বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৪০ শতাংশই আসছে বায়ুবিদ্যুৎ থেকে, ২০২০ সালের মধ্যেই তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে । অথচ সত্তরের দশকের আগ পর্যন্ত সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানী করা তেল নির্ভর। ১৯৭৩ সালে তেল বাণিজ্যে অবরোধ জারি হলে সেই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তাঁরা বেছে নেয় নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে। ডেনমার্ক ২০৫০ সালের ভেতর শতভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছে।18
উল্লেখ্য এ বছরের ১৫মে জার্মানির প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের প্রায় পুরোটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হয়।19 ২০১৬ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে জার্মানির মোট বিদ্যুতের ২৯.৫% উৎপাদিত হয়েছে ।20 নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে জার্মানিতে ২০২৫, ২০৩৫ এবং ২০৫০ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে যথাক্রমে ৩৫%, ৫৫% এবং ৮০% । নেদারল্যান্ডে ২০১৭ সালের শুরু থেকেই সকল ট্রেন বায়ু বিদ্যুৎ দিয়ে চলছে।21 ফ্রান্স ২০২৩ সালের মধ্যেই সকল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।22 অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খনন কোম্পানী পিবডি এনার্জী ২০১৬ সালে নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।23 (বিভিন্ন দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির আরও খবরের জন্য দেখুন পরিশিষ্ট-২।)
বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদ, সরকারের ভূমিকা ও করণীয়
বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি বিপুল পরিমাণে না থাকলেও যতটুকু আছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার কখনোই সম্ভব হয়নি। ১৯৮০ দশক থেকে বিভিন্ন ভুল নীতি ও দুর্নীতির অংশ হিসেবে বহুরকম ক্ষতিকর চুক্তি হয়েছে। তার ফলে দেশের সম্পদ বিপদ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলসম্পদ
পিএসএমপিতে বাংলাদেশের স্থলভাগের এবং গভীর ও অগভীর সমুদ্র ব্লকের সম্ভাব্য গ্যাস ও তেল সম্পদ নিয়ে সরকারের হতাশা মূলত এলএনজি, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা তৈরির সামগ্রিক মহাপরিকল্পনার অংশ। সেকারণে একদিকে নতুন অনুসন্ধান কাজের জন্য জাতীয় সংস্থাগুলোর ভূমিকা পালনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, অন্যদিকে একের পর এক রপ্তানিমুখি চুক্তি করা হয়েছে বিদেশি কোম্পানির সাথে। অথচ আমাদের গবেষণা অনুযায়ী জাতীয় সংস্থার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত না করলে রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধান ও উত্তোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের গ্যাস সংকট দূর করা সম্ভব হতো, আবার বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনের খরচও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেত।24
বর্তমানে বাংলাদেশের স্থলভাগে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত অবশিষ্ট আছে ১৩.৬০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।25 নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনযুক্ত না হলে ২০১৮ এর পর থেকে গ্যাসের সরবরাহ কমতে শুরু করবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা থেকে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, গভীর ও অগভীর সমুদ্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাসসম্পদ আছে যা পরবর্তী কয়েক দশকে তুলনামূলকভাবে সুলভ ও পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ অবকাঠামো গড়ে তোলার ভিত্তি নির্মাণ করতে সক্ষম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গ্যাসব্লক নিকটবর্তী অভিন্ন ভূতাত্ত্বিক গঠন সমৃদ্ধ আরাকান বেসিনে সম্প্রতি ৯ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে।26 একই ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠনযুক্ত বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের সকল জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় হাইড্রোকার্বনের বিশাল মজুদ এখনো অনাবিষ্কৃত। ২০০১ সালে ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার যৌথ নিরীক্ষণে বাংলাদেশের স্থলভাগ এবং অগভীর সমুদ্রে অনাবিষ্কৃত ৩২ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিলো।27 মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমানার গভীর সমুদ্রে একই ভুতাত্ত্বিক গঠনে (জিওলজিক্যাল ফোল্ডে) মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন গভীর সমুদ্রের DS-12, DS-16, DS-21, DS-25 ব্লকগুলোতে গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।28 বর্তমানের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের উত্তোলনযোগ্য মজুদের সাথে গভীর ও অগভীর সমুদ্রের অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ যুক্ত হলে সব মিলিয়ে ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাবনা অলীক নয়। তবে তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশ অবশ্য করণীয়।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সম্পদে মালিকানার চিত্র পাল্টেছে। সত্তরের দশক পর্যন্ত জ্বালানি সম্পদে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত কতিপয় বহুজাতিক কোম্পানির এবং সেই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর। বিশ্বের শতকরা ৮৫ ভাগ তেলসম্পদ তাদের দখলেই ছিল। গত চার দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ তাদের জাতীয় সংস্থার বিকাশ ঘটিয়েছে। খনিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম মালিকানা তাদের উন্নয়ন নীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সর্বশেষ হিসাবে বিশ্বের শতকরা ৭৩ ভাগ তেলসম্পদ এসব দেশের জাতীয় সংস্থার মালিকানায় উত্তোলিত হয়, এবং উত্তোলনের শতকরা ৬১ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে।29
বাংলাদেশের শাসকদের ‘রোডম্যাপ’ বরাবরই উল্টো দিকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা মালয়েশিয়ার ‘পেট্রোনাস’ আর নরওয়ের ‘স্টেট অয়েল’-এর সমবয়সী। অথচ পেট্রোনাস ও স্টেট ওয়েল ইতিমধ্যেই বিশ্বপর্যায়ে কাজের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ভারতের সংস্থা ওএনজিসি-ও প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজের সক্ষমতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও পেট্রোবাংলাকে নিজের সক্ষম ভিত্তি দাঁড় করাতে দেয়া হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংস্থাগুলোর ‘অক্ষমতা’র অজুহাতে, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির বিভিন্ন প্রকল্পকে যৌক্তিকতা দেয়া হয়েছে। দেশের কাজে শতভাগ ব্যবহারের নীতিমালা গ্রহণ না করে, পুঁজির অভাবের যুক্তি দিয়ে বিশাল সম্ভাবনাময় গ্যাসব্লক বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। ‘পুঁজি নেই’ বলে এসব চুক্তি করা হলেও প্রয়োজনীয় পুঁজির চাইতেও বহুগুণ বেশি অর্থ প্রতিবছরেই বিদেশি কোম্পানির পক্ষে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এতে ঋণগ্রস্থ হচ্ছে অর্থনীতি, বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এসব কর্মকান্ড আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সরকার প্রণয়ন করেছে দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন। ফলে এই বিপুল সম্ভাবনাময় গ্যাস সম্পদ দেশের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। বরং এই ধরনের চুক্তির কারণে দেশের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়ছে।
বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তার পূর্বসূরি পেট্রোবাংলার অধীনে নিযুক্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও ক্ষতির দায়ভার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকেই বাপেক্সের আয়, স্থায়ী খরচ, অনুসন্ধান ও খনন খরচ সবকিছুই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। বাপেক্সেকে তার বিভিন্ন প্রকল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রেও সরকারের গাফিলতি দেখা গেছে। এ রকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বাপেক্স যতটুকু সুযোগ পেয়েছে, দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বর্তমানে এসব কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বাপেক্স ভূতাত্ত্বিক এবং ভূপদার্থিক উপাত্ত সংগ্রহ ও মূল্যায়ন, বেসিন পর্যালোচনা, ভূরাসায়নিক বিশ্লেষণ, কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার, কূপ সেবা, পূর্তউন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে। জাতীয় কমিটি দীর্ঘদিন ধরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সংস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে প্রচলিত প্রচার-প্রচারণার বিপক্ষে তাদের যুক্তি তর্ক তুলে ধরেছে। সক্ষমতা বিকাশের নীতি গ্রহণ করলে এই সংস্থাই গভীর ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে সক্ষম হবে।
দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার অজুহাতে বারবার বিদেশী কোম্পানিকে ডেকে আনা হলেও কূপ খনন ও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানির সাফল্যের অনুপাতের তুলনায় বাপেক্সের সাফল্যের অনুপাত অনেক ভালো। শুধু তা-ই নয়, সার্ভিস কন্ট্রাক্টের আওতায় বাপেক্স বহুজাতিক কোম্পানিকেও বিভিন্ন কাজ করে দিচ্ছে। নাইকো এবং অক্সিডেন্টালের মতো বিদেশী কোম্পানি মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলার ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, গাজপ্রম কয়েকগুণ বেশি অর্থ পেয়েও চুক্তি অনুযায়ী গ্যাসকূপ খননের দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারেনি, কিন্তু বাপেক্স-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বিদেশি কোম্পানিগুলোকেই নানাধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। এমনকি মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলার ভয়াবহ বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়েরও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, যথাযথ নীতিগ্রহণ করলে ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশের গ্যাস চাহিদা নিজেদের গ্যাস থেকেই মেটানো সম্ভব। কিন্তু সেই লক্ষ্যে (১) গ্যাস নিয়ে রপ্তানিমুখি চুক্তি বাতিল করতে হবে। (২) বাপেক্স কে কাজের সুযোগ দিতে হবে, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এবং (৩) স্থলভাগ এবং গভীর ও অগভীর সমুদ্রে নিয়মিতভাবে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
কয়লাসম্পদ ও ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’
এখন পর্যন্ত জানা মতে, বাংলাদেশে ৫টি কয়লাখনিতে প্রায় ৩ বিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে। তবে এর অর্ধেক আছে জামালগঞ্জ খনিতে যেখানে বর্তমান প্রাপ্ত প্রযুক্তির কোনোটি দিয়েই কয়লা খনন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি আবিষ্কার করে। ২০০৪ সালে পেট্রোবাংলা চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে সাবকন্ট্রাক্টর নিয়োগের চুক্তি করে। পরের বছর থেকে এই খনির কার্যক্রম শুরু হয়। ৯০-এর শুরু থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনি কোম্পানিগুলো এই অঞ্চলে ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে শুরু করে।
বাংলাদেশ সরকার ফুলবাড়ী কয়লাখনি অনুসন্ধানের লাইসেন্স দিয়েছিল ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলীয় কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলসকে। ১৯৯৭ সালে এশিয়া এনার্জি গঠিত হয় এবং বিএইচপি ১৯৯৮ সালে রহস্যজনকভাবে নতুন কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে তার লাইসেন্স হস্তান্তর করে। ২০০৬-এ ফুলবাড়ীতে প্রতিরোধের পর এশিয়া এনার্জি নাম পরিবর্তন করে ‘গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট’ নামে আবির্ভূত হয়। এর প্রধান অংশীদার পোলো রিসোর্সেস ইউএসএ, আরএবি ক্যাপিটাল, ইউবিএস, ফিডেলিটি গ্রুপ, বারক্লেস, ক্রেডিট সুইস, এলআর গ্লোবাল, অসপ্রাই ম্যানেজমেন্ট, ক্যাপিটাল গ্রুপ এবং আরগোস গ্রেটার ইউরোপ ফান্ড। বাংলাদেশ সরকারকে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ রয়ালটি দিয়ে শতকরা ৮০ ভাগ কয়লা সুন্দরবন দিয়ে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা হয়। এই কোম্পানির পরিবেশ বিষয়ক সমীক্ষা ও পর্যালোচনা (ইআইএ) এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনাও ছিল ভুল, মিথ্যা ও জালিয়াতিপূর্ণ।30
প্রাথমিক বিশ্লেষণেই দেখা যায়, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আবাদি জমি, পানিসম্পদ ও জনবসতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং পুরো উত্তরবঙ্গই ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হবে, আবার চুক্তি অনুযায়ী কয়লাসম্পদও দেশের কাজে লাগবে না। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা-সবই বিপর্যস্ত হবে। খুবই যৌক্তিক কারণে এই প্রকল্প ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়-প্রথমত স্থানীয় জনসাধারণ দ্বারা, দ্বিতীয়ত ‘তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। উন্মুক্ত কয়লাখনি, বিদেশি কোম্পানি ও রপ্তানির বিরুদ্ধে এই শক্ত অবস্থানের মূল কারণ ছিল- ১) ১৫০টি গ্রামের প্রায় ২০০০০০ মানুষকে উচ্ছেদ করা হতো শুধুমাত্র একটি খনির কারণে। ২) খনি এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ফলে শুধুমাত্র বৃহৎ জলাধারগুলোই (অ্যাকুইফার) ক্ষতিগ্রস্ত হতো না, এতে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের অধিকাংশ জলাধার শুকিয়ে ওই এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হতো। ৩) খনি এলাকার বাইরের বিশাল অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যেতো। এই কৃষি প্রধান এলাকা দেশের খাদ্যশস্য সরবরাহে বড় ভূমিকা রাখায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি দেশের খাদ্য ও পরিবেশ নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়াতো। ৪) রপ্তানিমুখি চুক্তির কারণে কয়লা সম্পদ চলে যেতো বিদেশে, অপরদিকে বাংলাদেশ সেই কয়লার ন্যায্য দামও পেতো না।
এই ভয়াবহ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট জাতীয় কমিটি আহূত বিশাল গণজমায়েতের ওপর বিডিআর বাহিনী গুলি চালায়। তিনজন শহীদ হন এবং শত শত লোক আহত হন। সারা দেশে বিক্ষোভ বিস্তৃত হলে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার ৩০ আগস্ট ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সরকার ও বিক্ষুব্ধ জনগণের মধ্যে। চুক্তির মূল বিষয়গুলো ছিল : ১) ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিল করতে হবে এবং এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বিতাড়ন করতে হবে। ২) দেশের কোথাও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি অনুমোদন করা হবে না। ৩) খনন পদ্ধতি এবং কয়লা উন্নয়ন ও ব্যবহার সংক্রান্ত যে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মতামত নিতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, পানিসম্পদ ও জনবসতি বিবেচনায় বিদ্যমান প্রযুক্তি ও নীতিমালা মোটেই দেশের কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ নয়। আমরা তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একমত যে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যতোদিন উপযুক্ত নতুন প্রযুক্তি না আসবে ততোদিন এই কয়লা রেখে দেওয়া হবে।31 কেননা কৃষিজমি, পানি, ও স্থানীয় মানুষের সর্বনাশ করে, কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে বাংলাদেশের কয়লাসম্পদ তুলে দেয়া যায় না। তাছাড়া সকল তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে- বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার আর্থিক, কারিগরি, পরিবেশগত কোনো দিক থেকেই এখন আর অনুকূল নয়। যদি বিকল্প পথে কম ব্যয়ে, কম ঝুঁকিতে, ও কম দূষণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয় তবে সেপথ গ্রহণ করাই দায়িত্বশীল হবে। ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তিতে পরিবেশ সম্মতভাবে কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার হয়তো করা সম্ভব হবে। কিন্তু তারজন্য দেশেও গবেষণামূলক কাজে গুরুত্ব দিতে হবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে গত কয়েক বছরে সরকারের নানাবিধ জোরালো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। সরকারের তরফে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা, জীবাশ্ম জ্বালানির সংকট, নিম্ন বা শূন্য মাত্রার কার্বণ নিঃসরণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরা ইত্যাদিকে এই তৎপরতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পাবনার অদূরে রূপপুরে ১২০০ মেগাওয়াটের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট স্থাপনের কর্মতৎপরতা অব্যাহত আছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরাও ২০১৩ সাল থেকেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ তুলে ধরেছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের নিজস্ব উপযুক্ত-দক্ষ জনশক্তি না থাকা, নিজেদের গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান না থাকা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা না থাকা ইত্যাদিকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে দায়মুক্তি বিল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা, আর্থিক ক্ষতির কথা প্রকাশ করেও অনেকেই আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এমনকি মূল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের কথাও পত্রিকায় এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, রূপপুরে ৪৫৫ হাজার জিপিএম পানির প্রয়োজন হবে। আর গত ১২ বছরে পদ্মার পানির প্রবাহের গড় হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১৫৫ হাজার জিপিএম পানি নদী থেকে নেয়া যাবে। আবার ২০১১ সালে পানির প্রবাহ প্রায় ৭৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় পানির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। পানি সংকটের প্রশ্নে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে, রূপপুরে ক্লোজড ওয়াটার লুপ ব্যবহার করা হবে এবং পানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য কুলিং টাওয়ার ব্যবহার করা হবে। যদিও এ বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি, যেমন, কী ধরনের কুলিং টাওয়ার ব্যবহৃত হবে, কুলিং টাওয়ারের পানি শোধন কিভাবে হবে। যেহেতু কুলিং টাওয়ার নিজেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কুলিং টাওয়ারের ফিড ওয়াটারে কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকবে, এর নিয়ন্ত্রণ হবে কী করে, বাতাসের সাথে কুলিং টাওয়ারের পানির মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে কি না এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোকপাত করা হয়নি। আবার প্রতিবছরই তাপমাত্রার তারতম্য বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ সাধারণত ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ইউরোপ-আমেরিকার প্যারামিটারে হিসাব করে কুলিং টাওয়ার বিষয়ক আলোচনা যৌক্তিক নয়।
