[আনু মুহাম্মদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ১৪ জুলাই ২০২১ তারিখে দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত অনলাইন স্মরণসভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যটি পরবর্তীতে লিখিতরূপে `কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ‘-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।]
প্রথমেই কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাসদ (মার্কসবাদী) আয়োজিত কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর স্মরণসভায় যারা উপস্থিত আছেন, বাসদ (মার্কসবাদী) নেতৃবৃন্দসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আছেন, অন্যান্য সুধী ব্যক্তিবৃন্দ আছেন, সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। আসলে আমি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই কয়েকটা কথা বলব। কারণ বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। অনেকে আছেন, মুবিনুল হায়দার ভাইয়ের ব্যাপারে যাদের আরও অনেক বেশি স্মৃতি আছে যেগুলো মূল্যবান, যেগুলো আমাদের শোনা দরকার। আমাদের বিপ্লবী আন্দোলনের, বাংলাদেশের বাম আন্দোলনের পর্যালোচনার জন্যও তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা ছাত্রজীবনে বাসদ—এর জন্ম দেখি, যেটা মোস্তফা ফারুক বললেন ’৮০ সালে, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেইসময় বাসদ—এর জন্ম হলো। তার আগে জাসদ ধারা। এর বাইরে মস্কোপন্থী ধারা, পিকিংপন্থী ধারার সাথে তো আমাদের পরিচয় ছিল। বাংলাদেশের একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে জাসদের ধারা থেকে বাসদ—এর জন্ম হয়। বাসদ—এর কাজ আমরা ছাত্রজীবন থেকে দেখেছি খুব কাছে থেকেই, বিশেষত ছাত্র ফ্রন্ট—এর মধ্যে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফ্রন্টের যে কাজের ধরন, কর্মপদ্ধতি, শৃঙ্খলা, তাদের যে ডেডিকেশন, আত্মনিবেদনের রূপ এবং পুরো বিপ্লবী ধারায় জীবনকে নিয়ে যাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি সেটা আমরা দেখেছি। আমরা জানি যে, এর সাংগঠনিক কাঠামো ও কাজের ধরনের সাথে ভারতের এসইউসিআই—এর কর্মপদ্ধতি এবং শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার একটা সম্পর্ক আছে। আমরা দেখেছি যে, ১৯৮০—র দশকে বাসদ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক শক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সে সময়ে সামরিক এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন খুব দ্রুতই সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বিস্তৃত হয়েছিল, এবং তাতে ছাত্র—ছাত্রীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছিল। তারা একটা ইম্প্রেশন তৈরি করতে পেরেছিলেন মানুষের মধ্যে যে, তারা যা করছেন আন্তরিকভাবে করছেন, তারা যা করছেন সেটা সিরিয়াসলি করছেন, গুরুত্ব দিয়ে করছেন, সততার সঙ্গে করছেন। এরকম একটা ইম্প্রেশন তারা তৈরি করতে পেরেছিলেন বলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় এই সংগঠন বিস্তৃত হয়েছে, প্রভাব বিস্তার করেছে।
হায়দার ভাইয়ের সাথে আমার বিভিন্ন সময় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তবে তা খুব বেশি দিন আগের নয়। তখন হায়দার ভাইয়ের নাম শুনতাম। তিনি সামনে ছিলেন না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে আমরা সবাই তাঁর কথা জানতাম। পরবর্তীকালে প্রধানত ‘তেল—গ্যাস—খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ—বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র কাজের সূত্রে তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে আমাদের এই জাতীয় কমিটির যে কার্যক্রম ১৯৯৮ সালে শুরু হয়, তখন থেকে এই করোনা পর্যন্ত যত ধরনের কর্মসূচি হয়েছে, করণীয় নির্ধারণের জন্য আলাপ আলোচনা গবেষণা লেখালেখি হয়েছে সেসূত্রে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীবৃন্দের সাথে আমার সারাক্ষণই যোগাযোগ হয়েছে। হায়দার ভাইয়ের সাথেও বেশ ক’বার আন্দোলনের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং এগিয়ে যাবার পথ ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কথা হয়েছে। এখানে এই জুম সভায় বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ আছেন তাদের অনেকের সাথেই তো এই করোনাকালে আর দেখা করার সুযোগ হয়নি, হায়দার ভাইয়ের সাথেও হয়নি। তবে হায়দার ভাই নিজের দায়িত্ববোধ থেকে একাধিকবার ফোন করেছেন খোঁজ নেওয়ার জন্য যে, করোনাকালে কেমন আছি? আমাদেরও করোনা হয়েছিল, সে কারণে তিনি বার বার খোঁজ নিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই করোনাকালে এমন অসুস্থ হলেন যে, তাঁকে আর রক্ষা করা গেল না।
নেতৃত্ব বা তাত্ত্বিক হিসাবে তাঁর যে অবস্থান ছিল, তার কেন্দ্রীয় প্রেরণা শিবদাস ঘোষ। শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সাথে মার্কসবাদের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের বাম মহলে, আলোচনা আছে, বিতর্ক আছে। তবে আলোচনা বিতর্কের ধরন এখনও পরিণত হয়েছে বলা যাবে না। পারস্পরিক সম্মান নিয়ে যেভাবে সবাই বিতর্ক পর্যালোচনার মধ্যে এলে নতুন প্রজন্ম শিক্ষিত হবে, এই তাত্ত্বিক চর্চা বাংলাদেশে এখনও শক্তিশালী হয়নি, হওয়া দরকার। তা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং জীবনকে উৎসর্গ করার যে একটা বড় ধরনের প্রাণশক্তি তা বামপন্থীদের মধ্যেই পাওয়া যায়, এই ধারাতেও এর স্বাক্ষর পাই।
