[জাভেদ হুসেন। লেখক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ২৪ জুলাই ২০২১ চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘সংশপ্তক বহমান’ শীর্ষক স্মরণসভায় জাভেদ হুসেন বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যটি পরবর্তীতে সম্পাদিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো]
আমি কুমিল্লার মানুষ। কুমিল্লায় মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ভাইয়ের বাড়ি। তাঁর একজন ভ্রাতুষ্পুত্র আমার বাল্যবন্ধু। সেই সময় থেকেই আমি তাঁকে চিনি। রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নয়। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসাবে নয়। বন্ধুর চাচা হিসাবে চিনি। তিনি মাঝে-মধ্যে আসতেন। আসলে ঘরের আবহে ছাপ পড়ত। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে আমরা দূরে সরে থাকতাম। আমরা তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করি। ১৯৯৩/১৯৯৪ সাল হবে। সবে তখন স্টিফেন হকিং-এর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’বইটা বের হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় সেটার উল্লেখ পাই, কী রকম সাড়া জাগিয়েছে সেটা জানি। কিন্তু সেই সময় ইন্টারনেটের যুগ নয়। মফস্বলের একটা শহরের মধ্যে থেকে এই বইটা হাতে পাওয়া নিতান্ত স্বপ্নের মতো ছিল।
তো সেই সময় উঁনি একবার এলেন। তাঁর নির্ধারিত কক্ষেই তিনি থাকতেন। দুই-একদিন, তিনদিন কখনও। এরপর চলে গেলেন। তখন সেই কক্ষে ঢুকে দেখি যে, টেবিলের উপর রাখা স্টিফেন হকিংয়ের সেই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইখানা। বইটা বের হয়েছে তখন বেশি দিন হয়নি। এই বই সঙ্গে সঙ্গে হাতে পেয়ে যাওয়া এক বিস্ময়। তা হাতে নিয়ে মারাত্মক রকমের আশ্চর্য লাগছিল। যে বই নিয়ে সবে বাইরের দেশগুলোতে আলোচনা হচ্ছে, ব্যাপক পরিমাণে পড়া হচ্ছে, সেই বই হাতে পেয়ে যাওয়া! এই ঘটনাটা আমার জীবনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বড় বিষয় নিয়ে ভাবনা করবার, চিন্তা করবার বা পড়ে দেখবার যে আগ্রহ, সে আগ্রহের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এই ছোট্ট ঘটনা।
পরে ভেবে মনে হলো যে, আসলে কিছু মানুষ থাকেন, যারা শুধু তাদের উপস্থিতিতেই চারপাশে একটা প্রভাব রাখতে পারেন। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সেই প্রভাব রাখবার মতো মানুষ ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে জানার যে আগ্রহ সে বিষয়টি সর্বজনবিদিত। সংগীত, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, খেলা–সব বিষয় নিয়েই তিনি প্রবলভাবে আগ্রহী। এবং যে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি জানতেন, সেগুলো কোনোমতেই সামান্য বা প্রাথমিক স্তরের জানা ছিল না। প্রবল ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনের মাঝে এই কাজটা কীভাবে সম্ভব? যখন এ জীবনকে জানা, মানুষের জ্ঞানের প্রতি, সুকুমারবৃত্তির প্রতি আগ্রহগুলো তাঁর নিজের রাজনীতির অংশ হয়ে উঠতে পারে।
পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে যখন আমার কথা বলার সুযোগ হলো বারবার, বহু রকমের বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আমার নিজের আগ্রহের বিষয় ছিল দেশভাগ এবং তার পরবর্তী সময়ে ‘প্রগতিশীল লেখক সংঘ’ অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসটা নিয়ে। এবং সে ইতিহাসে এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন, যে ব্যক্তিদের বাংলাদেশে আমরা আলোচনার মধ্যে সাধারণত পাই না। সাজ্জাদ জহির, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সাদত হাসান মান্টো প্রমুখ। তাঁর সঙ্গে কথা বলার যখনই সুযোগ হতো, তখন বিস্ময় নিয়ে শুনতাম যে, কত গভীরভাবে তিনি তাঁদের সম্পর্কে জানতেন এবং কত গভীরভাবে তাঁদের বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন ছিল। তিনি শুধু পড়তেন না। তিনি অধ্যয়ন করতেন।
মানুষের যা কিছু অর্জন সে বিষয়ে তাঁর এই প্রবল ভালোবাসা তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের এক গভীর দিক উন্মোচন করে। মানবিক সব কিছু তাঁর আপন ছিল। মানুষ মূলত মানুষ হয়ে উঠেছে তাঁর সৃজনশীল শ্রমের মাঝ দিয়ে। মানুষ নিজ হাতে মৌমাছির মতো চাক বা বাবুই পাখির মতো সূক্ষ্ম কিছু বানাতে পারে না। কিন্তু তারপরেও মানুষের বানানো একটা মোটা কাপড় অথবা একটা স্থূল কুটির ওই বাবুই পাখির বাসা বা মৌমাছির চাকের চাইতে অনেক বেশি মহৎ। কারণ বাবুই পাখি বা মৌমাছি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অন্ধভাবে একই রকম প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে যায়। আর মানুষ, সে যত স্থূলভাবেই বানাক না কেন, তা বানানোর মধ্যে থাকে একটা সৃজনশীলতা। কারণ সে যা বানায় বা যা করে, ওই কাজটা করবার আগে তার একটা ছবি তার মাথার মধ্যে থাকে। এজন্য মানুষের শ্রম অন্য কোনো প্রাণীর শ্রমের চাইতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। আমরা এই সমাজের অন্যায্যতাগুলো অতিক্রম করে সমাজ বদলের কথা বলি। স্বাভাবিকভাবেই সেই সমাজ তৈরির কাজ রূপায়িত করবার আগেই তার ছবি আমাদের মাথার ভেতরে থাকতে হবে। সেই অনাগত সমাজকে নিজের মাথার মধ্যে, ভাবনায়, চিন্তায় এবং সর্বোপরি নিজের জীবনের মধ্যে ধারণ করতে হবে।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সংগীত, ভাস্কর্য, সাহিত্য, খেলা–এরকম মানুষের সমস্ত অর্জনগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করতেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মাঝে। এই চর্চা ছিল ভবিষ্যতের সমাজটি বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজের অংশ। যে সমাজ বানানোর ব্রত তিনি নিয়েছিলেন তাকে আগেই নিজের ভাবনায়, ধারণ করা। তাঁর এই ধারণ করাটা তাঁর রাজনৈতিকবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা তাঁকে অনেকের চাইতে আলাদা করে ফেলেছে। মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সেই মানুষ, যিনি ভবিষ্যতে সেই সমাজকে তৈরি করবার জন্য নিজের জীবন পুরোটাই দিয়ে গেছেন। তিনি সেই অনাগত জীবনকে, ভবিষ্যতের সেই সমাজকে নিজের বর্তমানে ধারণ করেছেন। যে সমাজের মধ্যে মানুষ শুধু অর্থ দিয়ে নয়; মুনাফা দিয়ে মানুষের সুকুমারবৃত্তিকে যাচাই করবে না, মূল্যায়ন করবে না। সেখানে মানুষ হবে মার্কসের ভাষায়–নিজেই নিজের জীবনের উদ্দেশ্য। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর এই শিক্ষাখানি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে আমি চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাঁর এই বিশিষ্টতা আরও অনেক কিছুর মাঝে আমাদের সমাজ বদলের রাজনীতির ইতিহাসের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
একজন অনন্য ব্যক্তি হিসাবে আমাদের কাছে তিনি টিকে থাকবেন। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, আপনাকে লাল সালাম!
ধন্যবাদ।