Wednesday, November 20, 2024
Homeফিচারতিস্তার পানি প্রত্যাহার করে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি বানানোর চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানোর শপথে বাসদ-এর...

তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি বানানোর চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানোর শপথে বাসদ-এর তিস্তা ব্যারেজ রোডমার্চ

তিস্তা ব্যারেজে রোডমার্চে পথে পথে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ
তিস্তা ব্যারেজে রোডমার্চে পথে পথে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ

আলুচাষীদের চোখের জল এখনও শুকায় নি। এরই মধ্যে উত্তরবঙ্গের কৃষকদের আহাজারি শুরু হয়েছে ক্ষেতের ফসল বাচানোর দাবিতে। বুকের রক্ত জল করে জমিতে ফসল বুনেছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। অথচ সেচের জলের অভাবে ধানী জমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে নদীতে বাধঁ দিয়ে চলেছে। এভাবে বাধঁ দিয়ে ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরার উপক্রম হয়েছে। চলছে স্মরণ কালের ভয়াবহ পানি সঙ্কট। পানি না থাকায় ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধানের আবাদ হুমকির সম্মুখীন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কৃষকদের চোখে ঘুম নেই। কিন্তু সরকারের কুম্ভকর্ণের ঘুম এতেও ভাঙছে না। ভোটের বেলায় সরকার কৃষক বান্ধব! আর কৃষকের বিপদের দিনে তাদের টিকিটিরও দেখা নেই। আসলে এরা পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী সরকার । পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের কাছে নতজানু এদেশের শাসকশ্রেণী। কৃষকদের বুকফাটা আর্তনাদ তাদের ক্ষমতার মসনদের দুয়ারে পৌঁছায় না। জলঢাকার কৃষক আব্দুল আলিমের কন্ঠেও এই কথার প্রতিধ্বনি, ‘জমি ফেটে যাওয়া মানে আমাদের বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া। যারা ভোট চান, যারা সুশীল সমাজ, যারা সরকার সবার কাছে আমাদের দাবি পানি দেন।’ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি এ এলাকার জনগণের দীর্ঘদিনের। তাদের দাবির প্রতি না সরকার, না কেউ কর্ণপাত করেছে। মানুষও অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, চুপ করে থাকার দিন শেষ। দাবি আদায় করতে হলে রাস্তায় নামতে হবে। মার্চের মাঝামাঝি বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তিস্তা ব্যারেজে পানি না থাকার প্রতিবাদে এবং তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারের ব্যর্থতা ও নতজানু ভূমিকার প্রতিবাদে ২৩ মার্চ রবিবার সকাল ১১টায় বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি রংপুর জেলা শাখার উদ্যোগে প্রেসক্লাব চত্ত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

