সাম্যবাদ প্রতিবেদন
ঘটনাকে চাপা দিচ্ছে অঘটন। একটা অঘটন এসে চাপা দিয়ে দিচ্ছে আরেকটা অঘটনকে। সুস্থির হয়ে নিজের জীবন আর দুঃখের কথা ভাবার জন্যেও দু’দ- সময় মানুষ পায় না। কিন্তু তারপরও নির্মম কঠিন বাস্তবের টানে মানুষকে আবার জীবনের সমস্যাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। তিস্তার পানির সমস্যা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে তেমনি একটি সমস্যা।
এ বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে তিস্তার পানির সমস্যাটি আলোচনায় আসে। ওই সময় তিস্তার পানি প্রবাহ স্মরণকালের সর্বনিম্নে নেমে আসে। জানা যায়, ১৯৭৩-১৯৮৫ কালপর্বে ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানিপ্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। এ বছরের একই সময়ে তা মাত্র ৯৬৩ কিউসেক। আর ১৯৭৩-১৯৮৫ সময়কালে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় ১০ দিনে গড়ে ৫১৪৯ কিউসেক পানিপ্রবাহ থাকলেও এ বছরের একই সময়ে তা গড়ে মাত্র সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ কিউসেক। পানির অভাবে তিস্তা পাড়ের ১২টি উপজেলার প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া জেলার তিস্তা পাড়ের চাষীরা হাহাকার করতে থাকে। চরম দুর্ভোগ নেমে আসে এ নদীর সাথে সম্পৃক্ত হাজার হাজার মৎসজীবী ও মাঝি পরিবারে। পদ্মা (গঙ্গা) নদীর ওপর ফারাক্কা বাধের কারণে উত্তরবঙ্গে যে মরুকরণ চলছে, তিস্তার পানিশূন্যতা সে মরুকরণকে আরো তীব্র করে তুলবে — এ আশঙ্কাও জনমনে প্রবল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত চতুর্থ বৃহত্তম নদী তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতে প্রবাহিত ২৪৯ কিলোমিটার ও বাংলাদেশে প্রবাহিত ১১৭ কিলোমিটার। তিস্তা অববাহিকায় মোট সেচ এলাকার পরিমাণ ১৯ দশমিক ৬৩ লাখ হেক্টর, যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৭ দশমিক ৪৯ লাখ হেক্টর। বাকিটা ভারতে। সীমান্তের প্রায় ৫০ মাইল উজানে ভারতের জলপাইগুড়ির মেকলিগঞ্জে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ২১১.৫৩ মিটার দীর্ঘ গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে ওই অঞ্চলে সেচ কাজ চালাচ্ছিল। সম্প্রতি ভারত সেচের পাশাপাশি তিস্তা নদী থেকে খালের সাহায্যে পানি সরিয়ে পশ্চিমে মহানন্দা, মেচি, পুনর্ভবা, আত্রাই ইত্যাদি নদীতে নেয়া শুরু করেছে। এ জন্য গজলডোবার সকল গেইট বন্ধ করে সম্পূর্ণ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অথচ এর ফলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা, এখানকার তিস্তা পাড়ের লক্ষ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার কি হবে, প্রকৃতি-পরিবেশের কি হবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে নি। তিস্তায় পানি না থাকায় আমাদের দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা সেচ প্রকল্প’ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, তিস্তায় পানি না থাকায় এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট বড় নদ-নদীতে তার প্রভাব পড়ছে। রংপুর অঞ্চল ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে।
ভারতের শাসকগোষ্ঠী এসব বিষয় নিয়ে ভাবেনি, এটা যেমন সত্য, তারচেয়েও বড় সত্য যে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী, বর্তমান সরকার তারাও এ বিষয়ে ভাবিত নয়।
দায় চাপানোর খেলা
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সরকার পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরোধিতাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে ভারত সরকার চুক্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য মমতাকে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে দায়ী করে বলেছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল। কেন্দ্র দায়ী করছে রাজ্য-কে, হাসিনা দায়ী করছেন মমতাকে — কিন্তু বাস্তব ঘটনা কি?
তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সমস্যা। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে স্বাধীনতার পর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ভারত-বাংলাদেশ মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। তখন ঠিক হয়, ভারত ৩৯% ও বাংলাদেশ ৩৬% পানি পাবে। বাকি ২৫% কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার এবং এটি কিভাবে ভাগাভাগি হবে তা নিয়ে পরে আলোচনার কথা ছিল। অর্থাৎ এটি কোনো স্থায়ী চুক্তি ছিল না, কিন্তু সেটাও ভারত মেনে চলছে না। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন এত দীর্ঘ দিন ধরে সমস্যাটিকে ঝুলিয়ে রাখা হল।
শুধু তাই নয়, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনার বাইরে কোনো অবস্থান নিয়েছে? তিস্তা থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা কি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের? নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের? ইতোমধ্যে তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার করে আগামী ১০ বছরে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। এটা কোনো আঞ্চলিক সরকারের পরিকল্পনা নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে সিকিমে তিস্তার উপর তিনটি বাধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, আরো ১০টি বাস্তবায়নের পথে। এভাবে ৩৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। ভারত সরকারের এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। গজলডোবার গেট দিয়ে চুঁইয়ে আসা পানি দিয়ে গজলডোবার ৪০ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের ডিমলা উপজেলার কালীগঞ্জ জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তর-পশ্চিমে বাঁধ দিয়ে আরো চারটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ করছে। আগামী জুন মাসে সেগুলো চালু করার কথা।
এখানেই শেষ নয়। ভারত গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের মাধ্যমে এক হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানকার বিরাট সেচ প্রকল্প তো আছেই। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিরাট পরিকল্পনা কেবল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরই। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তিস্তার পানির ছিঁটেফোটাও কি বাংলাদেশে আসবে? আসলে দায় চাপানোর খেলায় জনগণকে বোকা বানানোই হচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : শাসকগোষ্ঠীর লেনদেন
বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী। ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক কারণে বহু বিষয়ে দু’দেশের জনগণের স্বার্থ পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু দুই দেশের শাসকগোষ্ঠী জনগণের স্বার্থকে জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট লেনদেনেই মনযোগী।
বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি অভিন্ন নদীর ৫৪টিই এসেছে ভারত থেকে। ফলে দু’দেশের মধ্যে নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন, সীমান্ত ও ছিটমহল সমস্যার সমাধান, বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ, জনগণের বাধাহীন যাতায়াত – এসব সমস্যা নিয়ে জনস্বার্থের বিবেচনায় প্রয়োজনীয় আলোচনা ও উদ্যোগ গ্রহণ ছিল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কোন একটি প্রশ্নেও আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে নি। এর পরিবর্তে, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর এবং এখানকার বুর্জোয়াশ্রেণীর সব সময় প্রচেষ্টা ছিল, জনগণের এসব সমস্যাকে সামনে রেখে নিজেদের নানা লেনদেন, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করা। বর্তমান সময়ে এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট-করিডোর, রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্প, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়, এবং সর্বোপরি ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের শাসকদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ।
অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে এখন পর্যন্ত সাফল্য ধরা হয় গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিকে। এ চুক্তির দিকেও আমাদের ভালো করে নজর দেয়া দরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৭ সালে প্রথম গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ন্যূনতম ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া ছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালের পর কোনো চুক্তি না থাকায় ফারাক্কা দিয়ে পানি আসা কমে যায়। এরপর ১৯৮২ এবং ১৯৮৫ সালে দুটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় কিন্তু তাতে কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল না। ওই সময় ভারতের প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি খাল কেটে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফারাক্কার উজানে ফেলে পানির ঘাটতি মেটানোর। কিন্তু এতে লাখ লাখ মানুষকে ঘড়বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে হতো তাই বাংলাদেশ এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি। ফলে ভারত গঙ্গার পানির বিষয়ে নিজের নীতিতেই চলতে থাকে। এরপর ১৯৯৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অংশের প্রবাহ ১০ হাজার কিউসেকেরও নিচে নেমে আসে। ১৯৯৬ সালে যে চুক্তি হয়, তাতে সর্বনিম্ন ২৭ হাজার ৬৩৩ কিউসেক পানির কথা বলা হয়। কিন্তু এ চুক্তিতে কোনো গ্যারান্টি না থাকায় প্রায় বছরই এ চুক্তির কোনও সুফল পাওয়া যায় না।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং বিশেষভাবে তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়টি বোঝার জন্য আরো কিছু বিষয় আমলে নেয়া দরকার। যেমন, অভিন্ন নদীর পান্টিবণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও বিধানাবলী। হেলসিংকি নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি নদী তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলপ্রবাহ কনভেনশনে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার নীতিমালা’ গ্রহণ করে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবম অনুচ্ছেদে অভিন্ন প্রবাহে ‘অপরের জন্য ক্ষতিকর কিছু’ না করার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু শুধু তিস্তা নয়, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত এসব আমলে নেয়া প্রয়োজন বোধ করছে না। বাংলাদেশের স্বার্থ ও প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষতির বিবেচনা না করেই ভারত মেঘনার উৎস নদী সুরমা-কুশিয়ারার উজানে বরাক নদীতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও সেচপ্রকল্প চালুর পরিকল্পনা করছে।
উজানের দেশ এবং পরাশক্তি হিসাবে ভারতের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ আদায়ে আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর উচিত ছিল দ্বি-পক্ষীয় আলোচনার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়গুলো উত্থাপন করা, বিশেষত নদীর পানির বিষয়টি। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারগুলো এ বিষয়ে বরাবরই সে পথ অনুসরণে বিরত থেকেছে, আগ্রহ দেখিয়েছে দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতায়। কারণ কি, সেটা আগেই বলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত ফোরাম পাশ কাটিয়ে গোপন দ্বি-দলীয় লেনদেন-নির্ভর আলোচনায় শাসকদের বিশেষ আগ্রহের এক জাজ্বল্যমান উদাহরণ হল জাতিসংঘ জলপ্রবাহ সনদে (ইউএন ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশন, ১৯৯৭) বাংলাদেশের স্বাক্ষর না করা। কমবেশি ২৭ বছরের প্রস্তুতি, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’ গৃহীত হয়েছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। ১০৬টি দেশ এর পক্ষে ভোট দিয়েছিল। বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল মাত্র তিনটি দেশ — বুরুন্ডি, চীন ও তুরস্ক। কনভেনশনটি কেবল আন্তর্জাতিক জল-আইনের বিবর্তনের ধারায় বড় ধরনের সাফল্য নয়, সাধারণ পরিষদে পাশ হওয়ার সময়টিও আখ্যায়িত হয়েছিল ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে। জাতিসংঘের কোনো কনভেনশন কার্যকর করতে অন্তত ৩৫টি সদস্য দেশের অনুস্বাক্ষর বা রেটিফিকেশন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত ২২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। অনুস্বাক্ষর করেছে প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম, ১৬। অথচ নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, এর প্রস্তাবকারী দেশের সংখ্যাই ছিল ৩৮টি। প্রস্তাবকারী দেশগুলোই যদি অনুস্বাক্ষর করত, এটি কার্যকর হতো আরও ১০ বছর আগে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এর প্রস্তাবকারী ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল। এই কনভেনশনের সাত নম্বর ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রবাহের ক্ষেত্রে একটি দেশ এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না, যা আরেকটি দেশের জন্য ‘ধর্তব্য ক্ষতির’ কারণ হয়। ফলে যেসব দেশ গায়ের জোরে আন্তর্জাতিক প্রবাহের একতরফা ব্যবহার করছে, তারা বেঁকে বসেছে। অথচ ৫৭টি অভিন্ন নদী তথা ভূ-উপরিস্থ পানিসম্পদের সব উৎসের ভাটিতে থাকা একটি দেশের জন্য ‘ইউএন ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশনে’র ব্যবহারিক উপযোগিতা নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতিটা এমনও নয় যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে আরও উন্নত দ্বি-পক্ষীয় রক্ষাকবচ নিয়ে বসে আছি। বরং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবম অনুচ্ছেদে অভিন্ন প্রবাহে ‘অপরের জন্য ক্ষতিকর কিছু’ না করার যে অঙ্গীকার রয়েছে, ভারত তা সকাল-বিকেল লঙ্ঘন করছে।
