ভারতের পানি আগ্রাসন এবং শাসকদের নতজানু নীতি রুখে দাঁড়ান
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকে
৮-১০ এপ্রিল ঢাকা-তিস্তা ব্যারেজ রোডমার্চ সফল করুন
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) বিধৌত এই বাংলাদেশ। এর পরই আসে তিস্তার নাম। তিস্তা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চতুর্থ বৃহত্তম আন্তর্জাতিক নদী। উত্তরবঙ্গের একটা বড় অঞ্চল এই তিস্তা ও এর শাখা-প্রশাখার উপর নির্ভরশীল। অথচ স্মরণকালের ভয়াবহ পানি সংকটে তিস্তা নদী। পানির অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীনে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। মাত্র ১০-১২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানেও পানির তীব্র সংকট। ফসলের জমি ফেটে চৌচির। চাষীরা পানির জন্য হাহাকার করছে। এই চাষীরাই কয়েকদিন আগে আলুর দাম না পেয়ে পথে বসে আহাজারি করেছে, পরিশ্রমের আলু পথে ঢেলে দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। এখন ধান ফলাতে গিয়ে পানির অভাবে তাদের মাথায় হাত পড়েছে। সরকার বিদ্যুতের দাম আবারো বাড়িয়েছে। যথাসময়ে সেচের পানি না পেলে এ অঞ্চলের চাষীরা ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সবদিকেই চাষীর মরণ। চাষীদের, গ্রামের গরিব মানুষদের মরণদশায় ঠেলে দিয়ে সরকার কোন্ রাজকার্যে ব্যস্ত? টি-টুয়েন্টি আয়োজনে।
তিস্তার পানিতে ভারতের আগ্রাসন
দেশের শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত উত্তরবঙ্গের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর জেলা। এখানকার জমি তিন ফসলী এবং উৎপাদন খরচও খুব কম। এর পেছনে অবদান তিস্তা নদীর। তিস্তা এ অঞ্চলের প্রাণ। এর পানি দিয়ে এ অঞ্চলের সেচ কাজ চলে। কেন তিস্তায় পানি নেই? তিস্তার পানির উৎস কি শুকিয়ে গেছে? তিস্তা ব্যারেজের ৬৫ কিলোমিটার উজানে ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবা ব্যারেজের সকল গেট বন্ধ করে দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে তিস্তা নদীতে চরম পানি সংকট দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই ভারত এ কাজ করে চলেছে।
তিস্তা নদী উত্তর সিকিমের সো লামে হ্রদ থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৩১৫ কি.মি দীর্ঘ তিস্তা নদীর ১১৫ কি.মি এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়ার ১৭% পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবা এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। উজানের দেশ হিসাবে ভারত আগেই ব্যারেজ ও সেচখালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা ব্যারেজ অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে বাংলাদেশ অংশে বন্যা ও নদীভাঙন দেখা দেয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে, ঐতিহাসিকভাবে শীত মৌসুমে তিস্তা নদীতে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। গজলডোবা ব্যারেজে পানি প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশের অংশে তা কমে ৪ হাজার কিউসেকে দাঁড়িয়েছে। খরা পরিস্থিতিতে এই প্রবাহ আরো কমে ১ হাজার কিউসেক হয়ে যায়। এ বিষয়ে নানা ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। বুয়েট এর পানিবিশেষজ্ঞদের হিসেবে তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহিত হতো ৫ হাজার কিউসেক। গজলডোবা ব্যারেজ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পর প্রবাহ কমে হয়েছে সর্বনিম্ন ৫০০ কিউসেক। বিগত দিনে ভারত ও বাংলাদেশে পানির ব্যবহার অনেক বেড়েছে এবং ভারতের দাবি বৃষ্টিপাত কমে যাওয়াসহ প্রাকৃতিক কারণে তিস্তায় পানি কমে গেছে।
বাংলাদেশ তিস্তা নদীর উপর ব্যারেজ নির্মাণ করে ১৯৯৩ সালে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করেছে। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া এলাকায় সেচ প্রদানের জন্য এর ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ক্ষমতা আছে। এই প্রকল্পের সেচ লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর হলেও বর্তমানে সেচ সুবিধা দেয়া যাচ্ছে ১ লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে। ওদিকে, ১৯৯৬ সাল থেকে গজলডোবা ব্যারেজ থেকে তিস্তা খালের মাধ্যমে সরিয়ে নেয়া পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচকাজ চালানো হয়। পর্যায়ক্রমে ৯.২২ লাখ হেক্টর জমিকে এই পানি দিয়ে সেচ সুবিধায় আনার পরিকল্পনা আছে।
অন্যদিকে, গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে সংযোগখালের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে আপার মহানন্দা নদীতে যা গিয়ে মিলিত হয়েছে বিহারের মেচি নদীর সাথে। এভাবে ভারত তার বিতর্কিত আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের একাংশ বাস্তবায়ন করছে তিস্তার পানি দিয়ে। শুধু গজলডোবা ব্যারেজই নয়, সিকিম রাজ্য সরকার পর্যটন শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে সিকিমে তিস্তার উপনদীগুলোতে ইতোমধ্যে ছোট-মাঝারি ৫টি বাঁধ নির্মাণ করেছে, আরো ৪টি নির্মাণাধীন রয়েছে এবং নতুন করে ৩১টি প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। যদিও এই বাঁধগুলোকে বলা হচ্ছে ‘run-off the river’ প্রকল্প যা নদীপ্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কিন্তু এই কথা খাটে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে যখন নদীতে পানির প্রাচুর্য থাকে। জলাধারে পানি সংরক্ষণ এবং বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে ভাটিতে পানি যতটুকু হ্রাস পায় তা শুকনো মৌসুমে নদীপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
সরকারের নীরবতার রহস্য কি?
