আরেকটি ভয়াবহ নারী নিগ্রহের ঘটনা দেশের সকল বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে আঘাত করে গেল। দেশের মানুষ এ জঘন্য ঘটনায় বসে থাকেনি। তনু হত্যার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। তনুর মৃত্যুর প্রতিবাদে কুমিল্লায় প্রায় প্রতিদিন মানুষ রাস্তায় নেমেছে, কুমিল্লা শহরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে ঢাকাসহ দেশের সবগুলো জেলায়, প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে, তনুর লাশ পাওয়া গেলো এমন একটা জায়গায় যেখানে সবসময় কড়া নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়। অপরিচিত, অননুমোদিত কোন লোকের চলাচল সেখানে নেই। অথচ এতদিন পরেও কোন অপরাধী ধরা পড়লোনা- এ ব্যাপারটা দেশের মানুষের কাছে কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা।
কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি তা ভেবে দেখুন। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে, জানুয়ারি ২০০১ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একই সংবাদে প্রকাশ, দেশের ৮৭ শতাংশ নারীই কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কতবড় আশঙ্কার পরিসংখ্যান! প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এই অপমান-নির্যাতন কেন ঘটেই যাচ্ছে তার বিষয়ে নানা দিক থেকে চিন্তা করার সময় কি এখনও আসেনি? এতো ঠিক যে, নারীর উপর প্রতিদিন ঘটে চলা এই নির্মমতা দেখে সবাই কষ্ট পাচ্ছেন। দেশের শিক্ষিত মানুষেরা, আমাদের মা-বোনেরা, শিক্ষকরা, পেশাজীবীরা প্রত্যেকেই কষ্ট পাচ্ছেন, নিজেদের ঘরে যে মেয়ে আছে তার কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন। আজ এই সংকটকালে এসব কেন হচ্ছে তার কথা ভাবা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমাদের কি কর্তব্য নয়?
সমাজে এখন নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের চূড়ান্ত সংকট চলছে। নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপন সর্বত্রই যে নারীদেহের রমরমা প্রদর্শনী চলছে- তা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা কার্টুনে পর্যন্ত সূক্ষèভাবে এসকল নোংরা জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিশোর বয়স থেকেই তাদের পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত করা হচ্ছে। কম্পিউটারে-ইন্টারনেটে পর্নোর ছড়াছড়ি। পর্নো সিডি গ্রামে-শহরে প্রায় খোলামেলা বিক্রি হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে এসব কা- হয়ে গেলেও আমরা কি তার প্রতিবাদ করছি? এক এক করে এসব ভয়াবহ অপরাধগুলো মেনে নিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জীবন ধারণের আট-দশটা স¦াভাবিক বিষয়ের মতো একে গ্রহণ করে নিয়েছি। এটা কি একজন নৈতিক মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত হয়? অন্যায় মেনে নিয়ে কি ধর্মরক্ষা হয়? নীতি রক্ষা হয়?