এখানেই পরিহাসের পরিসমাপ্তি নয়। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এ বিষয়ে একবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে মত নেওয়ার জন্য দেশীয় যেসব বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা সবাই প্রায় একবাক্যে সায় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে কনভেনশনে স্বাক্ষর করা। অন্যান্য দেশও যাতে এতে স্বাক্ষর করে, সেজন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা। তারপর কী এক অদৃশ্য ইশারায় বিষয়টি অগ্রসর হয়নি।
আজকেও যদি দেশবাসীর তুমুল হইচইয়ের ফলে তিস্তার পানি নিয়ে দু’দেশের কর্তাব্যক্তিরা আলোচনার টেবিলে বসেন, সেখানে দু’দেশের জনগণের স্বার্থ, কৃষক-জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি ইত্যাদি বিষয় কি প্রাধান্য পাবে? তিস্তার পানির বণ্টনের ভিত্তি কি হবে? ভারতের চাওয়া আর বাংলাদেশের মেনে নেওয়া? তিস্তার কোন প্রবাহকে বণ্টনের জন্য হিসাবে ধরা হবে? তিস্তার উজানে বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার ফলে গজলডোবা পয়েন্টে যে যৎসামান্য পানি পাওয়া যাবে, তা কি তিস্তার ঐতিহাসিক প্রবাহের সমপরিমাণ হবে? এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
পানি সম্পদ নিয়ে আমাদের শাসকদের কোনো নীতিমালা আছে কি?
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ – এ কথা স্কুলের পাঠ্যবইতে কে না পড়েছে। বাংলাদেশ পানিবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ, যা পরাক্রমশালী নদী গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (GBM) বেসিন বা অববাহিকার সৃষ্টি। বাংলাদেশের চার-পঞ্চমাংশ ভূখ- তৈরি হয়েছে গঙ্গা(পদ্মা)-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা(বরাক) নদী সিস্টেমের মাঝে। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতি নদী ও পানির উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু এই পানিসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশের শাসকরা কখনোই কোনো জনস্বার্থ রক্ষাকারী নীতি প্রণয়ন করেনি। তা না করলেও অলিখিতভাবে চলছে নদী-খাল-বিল-জলাশয় লুটপাট-দখল-দূষণ-ভরাটের মহোৎসব।
আসলে দেশের অর্থনীতিতে যে নীতি চলছে, এখানেও তাই। নদী-পরিবেশ-প্রকৃতি সব কিছুই বিচার করা হচ্ছে মুনাফার চোখে। দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, মানুষের জীবন ও তার বসবাসের পরিবেশ কি হবে — এসব ভাবার সময় ও প্রয়োজন কোনোটাই শাসকদের, সরকারের নেই। কিন্তু আমরা যারা দেশের বুকে বাস করি, যাদের ভূত-ভবিষ্যত এ দেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যারা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলে আবেগে উদ্বেল হই — তারা চোখের সামনে দিনের পর দিন এই লুটপাট, এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চলেছি। মেনে নিচ্ছি।
তিস্তার পানি পাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনও এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে। কিন্তু শাসকদের পক্ষ থেকে লাভালাভের হিসাবের বাইরে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এর সাথে আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে দুই দেশের জনগণের প্রকৃত সমস্যা আড়াল করতে শাসকগোষ্ঠী জনগণের বঞ্চনাবোধকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে চায়। যে কারণে আমাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পাশে ভারতের গণতান্ত্রিক স্যেকুলার জনগণ ও শক্তিকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে হবে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে পারে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। বিশেষত বাংলাদেশে আজ বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে তিস্তার পানিসহ সকল অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, ভারত-বাংলাদেশের সকল অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানের দাবিতে ব্যাপক জনমত এবং আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।