Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ মার্চ ২০১৭ট্রাম্প যুগের রাজনীতি

ট্রাম্প যুগের রাজনীতি

trump-anti-immigrant

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন পদক্ষেপ তার দেশে তো বটেই, সারা দুনিয়াতে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশেষতঃ ৭টি (পরে ৬টি) মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা এবং সকল অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের ঘোষণা প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছে। ট্রাম্প তাঁর অভিষেক বক্তৃতায় “উগ্র ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সভ্য দুনিয়াকে ঐক্যবদ্ধ” করার কথা বলেছেন। ট্রাম্পের এইসব বক্তব্য ও পদক্ষেপের ফলে মুসলিম বিদ্বেষ আরো বাড়বে, যার প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত মৌলবাদী গোষ্ঠী শক্তিশালী হবে। দুনিয়া জুড়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত-হানাহানি-যুদ্ধের বিস্তার ঘটিয়ে একদিকে অস্ত্রবাণিজ্যের বাজার নিশ্চিত করা, অন্যদিকে জনগণকে বিভক্ত করাই কি ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য? আশার কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ বিরাট সংখ্যায় বিক্ষোভে নেমে মুসলিম ও অভিবাসী বিরোধী পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ব্রিটেনসহ ইউরোপজুড়ে লক্ষ লক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষসহ বামপন্থীরা সংখ্যালঘু ও অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে রাস্তায় নেমেছেন। ফলে ট্রাম্প অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভের সামনে পড়েছেন শুরু থেকেই। বাস্তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই, নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই ট্রাম্পের জাতিদম্ভ-বর্ণবাদী-নারীবিদ্বেষী বক্তব্য ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিক্ষোভ চলছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির জোরে। বিশ্ববাসী অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে দলেরই হোক, তাদের নীতি মোটামুটি একই থাকে। দেশে দেশে হস্তক্ষেপ-আধিপত্য বিস্তার, পছন্দমত শাসক পরিবর্তন, আগ্রাসন-যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার সাম্রাজ্যবাদী নীতি সব মার্কিন সরকারের আমলেই চলেছে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও কাজ করে সে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি-অতিকায় ধনকুবের গোষ্ঠী, বহুজাতিক কর্পোরেশন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের স্বার্থে। একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীর ভাষায়, আমেরিকা চালায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল-মিলিটারী-ব্যুরোক্রেটিক কমপ্লেক্স। ইরাকসহ মধ্যপ্রচ্য আগ্রাসনে লাভবান হয় তেল কোম্পানীগুলো। দেশে দেশে যুদ্ধ দরকার অস্ত্র কোম্পানী ও পেন্টাগণের স্বার্থে। এইসব ধনকুবের গোষ্ঠীর হাতেই প্রচারমাধ্যম ও বিনোদন শিল্পের মালিকানা, সাধারণত তারাই জনমত নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, আজ ডোনাল ট্রাম্প মার্কিন নীতিতে না হলেও কর্মকৌশলে যে সব পরিবর্তন নিয়ে আসছেন তা মার্কিন শাসকশ্রেণীর গড় স্বার্থেই। এসব পদক্ষেপ-এর তাৎপর্য ভালভাবে বুঝা দরকার, কারণ আগামীতে সারা দুনিয়ায় এর প্রভাব পড়তে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বাজার সংকট থেকে বাঁচতে মার্কিন অর্থনীতির বড় অংশের সামরিকীকরণ করা হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক সমরাস্ত্র ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি কেনার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা ও তেজীভাব সৃষ্টি করা হয়। এই রাষ্ট্রীয় সামরিক বিনিয়োগ ও অস্ত্রসম্ভার বৃদ্ধিকে গ্রহণযোগ্য করতে চাই যুদ্ধ বা যুদ্ধাতংক, চাই স্থায়ী শত্রু। একসময় ঠান্ডাযুদ্ধের নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা কমিউনিজমকে বিপদ হিসেবে দেখানো হত। বর্তমানে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী, চীন বা রাশিয়ার সাথে বিরোধকে জুজু হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ট্রাম্প এতোদিন ধরে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক অনুসৃত রাশিয়া বিরোধী নীতি পরিবর্তন করে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চান। আইএসবিরোধী জোটের নামে মধ্যপাচ্যে সামরিক অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরোধীতা মোকাবেলা করা বা চীনের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে ব্যবহার করার কৌশল হিসেবে হয়তো তার এ পদক্ষেপ। কিন্তু ট্রাম্পের এই উদ্যোগ পেন্টাগন গোয়েন্দা বিভাগ, পররাষ্ট্র দপ্তর, প্রচারমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ থেকে বিরোধিতার সম্মুখিন হচ্ছে। এরা রাশিয়ার কাছে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার অভিযোগ তুলছেন ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাথে আঁতাতের অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন ট্রাম্পের উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পদক্ষেপে স্পষ্ট যে, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন বৈরিতার পথই বেছে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেসে যে বাজেট প্রস্তাব পাঠাবেন, তাতে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়বে ১০ শতাংশ, কমপক্ষে ৫৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ এখনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ৫৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তী সাতটি দেশ চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স ও জাপানের সম্মিলিত ব্যয় ৫৬৭ বিলিয়নের চেয়ে বেশি। ফলে, কূটনীতির চেয়ে শক্তি প্রদর্শনই এই প্রশাসনের নীতি বলে আমরা ধরে নিতে পারি।