ভিডিও গেমসের মাধ্যমে পূর্বেই ছেলেমেয়েদের সমাজবিমুখ হয়ে শুধুমাত্র নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অভ্যস্ত করা হয়েছিল। সেই কম্পিউটারে এখন এসেছে ‘র্যাপ গেম’। কিশোর বয়সের ছেলেরা এসব গেম নিজেদের মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করছে আর বিকৃত আনন্দ উপভোগ করছে। এই সন্তানদের হাতে দেশের মা-বোনেদের চূড়ান্ত মর্যাদাহানি না হয়ে উপায় আছে? কোন ছেলেই নষ্ট হয়ে জন্মায় না। তাহলে এইসব নষ্ট সন্তানদের কে জন্ম দিচ্ছে?সমাজে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনার জন্যই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থা দায়ী। সে যেমন ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার জন্য দায়ী, তেমনি ঘটনাটি ঘটার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্যও দায়ী। এ কারণে সমাজব্যবস্থা ও তার পরিচালকদের দায়ী না করে, সেখানে মূল দৃষ্টি না দিয়ে প্রত্যেকটি ঘটনার আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করানো যাবে, কিন্তু তার আসল কারণও উদঘাটন করা যাবেনা, এ থেকে বেরিয়ে আসার পথও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
এইসব নষ্ট সন্তানদের জন্মদাতা এ সমাজ। এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা মানুষকে সবদিক থেকে বঞ্চিত করছে। মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে কিছু সংখ্যক লোক মুনাফার পাহাড় তৈরি করছে। আর এই বঞ্চিত মানুষ যাতে কোনদিনই মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে তার জন্য তার নৈতিক ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এই পুঁজিবাদ যতদিন টিকে থাকবে ততদিন মানুষের অনিশ্চয়তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। মানুষ কাজ পাবেনা, শিক্ষা পাবেনা, চিকিৎসা পাবেনা। ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষের ভীড় বাড়বে। অধিকারহীন একদল লোক একে অপরকে হারিয়ে দিয়ে কিভাবে সুবিধা আদায় করা যায় তার চিন্তায় মগ্ন থাকবে। মানুষকে পুরোপুরি ব্যক্তিগত চিন্তায় ডুবিয়ে রাখবে এই অসাম্যের সমাজব্যবস্থা। আর তাতে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের আরও তীব্র সংকট সৃষ্টি হবে।
নৈতিকতা-মূল্যবোধের এই ভয়াবহ সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কী? ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার উপায় কী? আমরা দেশের শিক্ষিত-সচেতন-বিবেকবান মানুষকে বলছি, আপনারা দেশের অভিভাবক। আপনারা যদি মনে করেন দেশের সরকার এ সমস্যার সমাধান করবে, তাহলে আপনারা আবার ঠকবেন, যেমন বারবার ঠকেছেন। দেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেলো। এই পুরো সময়ইতো আপনারা দেখলেন। একদলের বদলে আরেক দলকে এনে দেখলেন। বারবার হতাশ হলেন। এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যারা টিকিয়ে রাখতে চায় তাদেরকে নিয়ে এ আশা করে আপনাদের লাভ নেই। তার বদলে আমাদের ক্ষমতায় আনবেন- সেটাও আমরা বলছিনা। আমরা ক্ষুদ্র দল। কিন্তু আমরা যেটা বলতে চাইছি তা হলো, সমাজে মানুষের একটা ভূমিকা আছে। সেটা মানুষের ভুলে গেলে চলেনা। ওই বড় বড় দলগুলোর কাছে তো আপনারা মাথা বিক্রি করে দেননি। আপনার নিজস্ব বিবেকবুদ্ধি দিয়েভেবে দেখুন, সমাজের মানুষের জন্য আপনার কী করার আছে। মানুষ পরকালের আশায় ধর্ম পালন করে- তার একটা মর্মার্থ বোঝা যায়। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের প্রতি যে দায়বদ্ধতা- তা থেকে সে কি দায়িত্ব পালন করে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এই যে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ সেটা ক্রমেই আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যের মতকে ধারণ করা, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, নতুন মতকে, নতুন সত্যকে যুক্তির বিচারে গ্রহণ বা বর্জন করার যে সংস্কৃতি — যাকে বলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তা আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। ফলে মানুষ হিসাবে নারীরও যে মতামত থাকতে পারে, সেই মতামতের মূল্য দিতে শেখে নি এ সমাজ। নারীর প্রতি মর্যাদাবোধ, মানুষের প্রতি মানবিকতাবোধ, অপরের মত সহ্য করার ক্ষমতা- এসব ব্যতিরেকে কেউ গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন হয়না। আর এই সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক চিন্তাসম্পন্ন হওয়া ও তার ভিত্তিতে লড়াই করা ব্যতিরেকে কতগুলো মানুষ একটা সমাজে শুধু বেঁচে থাকার জন্য একত্রিত হয়ে থাকলে কি হয়? সে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তায়ই আচ্ছন্ন থাকে। সমাজের কোন সমস্যাই তার মনে দাগ ফেলেনা। তখন সে আর মানুষ থাকেনা, অমানুষ হয়ে যায়।