২০০৯ সালে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন থেকে চার বিলিয়ন ইউএস ডলার। পরে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এর মধ্যে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারই রাশিয়া ঋণ দেবে। এক হিসাবে বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, নির্মাণ খরচ, জ্বালানির খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যোগ করলে, অনেক গোপন খরচ হিসাবে না ধরেই, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৭.৫০ থেকে ৮ টাকা। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ঋণের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার, যা বর্তমান হারে বৃদ্ধি পেলে পাঁচ বছর পর প্রায় ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারে দাঁড়াবে। রাশিয়ার ঋণ যুক্ত হলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। ফলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বলার মোটেই উপায় নেই, সাথে আছে বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা।
তৃতীয় পক্ষের অনুপস্থিতি, দুর্ঘটনার আশঙ্কা, EIA না করা, প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ শুরুর আগেই বিভিন্ন অনিয়ম ছাড়াও চুক্তিতে দায়মুক্তি সম্পর্কিত বিধান যুক্ত থাকায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে। পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর এসেছে এভাবে : “…রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনার যে কোনো পর্যায়ে, যে কোনো কারণে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহকারী রাষ্ট্র রাশিয়া দুর্ঘটনার কোনো দায় নেবে না। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সই হয়েছে, তার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব নিরূপণের (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) বিষয়ে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে।…”32
এই বাস্তবতায় পারমাণবিক বিদ্যুতের দিকে যাবার ক্ষেত্রেও আমাদের নীতি পরিবর্তন করতে হবে। এর চেয়ে কম ব্যয়বহুল ও কম ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প পন্থা যেহেতু রয়েছে, এই বিপজ্জনক নীতি গ্রহণ অপ্রয়োজনীয়। তবে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য একটি ৫০ বা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকতে পারে যা প্রধানত গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার নজির থাকবে।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর সম্ভাবনা ও বিতর্ক
সরকারি মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপুল সম্ভাবনাকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি। ধারণা করবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে, বিশেষত কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ লবির প্রভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবই নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সেজন্য ২০৪১ সালেও বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৩৬৬৬ মেগাওয়াট, যা ওই সময়ে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষমাত্রার শতকরা মাত্র ৬.৫ ভাগ। (পিএসএমপি পৃ. ১-৬১) আমরা মনে করি বর্তমান প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, এবং আর্থিক-সামাজিক-পরিবেশগত সব বিষয় আমলে নিলে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমেই সরকারি প্রস্তাবের বহু গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
প্রযুক্তিগত বিবেচনা
প্রতিদিন বাংলাদেশের প্রতি বর্গমিটার এলাকায় ৩ হাজার থেকে ৫.৫ হাজার ওয়াট সৌর রশ্মি আসে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত সৌররশ্মি জার্মানীর তুলনায় বেশি। বর্তমানে যে মনোক্রিস্টালাইন ও পলিক্রিস্টালাইন সৌর প্যানেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার প্রযুক্তিগত দক্ষতা সর্বোচ্চ যথাক্রমে শতকরা ২২ ও ১৬ ভাগ। তারপরও তা বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট।
সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রচলিত অভিযোগ বা সমস্যা বিবেচনা করেই আমরা এই বিষয়ে আমাদের প্রস্তাবনা রাখবো। এর মধ্যে প্রধান দুটি বিতর্ক হলো (১) জমি বিতর্ক (২) ব্যাটারী সমস্যা।
জমি বিতর্ক/ স্থান বিতর্ক
বাংলাদেশ ঘনজনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশে জমির অভাব, মাথাপিছু জমির প্রাপ্যতা খুবই কম। কৃষি যেহেতু বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রধান অবলম্বন সেহেতু কৃষিজমি ক্ষতি করে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পই গ্রহণযোগ্য নয়। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে এই সমস্যার কথা সরকার পক্ষ থেকে বলা হলেও সরকারি নানা প্রকল্প নিয়মিতভাবে কৃষিজমি গ্রাস করছে। প্রকৃতপক্ষে সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কে এই প্রচলিত ধারণা এখন আর ঠিক নয়। যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সৌরবিদ্যুৎ কৃষি জমিকে নষ্ট করবে না বরং কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশাল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশের গবেষণা থেকে দেখা যায় সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২ একরের চাইতেও কম জমি প্রয়োজন। ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ট্রান্সপোর্ট এন্ড ডিজিটাল এন্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার (বার্লিন) এর সাম্প্রতিক (২০১৫) একটি গবেষণায় প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১.৭ একর জমির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ ৪ একর জমির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। ভারতের তামিলনাড়–তে আদানির ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য স্থান প্রয়োজন হচ্ছে ২৫০০ একর বা মেগাওয়াট প্রতি ৩.৮৬ একর।33
আমাদের সমীক্ষা থেকে আমরা নিশ্চিত যে, সরকারের হাতে, বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলে যে বিপুল পরিমাণ জমি আছে তা ব্যবহার করলে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ বাস্তবায়ন সম্ভব। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্রীভূত একটানা জমি অপরিহার্য নয়। বরং বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরের কেন্দ্রীভূত সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের চাইতে বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় গ্রাহক প্রান্তে (আলাদা ভাবে বিভিন্ন এলাকায়) অনেক কম জায়গায় কম বিনিয়োগে সৌর বিদ্যুতের প্রসার সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় বিপুল পরিমান সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যেখানে গ্রাহক তার চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে নির্ধারিত মূল্যে সরবরাহ করতে পারে। নগর এলাকার সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক ভবন, পরিত্যক্ত জমি ও জলাভূমি ইত্যাদি যুক্ত করা হলে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রয়োজনীয় শতকরা এক ভাগ জায়গা সহজেই জোগাড় করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে কৃষি জমির ব্যবহার কোনো প্রয়োজন হবে না।
ইনস্টিটিউট অফ এনার্জি ইকোনোমিক্স এন্ড ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস (আইইইএফএ) এর মতে শতকরা ২ ভাগ জায়গা ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২ লক্ষ ৪০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩৮০ টেরাওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।34 উল্লেখ্য ২০৪১ সাল বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের চাহিদা হবে ২৩৮ টেরাওয়াট-আওয়ার, এর মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ থেকে ১০৫ টেরাওয়াট-আওয়ার আনার প্রস্তাব করছি, তার পুরোটা জমিতে করলেও তে এরজন্য জমির প্রয়োজন হবে বাংলাদেশের মোট জমির শতকরা ০.৫৫ ভাগ। এছাড়াও বর্তমানে সোলার শেয়ারিং প্রযুক্তি বিকাশের ফলে কৃষিজমিতেও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ব্যাটারি বিতর্ক
বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে পুরোনো প্রযুক্তির ফ্লাডেড লেড এসিড ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব ব্যাটারি খুব দ্রুত (এক বছরের মাথায়) কার্যকারিতা হারায়। পাশাপাশি এতে সর্বোচ্চ ১৫০০ থেকে ২৪০০ ওয়াট.ঘন্টার বেশি শক্তি সঞ্চয় করা যায়না। এতে পরিবেশ দূষণও বেশি। দামও বেশি। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে লিথিয়াম আয়ন এবং মেটাল অক্সাইড প্রযুক্তির ব্যাটারির মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে। দূষণ ন্যুনতম, দামও কমছে।35
ব্যাটারিসহ এনার্জি স্টোরেজ পরিকল্পনা
বিকল্প বিদ্যুৎ ও জালানি মহাপরিকল্পনার সৌর বিদ্যুৎ বাস্তবায়নের পরিমান ও পিএসএমপি ২০১৬ এর প্রাক্কলিত ডিমান্ড কার্ভ (পৃ. ১১-৪৯) পর্যবেক্ষণ করে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত (সৌর শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নির্দিষ্ট সময়) বিদ্যুৎ চাহিদা ও তার সাথে সম্পর্কিত এনার্জি স্টোরেজের পরিমাণ দেখানো হল (আলোচনার সুবিধার্থে পিএসএমপি-২০১৬ তে দেখানো ২০২০ এর ডিমান্ড কার্ভকে ‘২০২১’, এবং ২০৩০ কে ‘২০৩১’ হিসেবে দেখানো হল)।