CF0B9B01-F068-4F5C-9416-F56BC6180670_cx0_cy1_cw0_w1023_r1_s

সংক্ষিপ্ত অভিষেক বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর নীতি হচ্ছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তিনি মার্কিন জনগণের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও মানের অবনতি, অপরাধ-অপরাধী চক্র ও মাদকের প্রসারের উল্লেখ করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যে সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সংকটগ্রস্ত চেহারা ফুটে উঠেছে। সংকটজনিত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি বিপুল বৈষম্য, ধনিকগোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি মানুষকে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। ১% বনাম ৯৯% শ্লোগান নিয়ে ২০০৮ সালের ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলনের কথা নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। বৈষম্য ও অর্থনৈতিক দুর্দশার বিরুদ্ধে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভকে সুকৌশলে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ট্রাম্প অভিবাসী বিরোধী শ্লোগান নিয়ে এসেছেন। ‘অভিবাসীরাই সব সংকটের জন্য দায়ী, তারা মার্কিনীদের সম্পদ ও চাকরির বাজারে ভাগ বসাচ্ছে’ — এমন প্রচারণা চলছে। অথচ অভিবাসীরাই আমেরিকা গড়ে তুলেছে, মার্কিন দেশের সমৃদ্ধিতে তাদের অবদান বিরাট। অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হিসেবে ট্রাম্প সীমান্ত সুরক্ষা অর্থাৎ দেশের বাজার সুরক্ষা, মার্কিন পণ্য কেনা-মার্কিন কর্মচারী নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়া, মার্কিন কোম্পানীগুলোকে দেশে কারখানা খোলার কথা বলেছেন। তিনি ট্রান্সপ্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তি (টিপিপি) ও দক্ষিণ আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (নাফটা) বাতিলের পক্ষে। অভিবাসী নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।

দেশের মধ্যে সংকট সামাল দিতে এবং চীনসহ অন্যান্য দেশের সস্তাশ্রমের সাথে টিকতে না পেরে মার্কিন শাসকরা এখন সংরক্ষণের শ্লোগান তুলছেন। ট্রাম্প তাঁর অভিষেক বক্তৃতায় একপর্যায়ে এমনও বলেন, ‘protection will lead to great prosperity and strength’। সারাবিশ্বের বাজার, কাঁচামাল, শ্রমশক্তি শান্তিপূর্ণ পথে দখলের জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা এক সময় বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, বাজার উদারিকরণের প্রবক্তা ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় মার খাওয়ার আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এরা আজ বাজার সংরক্ষণের পথে হাটছে। আর এর জন্য জাতীয়তাবাদী ধুয়ো তোলা হচ্ছে জোরেশোরে। বলির পাঠা বানানো হচ্ছে দরিদ্র অভিবাসীদের। এই ভাবেই শ্রমজীবি জনসাধারণের ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও বিনষ্ট করা হচ্ছে। এইজন্যই আমেরিকা ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে ডানপন্থী, জাত্যাভিমানী রাজনীতির শক্তি বাড়ছে। এদের অনেককে বলা হয় নব্য ফ্যাসিস্ট, কারণ হিটলারের নাৎসী পার্টির মতই এরা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে বিশ্বাসী। যেমন ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন ছিলেন মার্কিন শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী, বর্ণবাদীদের মুখপত্র ওয়েবসাইট ব্রেইটবার্ট নিউজের সম্পাদক।

পুঁজিবাদের মূল সংকট হল বাজার সংকট। সমাজে সবার শ্রমে উৎপাদিত সম্পদ যখন অল্প কিছু মালিকগোষ্ঠীর হাতে জমা হয় তখন উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে তাল রেখে বাজার প্রসারিত হতে পারে না। কারণ অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত থাকে। এই বাজারে আবার অনেক প্রতিযোগী। ফলে, উৎপাদনযন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা ও মুনাফার উদ্দেশ্যে উৎপাদনের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট সংকটকে ঢাকতে একেকবার একেক বিষয়কে সামনে আনা হয়। সংকট আপাতত কাটানোর জন্য তাৎক্ষণিক যে পদক্ষেপ নেয়া হয় পরবর্তীতে তা-ই আবার নতুন সংকট জন্ম দেয়। এইভাবেই ক্রমাগত অস্থিরতা ও নৈরাজের মধ্যেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চলছে। যেমন — ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী পদক্ষেপ-এর বিরোধিতা করছে গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকসহ বড় বড় প্রযুক্তি শিল্পের মালিকরা। কারণ, অভিবাসীদের মেধা ও শ্রমের ওপর তারা নির্ভরশীল। এই ঘটনা মার্কিন বুর্জোয়াশ্রেণীর অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রতিফলন।

ট্রাম্পের বক্তব্য ও ভূমিকায় পরিস্কার — তিনি পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী, মুসলিমবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিচ্ছেন। তাঁর কর্তৃত্ববাদী মনোভাব, জাতিদম্ভ, নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য, বাগাড়ম্বর ও অহমিকাপূর্ণ আচরণ গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মার্কিন নাগরিকদের প্রতিনিয়ত আহত করছে। প্রচারমাধ্যম ও বিচারবিভাগকে আক্রমণ এবং আইনবিভাগকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহীবিভাগের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রী ভূত করার প্রবণতা ট্রাম্প প্রশাসনের কাজ-কর্মে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়া শাসন আজ কতটা নগ্ন, প্রতিক্রিয়াশীল, গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী হয়ে উঠছে — ট্রাম্প, মোদি বা আমাদের দেশসহ নানা দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকরা তার নিদর্শন।

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments