নদীর পানিতে ভারতের আগ্রাসন ও শাসকদের নতজানু নীতি রুখে দাঁড়ান
তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে দেশপ্রেমিক বাম-গণতান্ত্রিক জনগণের অংশগ্রহণে গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান নিয়ে শেষ হল ঢাকা-তিস্তা ব্যারেজ রোডমার্চ। এ লক্ষ্যে আগামী ১৬ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং আগামী মে মাসে জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয় তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার দোয়ানীবাজারে অনুষ্ঠিত রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে। দোয়ানী বাজারের সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হল গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার তিন দিনের ঢাকা-তিস্তা ব্যারেজ রোডমার্চ।
সম্প্রতি তিস্তার পানির প্রবাহ স্মরণকালের সর্বনিম্ন সীমায় নেমে আসে। পানির অভাবে তিস্তা সেচপ্রকল্পের অধীন হাজার হাজার কৃষক ও তাদের জমি বিপন্ন হয়ে পড়ে। তিস্তার পানির দাবিতে কৃষকরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর উদ্যোগে রংপুর থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত রোডমার্চ ঐ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
গত ৮ এপ্রিল সকালে ঢাকা থেকে যাত্রা করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী হয়ে লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন দোয়ানী বাজারে এসে রোডমার্চ শেষ হয়। পথে পথে অসংখ্য পথসভা, প্রচারপত্র বিলি, গণসংযোগের পাশাপাশি বগুড়ার সাতমাথায় ও রংপুরের পায়রাচত্বরে দুটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রোডমার্চের শেষ দিন ১০ এপ্রিল সকালে রংপুর থেকে যাত্রা করে রংপুরের সিও বাজার, হাজিরহাট, পাগলাপীর, গঞ্জিপুর, চন্দনেরহাট, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার আবিলের বাজার, বড়ভিটা, বিন্নাকুড়ি, বড়ঘাট ও জলঢাকা উপজেলা শহরে পথসভা করে বিকাল পৌনে ৫টায় তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন দোয়ানী বাজারে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে সমাপনী সমাবেশে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ ও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে রোডমার্চ সমাপ্ত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, সমাবেশের ঘোষণা পাঠ ও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাম মোর্চার সমন্বয়ক কমরেড অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার।
প্রথম দিন : রোডমার্চ শুরু হয় গত ৮ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে। ৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা-ভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা সমবেত হতে শুরু করেন। সকাল ১০টায় রোডমার্চের উদ্বোধনী সমাবেশ শুরু হয়। বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী কমরেড অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ, পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। এছাড়া উদ্বোধনী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক, বাসদ (মাহবুব)এর শ্যামল কান্তি দে, বাসদের ফখরুদ্দিন কবির আতিক প্রমুখ।
উদ্বোধনীর পর রোডমার্চের মিছিল প্রেসক্লাব থেকে হাইকোর্ট মোড় ঘুরে মৎসভবন মোড়ে গিয়ে গাড়িবহরসহ গাজীপুর অভিমুখে যাত্রা করে। বেলা দেড়টায় গাজীপুর চৌরাস্তায় বাসদ নেতা কমরেড জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় একটি পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। রোডমার্চ বহর বেলা তিনটার দিকে টাঙ্গাইল শহরে পৌঁছে এখন সেখানে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে। এরপর রোডমার্চ পুনরায় পথে নামে বগুড়ার উদ্দেশ্যে। পথে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল মোড়ে একটি পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।
বগুড়া : গাজীপুর ও টাঙ্গাইল হয়ে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটার কিছু পরে রোডমার্চ বগুড়া পৌঁছায়। তিস্তা রোডমার্চকে স্বাগত জানাতে বগুড়ার সাতমাথায় এক সমাবেশের আয়োজন করে জেলা গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। সাতমাথায় সমাবেশের মাধ্যমে রোডমার্চের প্রথম দিনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়। সাতমাথার সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জোটের সমন্বয়ক বাসদ নেতা সামছুল আলম দুলু, বক্তব্য রাখেন বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে বগুড়ার বিভিন্ন স্কুলে রাত্রিযাপন করে মোর্চার নেতা-কর্মীরা। পরদিন সকালে সাতমাথায় এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে রোডমার্চ রংপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
গাইবান্ধা : বগুড়া থেকে রওয়ানা দিয়ে তিস্তা রোডমার্চ ৯ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পৌঁছায়। এখানে পৌর শহরে থানা মোড়ে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা বাম মোর্চার সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম রফিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখে আব্দুস সাত্তার, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, সাইফুল হক, মোশরেফা মিশু, জেনায়াদে সাকী, মোশারফ হোসেন নান্নু, হামিদুল হক, এড. শ্যামল কান্তি দে প্রমুখ। সমাবেশের আগে রোডমার্চ কাফেলা গোবিন্দগঞ্জ পৌর শহরের প্রধান সড়কে একটি র্যালি করে। পরে রোডমার্চ রংপুরের পথে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা সদরের চৌমাথায় সমাবেশ করে।
রংপুর : তিস্তা ব্যারেজ অভিমুখে রোডমার্চের যাত্রাপথে ৯ এপ্রিল বুধবার বিকেল ৫টায় রংপুর পায়রাচত্বরের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি রংপুর জেলা শাখার সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমবেশে বক্তৃতা করেন বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুস সাত্তার, বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্ল¬বী পার্টির সাধারণ মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক, বাসদ (মাহমুদ)-এর ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ইয়াসিন আলী, গণসংহতি আন্দোলন রংপুর জেলার সমন্বয়ক তৌহিদুর রহমান, বাসদ রংপুর জেলা কমিটির সদস্য পলাশ কান্তি নাগ প্রমুখ। রোডমার্চ এর আগে সকালে বগুড়া থেকে যাত্রা করে গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী ও শঠিবাড়ীতে সমাবেশ করে রংপুরে এসে পৌঁছে।
নীলফামারী : ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় নীলফামারীর জলঢাকা ট্রাফিক মোড়ে এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বাম মোর্চার সমন্বয়ক অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারের সভাপতিত্বে এ পথসভায় বক্তব্য রাখেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, মোশরেফা মিশু, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকী, হামিদুল হক, ইয়াছিন মিয়া প্রমুখ।
রোডমার্চের সমর্থনে সারাদেশের বাসদের সংহতি
সিলেট : বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি সিলেট জেলার উদ্যোগে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে ‘ঢাকা-তিস্তা রোডমার্চের সাথে সংহতি জানিয়ে ১০ এপ্রিল ’১৪ বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে সিটি পয়েন্টে সমাবেশে মিলিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি সিলেট জেলার সদস্য এড. হুমায়ুন রশীদ শোয়েব এবং পরিচালনা করেন সুশান্ত সিনহা সুমন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি সিলেট জেলা শাখার সদস্য রনেন সরকার রনি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সিলেট নগর শাখার সভাপতি রেজাউর রহমান রানা প্রমুখ। সমাবেশে বক্তারা বলেন, মেঘনার উৎস-নদী সুরমা-কুশিয়ার উপর টিপাইবাঁধ দিয়ে মেঘনা নদীকে, তথা সমগ্র বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার যে পরিকল্পনা ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী করছে তার বিরুদ্ধে সিলেটের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল মানুষ আন্দোলনে নেমেছে। ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষও এ আন্দোলনে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বক্তারা বলেন, ভারত শুধু তিস্তার পানির উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে না, ফারাক্কা দিয়ে পদ্মাকে শুকিয়ে মারছে, টিপাইবাঁধ দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীকে শুকিয়ে মারার এবং আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদকে শুকিয়ে মারার পরিকল্পনা করছে। এ অবস্থায় এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব হল ভারতের আগ্রাসন থেকে অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা। পাশাপাশি ভারতের বিবেকবান গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন প্রগতিশীল শক্তির সাথে আমাদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দু’দেশের জনগণের মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
চট্টগ্রাম : বাসদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার উদ্যোগে ঢাকা-তিস্তা রোড মার্চের সাথে সংহতি জানিয়ে আজ ১০ এপ্রিল বিকাল ৪টায় নিউমার্কেট থেকে স্টেশনরোড পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ও রেলস্টেশন মোড়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা বাসদের সদস্য সচিব কমরেড অপু দাশগুপ্ত, সফিউদ্দিন কবির আবিদ ও রফিকুল হাসান।