জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটালো ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এ ঘোষণা কেবল ফিলিস্তিনে নয়, সারা পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও উগ্রতাকে উসকে দিয়েছে।
জেরুজালেম মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি- এই তিন ধর্মাবলম্বীর কাছে পবিত্র শহর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনে বার বার হানা দিয়েছে, জেরুজালেম শহরটিও বার বার তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকে বিভিন্ন আরব জাতিগোষ্ঠীর বাসস্থান হিসেবে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের ইহুদিদের মধ্য থেকে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার চিন্তা করা হয়। ধনী ইহুদিরা ফিলিস্তিনে জায়গা-জমি কিনে নিয়ে বসবাস চালাতে থাকে। ফিলিস্তিনের গরীবরা তাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। এইভাবে ফিলিস্তিনের বিরাট এলাকা নিজেদের অধিকারে নেওয়ার পর এই ধনী ইহুদিরা আরবদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে শুরু করে। স্বভাবতই আরব অধিবাসীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসকদের আওতায় আসে। কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের সাথে ইহুদিবাদীদের বিরোধ বাধে। ইহুদিবাদীদের পক্ষ নিয়ে বিষয়টিতে নাক গলাতে শুরু করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৌশলী চালে আরব জনগোষ্ঠীগুলো আপত্তি উপেক্ষা করে রাষ্ট্রসংঘ ফিলিস্তিনকে দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধাস্ত গ্রহণ করে। এর একটি অংশ ফিলিস্তিন নামে আরবদের অধিকারে থাকে, আরেকটি অংশে তৈরি হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। (তথ্যসূত্র : গণদাবী, ডিসেম্বর, ২০১৭)
বিগত ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েল দফায় দফায় হামলা চালায় ফিলিস্তিনিদের উপর। ১৯১৩ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-র সঙ্গে ইসরায়েলের একটি চুক্তি হয়। সেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ততদিন পর্যন্ত জেরুজালেমকে ‘আন্তর্জাতিক শহর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাজধানী করতে চায়। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইসরায়েল জেরুজালেমের পূর্বাংশ দখল করে নেয় এবং ’৮০ সালে শহরটাকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। যদিও বিশ্বের কোনো দেশই ইসরায়েলের এই অন্যায় দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি।
এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিল। গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষ ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়েছে। ইরান, সিরিয়া, লেবাননের মতো আরবদেশগুলি তো বটেই এমনকি দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হানাদারির সঙ্গী ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলোও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়নি। এরই জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাতিলে নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দ্বারস্থ হয় ফিলিস্তিন। সাধারণ পরিষদে অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র এতে সমর্থন জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আগামী অর্থবছরে জাতিসংঘে অর্থায়ন কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজ প্রয়োজনেই ইসরায়েলকে মদত দিয়ে চলেছে এবং ফিলিস্তিনীদের দমনে সহযোগিতা করছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর দখল প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে আমেরিকা। ২০০৬ সাল থেকেই ইসরায়েল গাজা ভূ-খন্ড দখল করে রেখেছে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে এই অঞ্চলে সংঘর্ষের উত্তাপ বাড়িয়ে তুলতে পারলে আমেরিকার লাভ দুদিক থেকে। প্রথমত, সামরিকীকরণের গতি বাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা হু হু করে বাড়ানো যাবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য, ইসরায়েলকে সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে যেতে পারবে আমেরিকা।
শুধু জেরুজালেম প্রশ্নে নয়, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানা ধরনের বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ট্রাম্পের পরিবেশ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ট্রাম্পের পরিবেশ নীতি অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের কর্মকান্ডের যে বিরাট প্রভাব রয়েছে তা অস্বীকার করা হয়। ফলে বিশ্ব পরিবেশ সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখা সংস্থা ‘দ্য এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি’ (ইপিএ) ছেড়ে চলে গেছে দুই শতাধিক বিজ্ঞানী।
ফিলিস্তিন ইসরায়েল সংঘাতকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখার প্রবণতা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবেই আছে। আমেরিকা যখন ইরাক বা আফগানিস্তানে হামলা চালায় তখন অনেকে একে মুসলিমদের ওপর খ্রিস্টানদের হামলা হিসেবে দেখায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই সঠিক নয়। বোঝা দরকার, যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের বাঁচার উপায় নেই। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নির বিরোধ উস্কে দিয়ে তা থেকে অস্ত্রের ব্যবসা করছে আমেরিকা। সৌদিআরব আমেরিকার অস্ত্রের সবচেয়ে বড় খদ্দের। সম্প্রতি কাতারের সাথে বিরাট অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেছে আমেরিকা। সৌদিআরব এই অস্ত্র ব্যবহার করছে ইয়েমেনে। সেখানে খ্রিস্টান-মুসলমান নেই। মুসলমানরাই মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে তা থেকে ফায়দা লুটে নিজের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো।
পৃথিবীব্যাপী দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিকে শক্তিশালী হতে হবে। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার অন্যায় সমর্থন ও ফিলিস্তিনীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।