দেখা যাচ্ছে বিকল্প জ্বালানি ২০২১ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত সৌর বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় বাড়তি উৎপাদন নেই। সে ক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুতের জন্যে এনার্জি স্টোরেজের প্রয়োজন হবেনা। কিন্তু প্রস্তাবিত এনার্জি মিক্সে যেহেতু বায়ু বিদ্যুৎও যুক্ত আছে সেহেতু ইন্টারমিটেন্সি সহ অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষন এবং ফ্রিকোয়েন্সি ম্যানেজমেন্ট-এর জন্য ২০২১ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত খুব সামান্য পরিমাণে (৩০০-৫০০ মেগাওয়াট আওয়ার) ‘এনার্জি স্টোরেজ’-এর প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু ২০৩১-এর পর থেকে উৎপাদিত বাড়তি সৌর বিদ্যুৎ সঞ্চয়ের জন্য ব্যাটারি সহ এনার্জি স্টোরেজের অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে ২০৩১ সালের পরবর্তী সময়ে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উৎপাদিত সৌর বিদ্যুৎ চাহিদার চেয়ে বেশি থাকবে। ২০৪১ পর্যন্ত বাড়তি উৎপাদনের এই ধারা বজায় থাকবে।
বেইজলোড বিতর্ক
বিতর্ক আছে যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বেইজলোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অথবা বেইজলোড চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং ব্যাটারি প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই বিতর্ক অপ্রাসঙ্গিক।36 কেননা, প্রথমত: নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে যদি বিকেন্দ্রিক (decentralized) পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তবে বেইজলোড চাহিদা সামাল দেয়ার জন্যে এক স্থানে কেন্দ্রীভূত ভাবে বিশাল আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনই নেই। দ্বিতীয়ত: উন্নত প্রযুক্তির ব্যাটারির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় করে বেইজলোড চাহিদার যোগান দেয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের তিক্ত অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে সোলার হোম সিস্টেম সংখ্যায় অনেক ছড়ালেও কার্যকরিতার দিক থেকে খুব সাফল্য দেখাতে পারেনি। এর কারণ আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ মোটাদাগে ৪টি মডেলে বাস্তবায়িত হয়েছে: ১. সোলার হোম সিস্টেম ২. সোলার ইরিগেশন ৩. সোলার মিনিগ্রীড ৪. সোলার রুফটপ।
সোলার হোম সিস্টেম: প্রথমত, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সোলার হোম সিস্টেমের দাম এবং গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করার একটি গাইডলাইন থাকলেও ইডকলের তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানই নীতি মেনে পণ্য সরবরাহ করেনি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নিম্নমানের ব্যাটারি, লাইট, প্যানেল ইত্যাদি দিয়ে সোলার হোম সিস্টেম ডিজাইন করায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হোম সিস্টেমে সমস্যা দেখা যায়। দেখা গেছে গ্রাহক পর্যায় থেকে বহু অভিযোগ থাকা সত্বেও বিক্রয় পরবর্তী সেবা বা কাস্টমার সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্রে গাফিলতি করা হয়। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা বা দিকনির্দেশনা না থাকায় বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন মূল্যে পণ্য বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ওয়াট বিদ্যুতের দাম ৩৭৫ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। অথচ ভারতে এর দাম ৪১ টাকা, এবং পাকিস্তানে ৯০ টাকা।37
রুফটপ: সরকারি বাধ্যবাধকতার কারণে বেশ ক’বছর আগে নগর এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরে রুফটপ সোলার স্থাপন করা শুরু হয়, কিন্তু আমরাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে গ্রাহকেরা ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়। পণ্যের গুণগত নাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রণক সংস্থার কার্যকলাপ চোখে পড়েনা।
মিনিগ্রীড: মিনিগ্রীড প্রজেক্টগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে গ্রামীণ চাহিদা নগর জীবনের চাহিদার চেয়ে অনেক কম হওয়ায়, এবং গ্রামীণ বিদ্যুৎ ব্যবহারের ধরন আলাদা হওয়ায়, এই প্রকল্পগুলো এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়াও মিনিগ্রীড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকারীকে গ্রীড এবং যাবতীয় আনুষঙ্গিক অবকাঠামোগত নির্মান ব্যয়ভার নিজেকেই বহন করতে হয় বলে তার বিনিয়োগ খরচ শুরুতেই অত্যাধিক বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়ার জন্যে কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৩০ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি করে। গ্রাহক পর্যায়ে অতিরিক্ত দামের কারণে অনেকেই শেষপর্যন্ত মিনিগ্রীড সিস্টেম থেকে সরে আসে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের বিভিন্ন মিনিগ্রীড প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জমি ক্রয়, প্রস্তুতকরণ, গ্রিড নির্মান, গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যে ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন সহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা ইডিয়াটি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই দেয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিপুল ভর্তুকি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলেও সোলার রুফটপ, হোম সিস্টেম, বা মিনিগ্রীড প্রকল্পের ক্ষেত্রে যে নীতিগত সহায়তা অপরিহার্য ছিল, তা অনুপুস্থিত।
সোলার ইরিগেশন: সোলার ইরিগেশন সিস্টেম চালু হওয়ার পর গ্রিড ও ডিজেল পাম্পের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসায় বাংলাদেশের সেচ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। ইডকলের তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৬০৭টি সোলার ইরিগেশন প্রজেক্ট সফল ভাবে চলছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বার্থ হয়েছে বলে যে অভিযোগটি রয়েছে তার প্রধান কারণ: ১. নিম্নমানের পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাব। ২. বিক্রয়মূল্যের উপর নীতিমালার অভাব এবং ৩. মিনিগ্রীড স্থাপনে রাষ্ট্রীয় সহায়তার অনুপুস্থিতি। সর্বশেষ বাজেটে একদিকে কয়লা আমদানির ওপর শুল্ক তুলে নিলেও সৌরপ্যানেলের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বায়ু বিদ্যুত বিতর্ক ও সম্ভাবনা
বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করে। বিশেষ করে কুতুবদিয়ার এক মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটির উদাহরণ টেনেই এই অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ার পিছনে রয়েছে মূলত অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, নিরাপত্তা বেষ্টনির অভাবে বিভিন্ন দরকারী যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়া, উইন্ড ফার্ম পরিচালনায় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব, প্রয়োজনীয় রিভার্স ইলেক্ট্রিসিটি বিতরণে পিডিবির গাফিলতি, এবং সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণে রাষ্ট্রের গাফিলতি।
সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা সৌর বিদ্যুতের চেয়ে কম। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গতির বাতাস সব জায়গায় নেই। তারপরও বায়ু বিদ্যুতের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা আছে যা নিয়ে সরকারের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগই নেই।
বাতাসের গতি/কাটিং স্পিড বিতর্ক:
২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি সেকেন্ডে ৪ মিটার (কিছু ক্ষেত্রে ৭ মিটার) বাতাসের গতির প্রয়োজন হতো। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণা থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের গবেষণার ফলস্বরূপ, বর্তমানে প্রচলিত উইন্ড টারবাইন (বায়ু বিদ্যুৎ চক্র) গুলোর কাট-ইন স্পিড ২-৩.২ মিটার/সেকেন্ডে নেমে এসেছে।38 আমাদের দেশে একটি বিতর্ক চালু আছে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো পর্যাপ্ত বাতাসের গতি এখানে অনুপস্থিত। বলাই বাহুল্য, পুরনো প্রযুক্তির উদাহরণ টেনেই এই বিতর্কটি করা হচ্ছিলো। বর্তমান প্রযুক্তির উইন্ড টারবাইন ব্যবহার করা হলে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো বাতাস বাংলাদেশের বহু স্থানেই বিদ্যমান।
বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুর গতিবেগ বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০ মিটার উচ্চতায় গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ৬ থেকে ১১ মিটার।39 নীচের চার্টে ৫০ ও ৮৫ মিটার উচ্চতায় বাংলাদেশে বায়ুর গতিবেগ-এর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে।
Source: (for Wind Speed at 50 Meter) Farha, Nazia, Safa Nur-Us, Rahamatullah, B.D., Ali, Sekendar. Prospects of Wind Energy in the Coastal Region of Bangladesh at 50 Meter. International Journal of Scientific & Engineering Research, Volume 3, Issue 8, August-2012. (for Wind Speed at 85 Meter) Ongoing Research by National Energy and Power Research Council (EPRC), Bangladesh, 2016.