এগুলোর চর্চা তাহলে সমাজে কে করবে? যারা রাষ্ট্র চালায় তারা করবে? মিথ্যে কথা। যারা শোষণ-নির্যাতনমূলক টিকিয়ে রাখতে চায় তারা এটা করবেনা। আপনাদেরই এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলে এর চর্চা করতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের যে সামাজিক দায়বদ্ধতা সে জায়গা থেকেই আপনারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। আমরা বামপন্থীরা যে বিপ্লবের কথা বলি সেও এই প্রতিরোধ করতে করতেই গড়ে ওঠে। কিন্তু আপনাদের সেই বিপ্লবের কথা বলছিনা, আপনারা নিজেদের বেঁচে থাকার পরিবেশ নির্মাণের জন্যই এই প্রতিরোধে নামুন।
আরেকটা বিষয় ভেবে দেখা জরুরি, তা হলো এই যে, পুঁজিবাদ এই সমস্যা-সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী তা ঠিক, কিন্তু সমাজে বুর্জোয়া ভাবাদর্শের যেমন প্রভাব আছে তেমনি এই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া ভাবাদর্শকে, পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভজাত সংকট নিরসনে লড়াই করার শক্তিও এই সমাজে অন্তর্নিহিত আছে। সেই শক্তি জেগে ওঠলে সে এই সমাজব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিতে পারে, তাকে পাল্টে ফেলতে পারে। এই জন্য সমাজের মানুষের সক্রিয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ খুবই জরুরি। যে সকল মেয়েরা প্রতিনিয়ত রাস্তায়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-কর্মক্ষেত্রে লাঞ্চিত হচ্ছে তাদের পিতা-মাতার কি কোন দায় নেই এর প্রতিবাদ করার? ছেলে মেয়েদের প্রতিবাদ করতে শেখানোর? শিক্ষিত বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের পরামর্শ দেন ঝামেলায় না জড়ানোর। অর্থাৎ নিজের ওপরে এসে না পড়া পর্যন্ত তারা যাতে কোন প্রতিবাদ না করে। কেন? প্রতিবাদ করাটা কি নোংরামি? অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই মানুষ মানুষ হয়। ছোটবেলা থেকে এরকম স্বার্থকেন্দ্রিক করে যে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলছেন তাতে ভবিষ্যতে এই সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে দেখেছেন? আমরা দেশের মানুষকে আহবান জানাই এলাকায় এলাকায় নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার জন্য। এর সক্রিয় প্রতিরোধ করার জন্য। আমাদের আহবানে সাড়া দেয়া মানে আমাদের দল করা নয়। বড় বড় রাজনৈতিক দল সম্পর্কে আপনাদের মনে যে সকল ধারণা আছে, তাদের যত কথার খেলাপ আপনারা দেখেছেন তাতে আমাদের বিশ্বাস করা আপনাদের পক্ষে শক্ত তা ঠিক, কিন্তু আপনাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই এই প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আমরা আশা করবো যেখানে আমাদের দলের লোকেরা আবেদন করবে সেখানে আপনারা সাড়া দেবেন। যেখানে আমরা নেই সেখানে আপনারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলবেন। আপনারা যদি নামেন, তবে দেশে প্রতিরোধের একটি সংস্কৃতি তৈরি হবে। আর এই প্রতিরোধ করতে করতেই আপনারা পথের দিশা পাবেন। সে লড়াই করতে করতে আপনারা তখন নিজেরাই বুঝতে পারবেন সমাজের সমস্ত সংকটের কারণ কী, কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, কে শত্রু, কে মিত্র, কারা প্রকৃত লড়াইয়ের শক্তি, কে আপনাদের পাশে সবসময় থাকবে। এভাবে চলতে চলতে আপনারা হয়তো দেখবেন যে, একটি ক্ষুদ্র শক্তি কিন্তু সেই নীতি-নৈতিকতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে, এই সংকটের সময়ে পথ দেখানোর মতো আদর্শ সেই ধারণ করছে। আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ আপনারা আপনাদের অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করুন আর যেখানে আমাদের কর্র্মীরা আপনাদের কাছে যাবে সেখানে তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করুন।