বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল(মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, “প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা গণতন্ত্র, বাক্ স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী।”
বিবৃতিতে তিনি বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর কথা বলে যে আইন তৈরি হতে যাচ্ছে তা বাস্তবে নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করবে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল ২০১৮-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। আইনের ৩২ ধারার বহুল সমালোচিত ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দবন্ধে ভাষাগত পরিবর্তনের কথা বলা হলেও বিষয়বস্তু প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এতে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর কথা উল্লেখ করলেও ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেসি এক্টকে যুক্ত করা হয়েছে, অথচ দুইটি সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুণœ করা, মানহানির মতো সাইবার অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে সাজার বিধান রাখা হয়েছে। ‘রাষ্ট্রের সুনাম’ ‘ভাবমূর্তি’, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ – এসব শব্দ আইনে ব্যবহৃত হলে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। এসব ধারণার কি অভিন্ন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণের উপায় আছে? এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল ও নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবে অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা আগের তুলনায় কিছুটা কমানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও নতুন আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম এ আইন তৈরি করতে যাচ্ছে।”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী আরো বলেন, “আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমত ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি অনুরোধ করতে পারবে। ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মনে হয় যে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য দেশের বা দেশে কোন অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুন্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে তাহলে বাহিনী ওই তথ্য-উপাত্ত ব্লক বা অপসারণ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচার চালানো বা এতে মদদ প্রদান করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরুপ কার্য হবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে নিরুৎসাহিত করবে।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশকৃত বিলের ২৫ ধারায় (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।”এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ৩ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য ৫ বছরের কারাদ- ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বিধানে শাস্তি ৫ বছর করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। বাংলাদেশ দ-বিধির ২৯৫-২৯৮ ধারাগুলোর মধ্যেই ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি কী হবে তা নির্ধারণ করা আছে। অথচ এই আইন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল আইনে নতুন করে বিষয়টি সংযোজন করে নতুনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর ফলে যখন যাকে খুশি শায়েস্তা করার জন্য এই আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।
বিলের ২৯ ধারায় কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে তিন বছরের কারাদন্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। মানহানির জন্য প্রচলিত আইন আছে। সুতরাং, ডিজিটাল মানহানির জন্য ডিজিটাল আইন কতটুকু প্রয়োজন? এই আইন পাশের ফলে একই অপরাধে দুই রকম শাস্তির ব্যবস্থাও তৈরি হচ্ছে।
এ আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এমন তথ্য প্রচারের শাস্তি হিসেবে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
বিলের ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি এ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৩২ (২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।”
এ ধারা আইনটিতে থাকলে আমলা বা ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ছাড়া অন্য যে কারো পক্ষে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার দফতরে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন বা পেনড্রাইভের মতো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার বিপদজ্জনক হয়ে পড়বে। এমন কি ওই সব দফতরের ই-মেইল বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কাউকে কোনো তথ্য বা নথির কপি পাঠানোও অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। এটা দুর্নীতিবাজ আমলা ও সরকারি দলের লোকজনদের সুরক্ষা দেবে। দুর্নীতি-দুষ্কৃতির কোনো তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ সংবাদকর্মীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে নথি-তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতে হলে হলমার্ক, ইউনিপে টু, ডেসটিনির লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ কেলেংকারির কথা দেশের মানুষ হয়তো কখনোই জানতে পারতো না। সরকারি দলের বহু নেতা-এমপির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যহার, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার ইত্যাদির যে কথা-কাহিনী মানুষ জানতে পেরেছে, তাও হয়তো তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হতো না। একজন মন্ত্রী তো রাখ ঢাক না করেই বলেছেন, ‘আপনারা গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। এ আইনের বলে এখন হয়তো এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।’
বিলের ৪৩ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে পুলিশ অফিসারকে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী শেষে বলেন, “এই সব অগণতান্ত্রিক বিধান মিলে এই আইনটি বাস্তবে একটি কালাকানুন বা নিবর্তনমূলক আইন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কুখ্যাত ৫৭ ধারার মত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উপরোল্লিখিত ধারাগুলো এই স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নমত ও বিরোধী দমনের হাতিয়ার হিসেবে আগামীতে ব্যবহার করবে। সেজন্যই প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে সাংবাদিকসহ সকল মহলের মতামত সরকার অগ্রাহ্য করেছে। এই কালো আইনের বিরুদ্ধে চিন্তার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাই।”