মনে রাখতে হবে যে, গত ১০ বছরে বায়ু বিদ্যুৎ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। তার ফলে এখন প্রতি সেকেন্ডে ২.৫ মিটার বায়ু গতিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। খরচও কমে এসেছে, সাধারণ বায়ু চলকে কিলোওয়াট প্রতি ৫ সেন্ট এবং সমুদ্রে ৮ সেন্ট যা প্রচলিত বিদ্যুৎ খরচ থেকেও অনেক কম।40
বাংলাদেশের উইন্ড পকেট:
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গতির বাতাস সব জায়গায় না থাকলেও, কিছু কিছু স্থানে প্রয়োজনীয় গতির বাতাস সারা বছরই থাকে। বিশেষজ্ঞরা এরকম কিছু পর্যাপ্ত বাতাসের এলাকা (এয়ার/উইন্ড পকেট) চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো: নাটোরের লালপুর, চাঁদপুরের জাফরাবাদ, কক্সবাজারের ইনানী বীচ, মগনামা ঘাট, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, পার্কি বীচ, রংপুরের বদরগঞ্জ, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, হবিগঞ্জের মধুপুর চা বাগান, খুলনার দাকোপ, হাতিয়া, সেইন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, ফেনি জেলার মুহুরি বাঁধ, বিভিন্ন চর এলাকা এবং দক্ষিণাঞ্চলের ৭০০ কিলোমিটার উপকূল রেখা।41
বস্তুত উল্লেখিত সবগুলো স্থানেই ৫০ মিটার উচ্চতায় গড়ে ৬ মিটার/সেকেন্ডে বাতাস প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য, বাতাসের এই গতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাট-ইন স্পিড ২ মিটার/সেকেন্ডের চেয়ে অনেক বেশী। উল্লেখ্য এইসব ‘উইন্ড পকেট’ গুলোতে সরকারের রিসোর্স ম্যাপিং এর কাজ চলছে, যা ২০১৭ নাগাদ শেষ হবে। তবে বাণিজ্যিক ভাবে বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হতে হলে বাতাসের গতিবেগ ৬ মিটার/সেকেন্ডের চেয়ে বেশী থাকা প্রয়োজন।
এসব বিবেচনায় আমাদের বিশ্লেষণে দেখেছি, বাংলাদেশের ৭০০ কিলোমিটার উপকূল রেখা বরাবর ২-৩ স্তরে নির্দিষ্ট দূরত্বে ৮০ মিটার উচ্চতায় ছোট বড় টারবাইনের সমন্বয়ে বায়ু/উইন্ড পার্ক স্থাপন করা হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫% ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টরে ন্যূনতম ৪৮০০ থেকে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুর গতিবেগ বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০ মিটার উচ্চতায় গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ৬ থেকে ১১ মিটার। নীচের চার্টে ৫০ও ৮৫ মিটার উচ্চতায় বাংলাদেশে বায়ুর গতিবেগ-এর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে যে, গত ১০ বছরে বায়ু বিদ্যুৎ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। তার ফলে এখন প্রতি সেকেন্ডে ২.৫ মিটার বায়ু গতিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। খরচও কমে এসেছে, ভারত সরকারের সর্বশেষ তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশী মুদ্রায় ইউনিট প্রতি ৪.৩ টাকা হারে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।42
বর্জ্য বিদ্যুৎ
বর্জ্য থেকে বায়ো-গ্যাস ও বিদ্যুৎ দুটোর উৎপাদনেরই উল্লেখযোগ্য সুযোগ আছে। ২০১৫ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, সেসময় প্রতিদিন ৪৭ হাজার টন পৌর বর্জ্য এবং ৬ কোটি টন ডেয়রি/পোল্ট্রি বর্জ্য তৈরি হচ্ছিলো, যা থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিলো।43 তাছাড়া এখান থেকে জৈবসার হতে পারে, রাসাযনিক সার তৈরির জন্য এখন ৫৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হয়, যা তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে।
বিভিন্ন জ্বালানির তুলনামূলক খরচ
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য সন্নিবেশ করে দেখা যাচ্ছে যে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পুঁজি বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ, ও একক চলতি খরচ দুক্ষেত্রেই গত ১০ বছরে দাম কমেছে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা যায় প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম ২০১০ থেকে ৫ বছরে কমেছে ৫৮%। ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই দাম আরও ৫৯% কমবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।44 সরকারি পিএসএমপিতেও স্বীকার করা হয়েছে যে ২০৪০ পর্যন্ত সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট কমবে (৫০%), বায়ুবিদ্যুৎ কমবে (৩০%) এবং ব্যাটারীর দাম কমবে ৪৫%। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম বাড়বে ৪৫%।45 তারপরও যার দাম কমবে সেই পথে না গিয়ে যার দাম বাড়বে সরকার সেই পথেই যাচ্ছে।
এই গবেষণাতে আরও দেখা যাচ্ছে যে, এশিয়াতে ২০১৪-১৫তে সৌরবিদ্যুতের দাম ৮ টাকা46, বায়ুবিদ্যুৎ ৪ টাকা।47
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে-র সমীক্ষায় বলা হয়েছে বর্তমান প্রাপ্ত প্রযুক্তিতে শতভাগ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ১,২০,০০০ মেগাওয়াট48, ইন্সসিটিউট অব এনার্জি এন্ড ফাইনান্সিয়াল এনালাইসি এর গবেষণা অনুযাযী শতভাগ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ২,৪০,০০০ মেগাওয়াট। আমেরিকান জার্ণাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ অনুযায়ী বায়ু বিদ্যুৎ পাওযা যাবে ২০ হাজার মেগাওয়াট।49
নীচের গ্রাফে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দরপত্রে নিম্নতম দাম অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের একটি তুলনামূলক চিত্র হাজির করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য জাতীয় কমিটির রূপরেখা
সকল দিক বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, যথাযথ নীতি মালা গ্রহণ করলে, বিদেশি কোম্পানি ও কনসালট্যান্ট নির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে, কোনো ধ্বংসাত্মক পথে না গিয়ে শিল্প, কৃষি, ও পরিবহণসহ ঘরে ঘরে পরিবেশ সম্মত ভাবে এবং সুলভে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ সম্ভব। সেই লক্ষ্যে আমরা স্বল্প মেয়াদ, মধ্য মেয়াদ এবং দীর্ঘ মেয়াদকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের মহাপরিকল্পনা বিন্যাস করেছি।
আমরা মনে করি, ঘন জনবসতি, কৃষি ও পানি সম্পদের ওপর এই দেশের মানুষের সামগ্রিক নির্ভরতার কারণে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কয়লা ও পরমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি বাংলাদেশে বেশি। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন দিনে দিনে আরও ব্যয়বহুল হচ্ছে, ফলে শুধু আর্থিক দিক বিবেচনাতেও কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ আর গ্রহণযোগ্য থাকছে না।
প্রাকৃতিক গ্যাস জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে সবচাইতে কম দূষণ সৃষ্টি করে, তাই পরিবেশসম্মতভাবে এর উত্তোলন বাংলাদেশকে বেশ কয়েক দশক ধরে সুলভ ও নিরাপদ বিদ্যুতের যোগান দিতে পারে। তবে তা যথেষ্ট হবে না। গত এক দশকে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বায়ু, মাটি, ও পানি দূষণ না করে, কোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি না রেখে, মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি না করে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এছাড়াও এই প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের কারণে এর খরচও প্রচলিত জ্বালানির চাইতে কমে যাচ্ছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পরস্পরের স্বার্থে সম্মানজনক ভাবে সকল দেশের জনগণের স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ আছে। বিশেষ করে নেপাল ও ভূটানের সাথে বাংলাদেশের এবিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক হতে পারে। ভারতের নবায়নযোগ্য জ¦ালানির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণকেও আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব।
স্বল্পমেয়াদে (২০২১ পর্যন্ত) আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিদ্যমান কাঠামোতে অল্প পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। তবে এই সময়ে আমাদের মূল প্রস্তাবনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনসহ জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়ন। এই সময়ের মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত পরিকল্পনার আমূল পরিবর্তন করে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে বিপুল গবেষণা ও নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। স্থলভাগ ও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে অগ্রসর হতে সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ এই সময়ের প্রধান করণীয়। ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের প্রস্তাবিত কাঠামোতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে গ্যাস থেকে শতকরা ৫৯ ভাগ, তেল থেকে শতকরা ১৯ ভাগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে শতকরা ১০ ভাগ (৫% সৌর, ৩% বায়ু এবং ২% বর্জ্য) এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে আসবে শতকরা ৭ ভাগ বিদ্যুৎ ।
মধ্যমেয়াদে (২০৩১ পর্যন্ত) পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস পাওয়ার হার হ্রাস পেলেও যথাযথভাবে অনুসন্ধান করলে গভীর ও অগভীর সমুদ্র থেকে নতুন পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। কোনো কারণে তার ঘাটতি দেখা দিলে গ্যাস আমদানিও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। এছাড়া ততদিনে নবায়নযোগ্য উৎসগুলো ব্যবহারের সক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে।
স্বল্পমেয়াদে নির্মিত নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর সহজেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের মাত্রা স্পষ্ট করা সম্ভব হবে মধ্যমেয়াদে। এই সময়কালেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ শীর্ষস্থানে থাকবে, শতকরা ৪৯ ভাগ। দ্বিতীয় স্থানে থাকবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শতকরা ৩৯ ভাগ (২৭% সৌর, ৭% বায়ু, ৫% বর্জ্য), তেল শতকরা ৭ ভাগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা শতকরা ৫ ভাগ।
দীর্ঘমেয়াদে গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শীর্ষস্থানে পৌঁছাবে। সেজন্য ২০৪১ নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা ৫৫ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনা সম্ভব হবে (এর মধ্যে সৌর: ৪২%, বায়ু: ৮%, বর্জ্য: ৫%)। দ্বিতীয় স্থানে থাকবে প্রাকৃতিক গ্যাস, শতকরা ৩৭ ভাগ। তেল ও আঞ্চলিক সহযোগিতা শতকরা ৮ ভাগ।
প্রযুক্তির বিকাশের যে গতি আমরা দেখছি তাতে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ব্যবহারের সুযোগ যে আরও সুলভ, সহজ এবং সম্প্রসারিত হবে তা নিশ্চিত বলা যায়। সেজন্য এই গতিতে অগ্রসর হলে কয়েক দশকের মধ্যেই সারা বাংলাদেশে শতভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনা সম্ভব হবে। তাতে সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত, বিদ্যুতায়িত, সুস্থ, নিরাপদ, বিকশিত দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।
সরকার ও জাতীয় কমিটির তুলনামূলক অবস্থান
সরকার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে তার অধিকাংশই বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির জন্য পরিবেশগত দিক থেকে ভয়াবহ, এবং অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। অবিশ্বাস্য একগুয়েমী নিয়ে সরকার সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কাজ করছে। ভারত ও চীন নিজ নিজ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে দ্রুত সরে আসার নীতিগত, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাদের পরিত্যক্ত প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে তৈরি করা হচ্ছে আত্মঘাতী সব প্রকল্প। সম্প্রতি সরকার আবারও রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের পথে যাচ্ছে এবং এরজন্য পুঁজি যোগান দিতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে।50 সবরকম তথ্য উপাত্ত এবং বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এসব পথ অপরিহার্য নয়। অথনৈতিক, সামাজিক, পরিবশেগত বিচারে এর চাইতে অনেক উৎকৃষ্ট পথ আছে। আমরা সেই রূপরেখাই এখানে হাজির করেছি।
বিনিয়োগ/ দাম: তুলনামূলক চিত্র
সরকারি মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হযেছে।52 উল্লেখ্য, এতে প্রাথমিক জ্বালানি খরচ অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। সর্বশেষ বাজেটে সরকার রূপপুর সহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছেন ৩১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। জাতীয় কমিটির বিনিয়োগ প্রস্তাবনায় ব্যাটারি খরচ সহ আগামী ২৫ বছরে প্রয়োজন হচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ বিলিয়ন ডলার। (এসম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের মূল রিপোর্টে আছে।)
গ্রাহক পর্যায়ে দামের তুলনামূলক চিত্র
দেশে ২০০৬-৭ সালে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিলো গড়ে ইউনিটপ্রতি ২.২৬ টাকা।53 গত ১০ বছরে কয়েক দফা দামবৃদ্ধির পর সর্বশেষ হিসাবে এই দাম দাঁড়িয়েছে ইউনিটপ্রতি ৬.৭৩ টাকা।54 পিএসএমপি ২০১৬ অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতিবছর বাড়াতে হবে। সার্বিক ভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিএসএমপিতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত ২.৬ হারে প্রকৃত দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। ২০৩১ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের প্রকৃত দাম ১.৫ হারে বৃদ্ধির প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারি পরিকল্পনায় চলতি দামে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়বে শতকরা ৭০০ ভাগ।
জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম হবে এর প্রায় অর্ধেক। ২০১৫ সালের দামস্তর অনুযায়ী, ২০৪১ সালে সরকারি পরিকল্পনায় বিদ্যুতের দাম জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় বিদ্যুতের দামের তুলনায় প্রায় ২গুণেরও বেশি। প্রস্তাবিত রূপরেখায় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে পিএসএমপিতে ব্যবহৃত পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়েছে। সৌর ও বায়ু ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবেল এনার্জি এজেন্সি’ প্রদত্ত প্রাক্কলিত আন্তর্জাতিক দামকে অনুসরণ করা হয়েছে। তেল ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফার্নেস তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ ও ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুতের গড় মূল্য ধরে. পিএসএমপিতে ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।
নিরাপদ বৈষম্যহীন সমৃদ্ধির পথযাত্রা শুরু করতে হবে
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র বিষকরণ, ভয়ংকর নদী ও পানিদূষণ, বনধ্বংস এবং ভয়াবহ মাত্রায় প্রাণবৈচিত্র বিনাশ যে মাত্রায় পরিবেশ দূষণ ঘটিয়েছে তাতে এই গ্রহের অস্তিত্বই বিপন্ন। এর কারণ বিচার বিবেচনাহীনভাবে মুনাফা উন্মাদনা। পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পেছনে জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ নিয়ে মুনাফামুখি তৎপরতাই প্রধান। এরফলে কৃষি, পরিবহণ, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবই নানামাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই উন্নয়নের পুরনো ধারণাই এখন বিশ^ব্যাপী প্রবল প্রতিরোধের মুখে।
সরকার যখন পশ্চাৎমুখি, লুন্ঠন ও ধ্বংসমুখি, নিপীড়ন ও বৈষম্যমুলক এরকম উন্নয়ন চিন্তার অধীনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তখন গত প্রায় দুদশকের জনআন্দোলনের শক্তি ও আকাঙ্খার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ভবিষ্যৎমুখি, প্রগতি ও সমতামুখি প্রবৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক, প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষপন্থী উন্নয়ন চিন্তার কাঠামোতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করছি। বিপুল জনসমর্থিত চিন্তা ও আন্দোলনের ধারায় জনপন্থী মহাপরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপন বাংলাদেশে নতুন চিন্তা ও জন আন্দোলনের শক্তিরই প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আমরা এই খসড়া উপস্থিত করছি দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে দেশে অগ্রসর উন্নয়ন চিন্তা ও বিদ্যুৎ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করবার দিকনির্দেশনা চূড়ান্ত করতে।
আমরা জানি, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা আমরা প্রকাশ করেছি ভবিষ্যতে প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে এর চাইতেও উন্নততর এবং সুলভ কাঠামোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। এর সব লক্ষণই বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এরজন্য প্রয়োজন হবে সবরকমের আধিপত্য থেকে মুক্ত মানুষ, ও প্রকৃতি বান্ধব উন্নয়ন দর্শন। এসবের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন এবং জনগণের মালিকানা ও কর্তৃত্বের বিকাশ সম্ভব।
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা, খনিজসম্পদ রপ্তানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং জাতীয় সক্ষমতার বিকাশসহ জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই এই নতুন যাত্রা শুরু সম্ভব।
(সংক্ষেপিত)
জাতীয় কমিটি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা প্যানেল:
আনু মুহাম্মদ (সমন্বয়কারী), অধ্যাপক বিডি রহমতুল্লাহ, প্রকৌশলী মাহবুব সুমন, প্রকৌশলী মওদুদ রহমান, প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, প্রকৌশলী দেবাশীষ সরকার, গবেষক মাহা মির্জা, অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা এবং ডক্টর তানজিম উদ্দীন খান।
বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা
প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: আহবায়ক, তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
ডক্টর আবদুল হাসিব চৌধুরী: অধ্যাপক, ত্বড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
ডক্টর সাজেদ কামাল: নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষক ও লেখক। শিক্ষক ব্রন্ডেইস ইউনিভার্সিটি, বোস্টন, যুক্তরাষ্ট্র।
সৌম্য দত্ত: জ্বালানি গবেষক ও লেখক। সমন্বয়কারী, ভারত জনবিজ্ঞান মঞ্চ, দিল্লী।
ডক্টর নজরুল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘ। সমন্বয়কারী, বেন।
ডক্টর মো. খালেকুজ্জামান: ভূতত্ত্ব অধ্যাপক, লকহ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
Tim Buckley, Simon Nicholas: Institute of Energy Economic and Financial Analysis.
Kenji Shiraishi, Rebekah Shirley, Daniel Kammen: Renewable and Appropriate Energy Laboratory (RAEL),University of California, Berkeley, USA.
পরামর্শ ও সংলাপ
যাদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে এবং/অথবা যাদের গবেষণাকাজ ব্যবহার করা হয়েছে- ডক্টর দীপেন ভট্টাচার্য্য, সুজিৎ চৌধুরী।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান: বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, ইনস্টিটিউট অব এনার্জি-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), পাঠশালা, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ ও সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি। Center for Financial accountability, Bank Track, International Coal Network, Waterkeeper Alliance, Center for Food Safety এবং প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, বণিক বার্তা, ডেইলি স্টার, নিউএইজ, সাপ্তাহিক-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকবৃন্দ।
পরিশিষ্ট-১
জাতীয় কমিটির ৭ দফা
এক. গ্যাস, তেল ও কয়লাসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ খনিজ সম্পদ দেশের স্বার্থে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সদ্ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ ও জনস্বার্থ নিশ্চিত করার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানী সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আরও বিভাগ এবং জাতীয় ভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। এ কাজে প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে।
দুই. অবিলম্বে দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত দায়মুক্তি আইন বাতিল করতে হবে। ‘খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ’ করবার আইন পাশ করতে হবে। দায়মুক্তি আইন ব্যবহার করে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিল করে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতকে দেশি বিদেশি ব্যবসার হাতে জিম্মি করবার বিদ্যমান নীতি, চুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে।
তিন. রামপাল ও ওরিয়ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সুন্দরবনবিনাশী সকল প্রকল্প বাতিল করতে হবে। সুন্দরবনের ক্ষয়রোধ ও তার পুনরুৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘সুন্দরবন নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশ^ব্যাংক ও ইউএসএইডের বনধ্বংসী প্রকল্প থেকে সুন্দরবনকে মুক্ত করতে হবে।
চার. বিশাল ঋণ ও ভয়াবহ ঝুঁকিনির্ভর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-র পরিবর্তে সেইস্থানে অনেক কম ব্যয়সাপেক্ষ ঝুঁকিমুক্ত বৃহৎ গ্যাস, বর্জ্য ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। বাঁশখালী হত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে। এসআলম ও চীনাগ্রুপের জালিয়াতি, ভুমিগ্রাস এবং জোরজুলুম বন্ধ করে জনসম্মতির ভিত্তিতে সেই জমিতে গ্যাস, বর্জ্য, সৌর বিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুতের বৃহৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
পাঁচ. বেআইনীভাবে বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে বিদেশে শেয়ার ব্যবসার অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায় করে, এশিয়া এনার্জিকে (জিসিএম) দেশ থেকে বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ সহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের আবাদী জমি, পানিসম্পদ, জনবসতি ও পরিবেশ প্রাধান্য দিয়ে খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিতে হবে।
ছয়. শতভাগ গ্যাসসম্পদ দেশের কাজে লাগানোর জন্য দুর্নীতিনির্ভর ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। পরিবর্তে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন তেল গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ দিতে হবে। প্রয়োজনে সাবকন্ট্রাক্ট ও বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে সমতল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমুদ্রসীমার সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন শতভাগ জাতীয় মালিকানায় করতে হবে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন করবার কাজ শুরু করতে হবে। মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলায় দুটো গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংসের জন্য দায়ী শেভ্রন ও নাইকোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা আদায় করে তা টেকসই জ¦ালানী নিরাপত্তার কাজে ব্যয় করতে হবে।
সাত. জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বন্দর নিয়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে যে সব জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং দায়ী দুর্নীতিবাজ জাতীয় স্বার্থবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিশিষ্ট-২
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক খবর
বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, শেল এর মত তেল-গ্যাস ভিত্তিক বৃহতাকার কর্পোরেশনগুলোও ভবিষ্যতে বিশালাকার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে ঊড ম্যাকেঞ্জি রিসার্চ গ্রুপ। কমতে থাকা দামের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর অপ্রতিরোধ্য বিস্তার এই কোম্পানীগুলোর চলতি ব্যবসায় মারাতœক হুমকি বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র সোলার এবং বায়ু বিদ্যুতেই এই কোম্পানীগুলো ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তথ্যসূত্রঃ ১২ জুন, ২০১৭, theguardian.54
চীনে কেবলমাত্র ২০১৬ সালেই ৩৪ হাজার মেগাওয়াটের সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে। এখন চীনের মোট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৭ হাজার মেগাওয়াট যা দেশ হিসেবে বিশ্বে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের মধ্যেই তাঁরা আরও নতুন ১ লক্ষ ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে। সেই সাথে চীন সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাত হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে ২০২০ সালের মধ্যেই ৩৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে বর্তমানে ১১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকা চীন ২০৩০ সালের মধ্যেই এই খাত হতে মোট প্রয়োজনের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথ্যসূত্রঃ ২ জুন, ২০১৭, inhabitat55
ব্রিটিশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যেই সকল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে, বায়ু দূষণ রোধ করণ নীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের পর কোম্পানীগুলোর পক্ষে কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র আর চালানো লাভজনক হবে না। এরই মাঝে ২১’শে এপ্রিল, ২০১৭ তারিখে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের পর প্রথমবারের মত পুরো একটি দিন কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনবিহীন অবস্থায় কাটানোর রেকর্ড অর্জিত হয়। তথ্যসূত্রঃ ২২ এপ্রিল, ২০১৭,theguardian56
চীন সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার সবচেয়ে বৃহৎ ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। এই কেন্দ্রটি চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশের একটি কয়লা খনি শহরের পানির ওপর নির্মিত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তার বরাতে জানা যায় যে, এ প্রকল্পটি শুধু এ অঞ্চলের জমির পূর্ণব্যবহারই নিশ্চিত করছে না বরং এটি বন্যার ফলে জমির যে সংকট তৈরি হয়েছিল তাও হ্রাস করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তথ্যসূত্রঃ ৫জুন, ২০১৭, বাংলাদেশ প্রতিদিন57
চীনে ৬০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত কিনহাই প্রদেশে জুন মাসের ১৭ হতে ২৩ তারিখ পর্যন্ত শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানী নির্ভর বিদ্যুৎ সরবহারের যে পরীক্ষা চালানো হয় তা সাফল্যের সাথে শেষ হয়েছে। এ সময়ে ১.১ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুতের পুরোটাই আসে সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুৎ হতে। হিসেবে দেখা যায় যে, এই পরিমাণ বিদ্যুতের যোগান দিতে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হত। তথ্যসূত্রঃ ২৭ জুন, ২০১৭, independent58
ভারতের চতুর্থ ব্যস্ততম কোচিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোটাই চলছে সৌর বিদ্যুতে। ৪৫ একর জমির উপর স্থাপিত ১২ মেগাওয়াটের গ্রীড কানেক্টেড সোলার প্যানেল থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পুরো চাহিদা মেটানোর পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাড়তি বিদ্যুৎ আবার বিক্রিও করছে। ৬২ কোটি রূপী ব্যায়ে স্থাপিত এই উৎপাদন কেন্দ্রের খরচ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে ৬ বছরের মধ্যেই উঠে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তথ্যসূত্রঃ ১৪ মার্চ, ২০১৬, CNNMoney59
ভারতে ৫০ মেগাওয়াট এবং ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার দুটি সৌরভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ইউনিট প্রতি উৎপাদন বাংলাদেশী মুদ্রায় মাত্র ৩ টাকা ৩০ পয়সা হবে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যা এযাবতকালে ভারতে সর্বনিম্ন। ভারত ইতোমধ্যেই ২০২২ সালের ভেতর ১ লক্ষ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌর ভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ভারতের জ্বালানী মন্ত্রী পিয়ূস গয়াল নবায়নযোগ্য জ্বালানীর কমতে থাকা দামের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “সামনের দিনগুলোতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সৌর বিদ্যুতের চেয়ে খরুচে হবে” তথ্যসূত্রঃ ১০ মে, ২০১৭,reneweconomy60 ১৮ এপ্রিল, ২০১৬, climatechangenews62
অন্যান্য তথ্যসূত্র
Cook, Paul. Design of a Household Human Waste Bioreactor. Stanford University. 2010
(BPDB) Bangladesh Power Development Board. BPDB Annual Report 2014-2015.
Indo-German Development Cooperation. The German solar rooftop experience: Applicability in the Indian context Indo-German Development Cooperation. June 7, 2016. http://mnre.gov.in/…/workshop-gcrt-0870616/german.pdf
Kamal, Sajed. The Renewable Revolution: How We Can Fight Climate Change, Prevent Energy Wars, Revitalize the Economy and Transition to a Sustainable Future. Routledge. 2011.
Mirza, Maha. “State-business nexus in Bangladesh. The Case of Asia Energy Corporation and Quick Rental Power Plants.” Ongoing Doctoral Research. (2013-2017).
Rahman, Mowdud. “Energy Planning for Bangladesh: Challenges and Opportunities (Masters Thesis). Department of Energy Science and Engineering. Indian Institute of Technology, Bombay.
(SREDA) Sustainable and Renewable Energy Development Authority. “Energy Efficiency and Conservation Master Plan Up To 2030.” Power Division. Ministry of Power, Energy and Mineral Resources Government of Bangladesh. March 2015.
(SREDA) Sustainable and Renewable Energy Development Authority.Wind Resource Mapping. Power Division. Ministry of Power, Energy and Mineral Resources Government of Bangladesh.http://www.sreda.gov.bd/index.php/site/page/2f45-680b-877b-3ec8-7bdc-f44a-721d-ac4b-1ff8-856c
1.Bangladesh Power Development Board. Accessed on July 21, 2017. ↩
2.Bangladesh Power Development Board. Accessed on July 21, 2017. ↩
3.(BPDB) Bangladesh Power Development Board. “Annual Report 2015-2016.” Government of Bangladesh. 2016. ↩
4.Sultana,Moshahida.“Power and Energy: Potentials, Crisis and Planning.” Routledge Handbook of Contemporary Bangladesh.Edited by Ali Riaz. Mohammad SajjadurRahman. Routledge. 2016. ↩
5.Muhammad, Anu. “Natural Resources and Energy Security: Challenging the ‘Resource-Curse’ Model in Bangladesh.” Economic & Political Weekly.Vol XLIX, No 4. January 25, 2014.
The diplomat. Asia and the Fall of Coal. June 22, 2017. ↩
6.Government of Bangladesh (GOB). Power Sector Master Plan 2016 (PSMP). Prepared by JICA. Final Report, September 2016. ↩
7.GOB. PSMP 2016. P. 1-16-17.↩
8.GOB. PSMP 2016. P. 21-17 ↩
9.Government of India. Power Sector. January 2017. Central Electricity Authority. Ministry of Power. December 2016 ↩
10.Government of India. Draft National Electricity Plan. Central electricity Authority. Ministry of Power. December 2016. ↩
11.The Guardian. India to ratify Paris climate change agreement at UN. October 2, 2016.https://www.theguardian.com/environment/2016/oct/02/india-paris-climate-change-agreement-un-narendra-modi ↩
12.ভারতের বিজ্ঞানী সৌম্য দত্তের সাক্ষাৎকার। সর্বজনকথা, নভেম্বর ২০১৬. ↩
13.Government of India. Draft National Electricity Plan. Central electricity Authority. Ministry of Power. December 2016. ↩
14.Energy Desk, Greenpeace. China suspends 104 planned coal power plants. January 16, 2017.