সংগঠনের মধ্যে যথাযথ তর্ক বিতর্ক মতভেদের পরিবেশ না থাকায় বহুরকম অবাঞ্ছিত ভাঙনই হয়েছে বামপন্থীদের বিভিন্ন দল ও গ্রুপে। মস্কোপন্থী ধারায় আগে ভাঙন আমরা সেভাবে দেখিনি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভাঙন ও দলত্যাগের ঘটনা উল্লেখযোগ্য মাত্রাতেই দেখা যায়। অন্যদিকে পিকিংপন্থী ধারায় ’৭০—এর আগে থেকে যে ভাঙন শুরু হয়েছে, সে ভাঙন তো একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অব্যাহতই থেকেছে। বাম আন্দোলনে একের পর এক ভাঙন আমাদের সবাইকেই দুর্বল করেছে আসলে, বাসদ—এর ক্ষেত্রেও এটাই ঘটছে। বাসদ—এর গঠন তো আরও পরের ঘটনা। গত কয়েক বছরে এই দলে ভাঙন বেড়েছে। এই ভাঙনের কারণ নিশ্চয়ই আছে, যারা বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়েছেন, তাদের নিশ্চয় যুক্তি আছে। কিন্তু এগুলোর ফলাফল যা হয়, অনেক কর্মী অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী যারা কাজ করতে চান, তাদের অনেকের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়। সেই হতাশার কারণে প্রত্যেকটা ভাঙনের সময় একটা বড় অংশ বসে যায়। এটা আমার মনে হয় সবার বিবেচনার মধ্যে রাখা দরকার। বসে যাওয়া মানুষের সংখ্যা যদি সক্রিয় থাকা মানুষের থেকে বেশি হয়ে যায়, যেটা আমার আশঙ্কা, এখন মনে হয় সেরকমই। প্রাক্তনদের সংখ্যা বর্তমান থেকে বেশি। যখনই একটা ভাঙ্গন হয় তখন যে একটা বড় অংশ বসে যায়, তাতে সাধারণভাবে উদ্দীপনাও নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য আমি মনে করি যে, যে কোনো মতাদর্শিক বিতর্ক বা সাংগঠনিক কোনো ভাঙনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এগুলো আমাদের প্রত্যেকেরই বিবেচনার মধ্যে নেওয়া দরকার।
যাই হোক, বাংলাদেশের বাম বা বিপ্লবী আন্দোলনের বা মানুষের মুক্তির আন্দোলনের এখনও পথ অনুসন্ধানের কাজ চলছে। তাত্ত্বিকভাবে নতুন পুনর্গঠন—এর কাজ ভারতে এসইউসিআইও করছে, অন্যান্য অনেকেই করছেন। সারা বিশ্বে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তাত্ত্বিক অনেক কিছুই নতুন সংযোজন কিংবা পুনর্গঠনের তাগিদ তৈরি হয়েছে। নানা দেশে অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে যা আমাদের সবারই বড় শক্তির জায়গা। সাধারণভাবে মনে হচ্ছে যে, খুব বড় সঙ্কটের মধ্যে আছে বিপ্লবী আন্দোলন। কিন্তু পাশাপাশি খেয়াল করলে আমরা দেখব যে, অন্যদিকে তার বিশাল সম্ভাবনাও বিশ্বের নানা জায়গায় দেখা যাচ্ছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রে, ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট এবং অস্পষ্টভাবে অনেক ধরনের বিপ্লবী শক্তি তৈরি হচ্ছে, অনেক তৎপরতা বলা যায় যে সংগঠিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তার মানে একদিকে মনে হচ্ছে অনেকে বসে যাচ্ছে, তার মানে সম্ভাবনা শেষ হচ্ছে তা নয়, কারণ আবার অন্যদিকে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
এগুলো আমরা যদি যথেষ্ট মনোযোগের সাথে গ্রহণ করি এবং বাসদের মতো রাজনৈতিক দল যারা যথেষ্ট দায়িত্ব এবং শৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করেন, তারা যদি এগুলো বিবেচনার মধ্যে নেন, তাহলেই কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা জানানো হবে। তিনি আজীবন আমৃত্যু বিপ্লবী তৎপরতায় সক্রিয় ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এ কথাটা কেউ বলতে পারবে না যে, তিনি বিপ্লবী অঙ্গীকারের প্রতি কোনো ধরনের দায়িত্বহীনতা প্রকাশ করেছেন কিংবা তা থেকে সরে গেছেন কিংবা নিজে সুবিধাবাদিতায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর অবদান আরও বেশি ফলপ্রসূ হবে যদি নতুন প্রজন্মের কাছে এই ধারাবাহিকতা আরও শক্তিশালীভাবে নিয়ে আসা সম্ভব হয়।
জানি যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তি তাত্ত্বিক কিংবা বিভিন্ন সংগঠনে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য থাকবে, বিতর্ক থাকবে, ভাঙনও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার মধ্যেই আবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজের সংস্কৃতি থাকতে হবে। এর চর্চা বাংলাদেশে অনেকভাবে তৈরি হয়েছে, জাতীয় কমিটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, আরও অনেকভাবে চেষ্টা হচ্ছে, কাজও হচ্ছে। আমি আশা করি যে, এগুলো সামনে আরও শক্তিশালী হবে। এরকম ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে, পারস্পরিক বিতর্ক থাকলেও, মতভেদ থাকলেও, তিক্ততা হবে না। এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে একসাথে ভূমিকা পালন করার জন্য যে মানসিক শক্তি, সেই শক্তি নিয়ে আমরা সবাই কাজ করতে পারব। এ প্রত্যাশা রেখে এবং কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আমার কথা শেষ করছি। ধন্যবাদ।