ইতোমধ্যে গত এক মাসে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ভারত সরকার কর্তৃক তিস্তা থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে এবং পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত হল রংপুর থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত রোডমার্চ। তিস্তার পানি নিয়ে যখন এত হইচই চলছে তার মাত্র কিছু দিন আগে গত ১২ মার্চ ’১৪ বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশনের দুই দিনব্যাপী বৈঠক পানির ন্যায্য হিস্যার সমাধান ছাড়াই শেষ হয়েছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়েছে যে সহসা ভারত অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানে আগ্রহী হবে না। অথচ পাকিস্তানের সাথে ভারতের একাধিকবার যুদ্ধসহ বৈরী সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সিন্ধু নদের পানি ভাগাভাগি নিয়ে স্থায়ী চুক্তি হয়েছে।
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে স্বাধীনতার পর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। তখন ঠিক হয়, ভারত ৩৯% ও বাংলাদেশ ৩৬% পানি পাবে। বাকি ২৫% কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার এবং এটি কিভাবে ভাগাভাগি হবে তা নিয়ে পরে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের অনীহার কারণে এবং শাসকদের উদ্যোগের অভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে ৮,০০০ কিউসেক পানি দাবি করে, অন্যদিকে ভারত দাবি করে তার প্রয়োজন ২১,০০০ কিউসেক। অথচ, শীত মৌসুমে সর্বাধিক সংকটের সময়ে তিস্তা নদীতে ১০,০০০ কিউসেক-এর বেশি পানিপ্রবাহ থাকে না।
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরোধিতাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে ভারত সরকার চুক্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে। মমতার বক্তব্য, শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা ব্যারেজ থেকে বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর ৫০% পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গের ৫টি জেলার এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেছেন, তিস্তার পানির ৭৫% পশ্চিমবঙ্গের জন্য রেখে বাংলাদেশকে ২৫% এর বেশি দেয়া যাবে না। দুই দেশের মানুষের পানির প্রয়োজন ও জীবন-জীবিকার কথা মাথায় রেখে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে ন্যায্য পানি ভাগাভাগির পরিবর্তে মমতা বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করে ভারত সরকার অনুসৃত একতরফা পানি প্রত্যাহার নীতিরই প্রতিধ্বনি করছেন। অভিন্ন নদীর পানির উপর বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি-নীতি অনুযায়ী উজানের দেশ ভাটির দেশকে বঞ্চিত করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না।
জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের বিশ্বরেকর্ড!
নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে ব্যর্থ হলেও বর্তমান সরকার একের পর এক চুক্তি করে চলেছে যেখানে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। ২০১০ সালে হাসিনা-মনমোহন চুক্তি, ট্রানজিটের নামে করিডোর প্রদান করে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর ভারতের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন প্রদান, সন্ত্রাস দমনের নামে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠন করে আমাদের দেশে ভারতের সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দেওয়া, বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবন ধ্বংস করে ভারতের স্বার্থে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি এবং সমুদ্রের দু’টি গ্যাসব্লক ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এসব জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে গিনেজ রেকর্ড বুকে নাম ওঠানোর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আয়োজনে।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গত ৪২ বছরে যারাই দেশ শাসন করেছে, বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টি সকল সরকারই দেশের স্বার্থে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো ক্ষেত্রেই দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেনি। এরা অনেকেই ভারত বিরোধিতার কথা বলে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়, ভোটের রাজনীতিতে চালবাজি করে, কিন্তু ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয় না।
ফারাক্কার পর এবার তিস্তা
ফারাক্কা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার সাথে যুক্ত প্রায় ২০টি নদী এবং ঐতিহ্যবাহী চলনবিলসহ ওই অঞ্চলের জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলসহ পদ্মা অববাহিকার ১৮ জেলায় মরুকরণের আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলেও, সেখানে সমুদ্রের লোনা পানি ভেতরে চলে আসছে, জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, খুলনা অঞ্চলে ১৯৭৫-’৯২ সময়কালে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার পরিমাণ ফারাক্কা বাঁধ পূর্ববর্তী মাত্রার চেয়ে ১৮০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। বর্তমানে দেশের ১৯টি জেলা কমবেশি লবণাক্ততায় আক্রান্ত।
ফারাক্কা-গজলডোবা বাঁধই শেষ নয়। কিছুদিন আগে সারি নদীর উজানে নতুন করে বাঁধ নির্মাণ করেছে। মেঘনার উৎস নদী সুরমা-কুশিয়ারার উজানে ভারতের মণিপুরে বরাক নদীর ওপর টিপাইবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে যথেষ্ট হইচই হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অব্যাহত ও লাগাতার প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত সরকার সে কাজ বন্ধ করেনি। শুষ্ক মৌসুমে দেশের সবচেয়ে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে পানি সরিয়ে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের অন্য নদীতে নিয়ে যেতে চায়। এসব সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ মরুকরণের ঝুঁকি আরো বাড়বে।
ভারত আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে চলেছে
তিস্তার পানি পাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনও এ ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে। হেলসিংকি নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি নদী তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলপ্রবাহ কনভেনশনে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার নীতিমালা’ গ্রহণ করে। এসব নীতিমালার মূল কথা হল, উজানের কোনো দেশ ভাটির কোনো দেশের স্বার্থ ক্ষুণœ করে একক সিদ্ধান্তে বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারে না। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো রাষ্ট্র একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক নদীর গতিধারার পরিবর্তন করতে পারে না। সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো রাষ্ট্র একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক নদীর গতিপথ পরিবর্তন করলে এবং এর ফলে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণের জন্য সে রাষ্ট্র দায়ী থাকবে। এ দেশের শাসকদের নির্বিকারত্ব কতটুকু তা বুঝা যায় এই তথ্য থেকে, আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ জলপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ এখনো বাংলাদেশ ‘রেটিফাই’ করেনি, ভারতও করেনি।
সমাধান কোন্ পথে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১১ সালে বলেছেন, “৪০ বছরে একটিমাত্র নদীর পানি ভাগাভাগি এবং অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কাছাকাছি এসেছি। এ হারে ৫৪টি অভিন্ন নদীর ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরে দু’প্রতিবেশীর সময় লাগবে এক সহস্র বছর।” ভারত সব অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের সমন্বিত পরিকল্পনার বদলে একেকটি করে আলোচনা করছে। অভিন্ন নদীর পানি সমন্বিত ও যৌথ ব্যবস্থাপনা-ব্যবহার-উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে যৌথ অববাহিকা কর্তৃপক্ষ গঠন করা দরকার। ইউরোপে রাইন নদীর অববাহিকায় যত দেশ আছে সবাই মিলে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যৌথ কমিশন গঠন করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬টি দেশ নিয়ে একইভাবে মেকং রিভার কমিশন কাজ করছে। সম্প্রতি চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের উৎস সাংপো নদীর উপর বাঁধ দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণায় ভারত সরকার জোরালো আপত্তি জানিয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্যও তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারত ও বাংলাদেশে প্রধান নদীগুলোর পানি কমে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ইতোপূর্বে নেপালের পাহাড়ী এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। এর সম্ভাব্যতা যাচাই ও বাস্তবায়ন করতে হলে এ ধরনের বহু-রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দরকার।
ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশের মানুষেরই পানি প্রয়োজন এবং এ প্রয়োজন দিনদিন বাড়বে। ফলে দু’দেশের মানুষের অভিন্ন স্বার্থে নদী রক্ষায় পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দরকার। এক্ষেত্রে একটি বিষয় আমরা উল্লেখ করতে চাই, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুধুমাত্র দু’দেশের সরকারী মহলের উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। কারণ ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী তাদের শ্রেণীস্বার্থ ও পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে কখনো আধিপত্যবাদী রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে পানিসমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে, কখনো সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নামে পানির বিনিময়ে নানা সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছে। একইভাবে বাংলাদেশের সরকারগুলোও কখনো নতজানু নীতি অনুসরণ করে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে, কখনো ভারতবিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানির আড়ালে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করেছে। এভাবে জনগণের জীবন-জীবিকার সংকট বেড়েছে, সমস্যা জটিলতর হয়েছে এবং দু’দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছে। ফলে আমাদের দাবি Ñ পানিসমস্যা সংক্রান্ত আলোচনায় সরকার ও সরকারি বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি দু’দেশের বেসরকারি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ এবং সকল গণতান্ত্রিক দল ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত নিতে হবে। সর্বোপরি, সমস্ত বিষয় দু’দেশের জনগণকে খোলামেলা জানাতে হবে, আমলাতান্ত্রিক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। দুদেশের জনগণ ও সচেতন মহলের চাপ সরকারগুলোকে জনস্বার্থে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে।
ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের সহযোগিতা চাই
ভারত সরকার একতরফা পানি প্রত্যাহার এবং নানা অজুহাতে অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন আলোচনা ঝুলিয়ে রেখে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে একে ব্যবহার করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারতের শাসকশ্রেণী ও জনসাধারণ এক কথা নয়। ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী সেদেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বাজার সম্প্রসারণ ও পুঁজি বিনিয়োগের স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়াকে তার প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত করতে চায়। ভারতের শাসকশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় ভারতীয় জনগণের কোনো স্বার্থ নেই। সেদেশের নিপীড়িত মেহনতি মানুষও তাদের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে শাসকদের গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমরা জানি, ভারতের বামপন্থী ও গণতন্ত্রমনা প্রগতিশীল শক্তি এ অঞ্চলে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। ভারত-বাংলাদেশের শোষিত জনগণের সংগ্রামের ঐক্যের পথেই ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
নদী ধ্বংসের জন্য বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীও দায়ী
আমাদের নদীর পানির ওপর ভারতের আগ্রাসী থাবা যেমন আছে তেমনি আছে আমাদের শাসকদের পরিকল্পনাহীনতা, দায়িত্বহীনতা। মুখে নদী খনন, পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কথা বলা হলেও এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা হয় না, বরাদ্দকৃত অর্থ প্রধানত শাসক দলের নেতা-কর্মীদের পকেট ভারী করার কাজে লাগে। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ নদীর গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করে চলছে দিনকে দিন। পাশাপাশি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় নদী-খাল-বিল-জলাশয় দখলের মহোৎসব চলেছে। আর পাল্লা দিয়ে চলছে নদীর দূষণ ও দখল। শুধু ঢাকার আশেপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর একটা বড় অংশ দখল এবং ভরাট হয়ে গেছে এবং প্রায় সাত হাজার ছোট-বড় শিল্প-কলকারখানার বর্জ্যে পানি সীমাহীন মাত্রায় দূষিত হচ্ছে। এর কোনো প্রতিকার নেই। শাসকগোষ্ঠী যে শুধু মানুষকে শোষণ-লুষ্ঠন করছে তাই নয়, মানুষ যে প্রকৃতির ওপর ভর করে বেঁচে আছে তাকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
গণআন্দোলনের ধারাতেই সরকারকে বাধ্য করতে হবে
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের কাছ থেকে তিস্তাসহ সকল অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারের জোরালো উদ্যোগ গ্রহণের দাবিতে, মহাজোট সরকারের নতজানু নীতির প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমতকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাসদ রংপুর জেলা শাখার উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ হাজার হাজার জনগণের অংশগ্রহণে রংপুর থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই দাবিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকে আগামী ৮ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকা থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত ‘রোডমার্চ’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। ৮ এপ্রিল সকাল ৯টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে উদ্বোধনী সমাবেশ শেষে রোডমার্চ যাত্রা শুরু করে ৩ দিনে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, হাটিকুমরুল, বগুড়া, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, রংপুর, নীলফামারীর জলঢাকা হয়ে ১০ এপ্রিল বিকাল ৪টায় তিস্তা ব্যারেজসংলগ্ন দোয়ানীবাজারে সমাপনী সমাবেশের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। পথে পথে সমাবেশ, মিছিল, গণসংযোগ, প্রচারপত্র বিলি, জনসভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হবে। আমরা সরকারের কাছে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাই। তিস্তাসহ সকল অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারকে জোরালো কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থায় তিস্তার পানি বণ্টনের সমস্যাটি তুলে ধরতে হবে। কিন্তু সরকার জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে কি করবে সে ভরসা খুব কম। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হল সচেতন সংগঠিত গণআন্দোলন। তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদী বাঁচাতে পানির ন্যায্য পাওনা আদায়ের সংগ্রামে রাজপথে সোচ্চার হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমরা সকলকে সেই আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।