http://energydesk.greenpeace.org/2017/01/16/china-coal-power-overcapacity-crackdown/
Independent. China scraps construction of 85 planned coal power plants. January 17, 2017. http://www.independent.co.uk/news/world/asia/china-scraps-construction-85-coal-power-plants-renewable-energy-national-energy-administration-paris-a7530571.html ↩
15.China Daily. Beijing’s last large coal-fired power plant suspends operations. March 19, 2017. http://www.chinadaily.com.cn/china/2017-03/19/content_28603569.htm ↩
16.Mongabay. China pledges $275 billion over 5 years to cut record air pollution. August 19, 2013. https://news.mongabay.com/2013/08/china-pledges-275-billion-over-5-years-to-cut-record-air-pollution/ ↩
17.Grist. China plans to create 13 million clean energy jobs by 2020. January 5, 2017. http://grist.org/briefly/china-plans-to-create-13-million-clean-energy-jobs-by-2020/ ↩
18.Denmark.DK. A WORLD-LEADER IN WIND ENERGY. November 2015. http://denmark.dk/en/green-living/wind-energy/ ↩
19.Bloomberg. Germany Just Got Almost All of Its Power From Renewable Energy. https://www.bloomberg.com/news/articles/2016-05-16/germany-just-got-almost-all-of-its-power-from-renewable-energy ↩
20.EnergyTransition. Renewable energy production stagnates in Germany in 2016. January 16, 2017. https://energytransition.org/2017/01/renewable-energy-production-stagnates-in germany-in-2016/ ↩
21.The Guardian. Dutch electric trains become 100% powered by wind energy. January 10, 2017. https://www.theguardian.com/world/2017/jan/10/dutch-trains-100-percent-wind-powered-ns ↩
22.IFLscience. France To Shut Down All Its Coal Power Plants By 2023 . http://www.iflscience.com/environment/france-shut-down-coal-power-plants-2023/ ↩
23.The Wall Street Journal. Peabody Energy Files for Chapter 11 Bankruptcy Protection. April 14, 2016. https://www.wsj.com/articles/peabody-energy-files-for-chapter-11-protection-from-creditors-1460533760 ↩
24.বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন মোস্তফা, কল্লোল: “বাপেক্স যেভাবে জাতীয় মালিকানায় সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের দায়িত্ব নিতে পারে।” সর্বজনকথা, ৩ বর্ষ সংখ্যা ১, নভেম্বর ২০১৬। ↩
25.PetroBangla. Petrobangla Annual Report 2015. Government of Bangladesh. p. 62. ↩
26.Filipov, Allan; Dilindi, Robert; Drage, Magne. Electro-Magnetic Sensitivity in the Bengal Basin: Implications for Exploration in Mynmar, Bangladesh and NE India. International Petroleum Technology conference. 10-12 December. Malaysia. ↩
27. PetroBangla. Final Updated Report on Bangladesh Petroleum potential and resource Assessment 2010. Hydrocarbon Unit and Energy and Mineral Resource Division. Government of Bangladesh. June 2011. USGS-Bangladesh Gas Assessment Team. U.S. Geological Survey–PetroBangla Cooperative Assessment of Undiscovered Natural Gas Resources of Bangladesh. U.S. Geological Survey Bulletin. August 19, 2001. ↩
28. Imam, Badrul.”Energy Resources of Bangladesh”.The University Grants Commission of Bangladesh. January 2013. p. 142.এবং লেখকের সাথে দলগত আলোচনা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ↩
29.For detail analysis of the present situation see, David G. Victor, David R. Hults and Mark C. Thurber (Edited): Oil and Governance: State-Owned Enterprises and the World Energy Supply, Cambridge University Press, 2014.↩
30.Kalafut & Moody (2010). Jen Kalafut & Roger Moody: “Phulbari Coal: A Parlous Project.” A critique of the GCM Resources PLC. Environment and Social Impact. Assessment (ESIA) and Summary Environmental Impact Assessment (SEIA) for the Phulbari Coal Mine Project in Bangladesh. Prepared by Nostromo Research for Bank Information Center (BIC), 2008.
↩
31.http://bdnews24.com/bangladesh/2014/02/06/wait-for-new-technology-pm ↩
32.এবিষয়ে গত কয়বছরে নবীন প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন লেখায়। দেখুন সরকার, দেবাশীষ: পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাংলাদেশ। সর্বজনকথা, বর্ষ ৩ সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ঢাকা। এছাড়া একই বিষয় নিয়ে আরও লিখেছেন A. Rahman, Retired nuclear scientist and a fellow of the British Nuclear Institute. M V Ramana (Princeton University and the author of The Power of Promise: Exmining Nuclear Energy in India). Zia Mian (Princeton University, co-edits Science & Global Security, the international technical journal of arms control, nonproliferation and disarmament). ↩
33.The Hindu. Adani’s 648-MW solar plant inaugurated. September 22, 2016. Retrieved from http://www.thehindu.com/news/national/tamil-nadu/Adani%E2%80%99s-648-MW-solar-plant-inaugurated/article14993341.ece) ↩
34.(IEEFA) Institute of Energy Economics and Financial Analysis. “Bangladesh Electricity Transition: A Diverse, Secured, Deflationary Way Forward.” November, 2016. P 22. ↩
35.Greentechmedia. Stem CTO: Lithium-Ion Battery Prices Fell 70% in the Last 18 Months. June 28, 2016.https://www.greentechmedia.com/articles/read/stem-cto-weve-seen-battery-prices-fall-70-in-the-last-18-months. TESLA, Utility and Business Energy Storage. June 2017.available at https://www.tesla.com/powerpack ↩
36.According to Tim Buckley, from the Institute of Energy Economics and Financial Analysis, the idea of “base load” generation as an essential part of the energy mix is becoming redundant, and turning into a myth dreamed up by the fossil fuel industry to protect its interests. According to Sven Teske, an Analyst with the Institute for Sustainable Futures in Sydney, “Base load is not a technical concept, it is an economic concept and a business concept of the coal industry that is no longer feasible.” See Parkinson, Giles. “Base Load” Power: A myth used to defend the fossil fuel industry. Available at http://reneweconomy.com.au/base-load-power-a-myth-used-to-defend-the-fossil-fuel-industry-96007/↩
37.বণিক বার্তা, ১৫ মার্চ ২০১৭ ↩
38.(For Cutting Speed 2) I. Bayati, M. Belloli , L. Bernini , R. Mikkelsen , A. Zasso. “On the aero-elastic design of the DTU 10MW wind turbine blade for the LIFES50+ wind tunnel scale model”, Politecnico di Milano, Department of Mechanical Engineering, University of Milan; Fluid Mechanics, Department of Wind Energy, Technical University of Denmark. 2016. Retrieved from (http://iopscience.iop.org/1742-6596/753/2/022028) (For Cutting Speed 3) Cian Desmond, Jimmy Murphy, Lindert Blonk and Wouter Haans. “Description of an 8 MW reference wind turbine” MaREI (Marine and Renewable Energy IRELAND); University College Cork, Ireland, and DNV-GL, Turbine Engineering, Netherlands. ↩
39.Amercian Jounral of Engineering Research. Wind Energy Potential In Bangladesh. Vol 5, Issue 7. 2016. pp. 85-94. ↩
40.International Renewable Energy Agency (Irena): The Power To Change:Solar And Wind Cost Reduction Potential To 2025, June 2016 ↩
41.(SREDA) Sustainable and Renewable Energy Development Authority Bangladesh. Wind Resource Mapping. Power Division. GOV. August 2016. Retreived from http://www.sreda.gov.bd/index.php/site/page/2f45-680b-877b-3ec8-7bdc-f44a-721d-ac4b-1ff8-856c ↩
42.http://www.mnre.gov.in/, accessed on 21 July, 2017. ↩
43.Waste Concern. Municipal Solid Waste and Recovery Potential: Bangladesh Perspective. 2015. ↩
44.(IRENA) International Renewable Energy Agency. Rethinking Energy 2017: Accelerating the global energy transformation. 2017. p. 10. ↩
45.GOB. “The Study for Master Plan on Coal Power Development in the People Republic of Bangladesh.” PSMP 2016. Prepared by JICA. 2016. P. 7-26 11-33. ↩
46.(IRENA) International Renewable Energy Agency. Rethinking Energy 2017: Accelerating the global energy transformation. 2017. p 36 ↩
47.ibid, p. 59. ↩
48.(IEEFA) Institute of Energy Economics and Financial Analysis. Bangladesh Electricity Transition: A Diverse, Secured, Deflationary Way Forward. November, 2016. P 22. ↩
49.Amercian Jounral of Engineering Research. Wind Energy Potential In Bangladesh. Vol 5, Issue 7. 2016. pp. 85-94. RISOE National Laboratory, Denmark. “Wind Assessment over Bangladesh”. RISOE. 2007. Netherland Enterprize Agency. Wind Energy Potential Bangladesh: Baseline Study. April 13, 2017. ↩
50.বণিক বার্তা, ১ জুলাই, ২০১৭ ↩
51.Bangladesh Power Development Board. Accessed on July 21, 2017. ↩
52.(BPDB) Bangladesh Power Development Board. “BPDB Annual Report 2007-2008.” Government of Bangladesh. 2009. p. 6. ↩
53.প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল ২০১৭↩
54.https://www.theguardian.com/environment/2017/jun/12/oil-giants-need-to-invest-heavily-in-renewables-by-2035-analysis-finds ↩
55.http://inhabitat.com/china-is-now-the-largest-producer-of-solar-power-in-the-world/ ↩
56.https://www.theguardian.com/environment/2017/apr/21/britain-set-for-first-coal-free-day-since-the-industrial-revolution ↩
57.http://www.bd-pratidin.com/features/2017/06/05/237734 ↩
58.http://www.independent.co.uk/news/world/asia/china-qinghai-province-renewable-energy-test-grid-sustainable-power-clean-technology-a7810496.html ↩
59.http://money.cnn.com/2016/03/14/technology/india-cochin-solar-powered-airport/index.html ↩
60.http://reneweconomy.com.au/india-sets-new-solar-tariff-low-now-beating-domestic-coal-generation-89213/ ↩
61. http://www.climatechangenews.com/2016/04/18/solar-is-now-cheaper-than-coal-says-india-energy-minister/ ↩