Road March 3Road March 4বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি লাখো কৃষকের বুকের কান্নাকে ধারণ করে ডাক দেয় আন্দোলনের। এই দাবিতে ৩০ মার্চ রংপুর থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত রোডমার্চ সম্পন্ন করে। তার আগে গত ২৪ মার্চ সংবাদ সম্মেলন থেকে ৭ দিনের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই কর্মসূচিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন যেমন ছিল, তেমনি এগুলো সফল করার জন্য গ্রামে-গ্রামে, বাড়ি-বাড়ি প্রচার পত্র বিলি করা হয়। কর্মসূচি সফল করতে অংশগ্রহণ ও আর্থিক সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়। অভাব-দারিদ্রের মধ্যে বাস করা মানুষ তাদের সীমিত সামর্থের মধ্যে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় অর্থ নিয়ে আন্দোলনকারীদের পাশে এসে দাড়িয়েছে, তাদের একাত্মতা জানিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ মার্চের রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার রেশ মানুষের মন থেকে এখনো মুছে যায়নি, তার সাথে উপজেলা নির্বাচনের সহিংসতা। রাজনৈতিক দলের মিছিল-সমাবেশ দেখলে সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে ওঠে। ‘দশ হাত’ দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু ৩০ মার্চ রংপুর-নীলফামারীর পথে পথে দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। মিছিল দেখে দোকানপাট ঘরবাড়ি ছেড়ে এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ, এমনকি বাড়ির নারীরাও। পথের পাশের মানুষ মিছিলকারীদের পানি, লেবুর শরবত দিয়ে আপ্যায়িত করেছে। সমাবেশগুলোতেও ছিল বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এমন ছবি তো সচরাচর দেখা যায় না। মরনোন্মুখ তিস্তা বাঁচাতে, কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করার দাবি নিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির উদ্যোগে রংপুর-তিস্তা ব্যারেজ রোডমার্চকে নিজেদের কর্মসূচি হিসাবেই দেখেছে ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। আর তাই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বাসদের রোডমার্চ হয়ে উঠেছিল বিরাট এক জনস্রোত।
Road March 2৩০ তারিখ রবিবার সকাল ১০টায় রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শুরু হয় তিস্তা রক্ষার রোডমার্চ। উত্তরবঙ্গের প্রাণ তিস্তা – যার প্রবাহের সাথে মিশে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন। সেই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি আদায়ের আন্দোলনে শামিল হতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েকশ মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছিল। শত শত বিঘা জমির বোরো ধান পানির অভাবে মরে যাচ্ছে অথচ ভারত সরকার গজলডোবায় বাধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করছে। তার নিজের দেশের জনগণের প্রতি তীব্র শোষণ, সীমাহীন দুর্নীতিকে আড়াল করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে, মমতাকে সামনে রেখে এই ঘৃণ্যকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ভারত সরকার। যার বলি হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষি, কৃষক ও গোটা পরিবেশ। আমাদের সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে, যেন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে। জনগণের হাহাকার তার কানে যাচ্ছে না। রোডমার্চ শুরুর সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সকাল ১১টায় রোডমার্চের উদ্বোধন করেন সমাবেশের সভাপতি ও বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির রংপুর জেলা সমন্বয়ক কমরেড আনোয়ার হোসেন বাবলু। উদ্বোধনী সমাবেশে বক্তৃতা করেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কৃষিবিদ কমরেড ওবায়েদুল্লাহ মুসা, কমরেড মঞ্জুর আলম মিঠু, বাসদ রংপুর জেলা কমিটির সদস্য পলাশ কান্তি নাগ, আহসানুল আরোফিন তিতু।
রোডমার্চের সঙ্গে ছিল চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গীতের টিম। চারণের শিল্পীরা রোডমার্চের অগ্রগামী বাহিনী হিসাবে প্রতিটি পথসভার স্পটে তিস্তা নিয়ে গান পরিবেশন করে মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। পাগলাপীর, গঞ্জিপুরে সমাবেশ শেষে দুপুর ১টায় রোডমার্চ চন্দনের হাটে পৌঁছে। চন্দনের হাটে পথসভায় বক্তব্য রাখেন ওবায়দুল্লা মূসা। তিনি বলেন, তিস্তার পানির অভাবে ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। ৫/৭ ফুট নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। রাত্রির প্রথম প্রহরে অত্যন্ত গরম অনুভূত হলেও শেষ রাতে ঠা-া লাগে। এটা মরুকরণের প্রাথমিক লক্ষণ।
দুপুর ২টায় রোডমার্চ বড়ভিটায় পৌঁছে। সেখানে শত শত মানুষ জড়ো হয় সমাবেশ শুনতে। দুপুরে খাবার রান্না থেকে শুরু করে পরিবেশন সবই করে স্থানীয় জনগণ। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তারা রোডমার্চ টিমকে আপ্যায়ন করে। একটিই আকুতি তাদের চোখে-মুখে, আমরা যেন এই আন্দোলনকে সফল করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারি। বড়ভিটা থেকে বিন্যাকুড়ি, বড়ঘাট হয়ে পথে পথে সভা-সমাবেশ, লিফলেট বিলি করে বিকেল ৪টায় রোডমার্চ জলঢাকায় সমাবেশ করে। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ উদগ্রীব হয়ে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শোনে। স্থানীয় মানুষের আক্ষেপ, কেন বাসদের নেতাকর্মীরা পূর্বেই তাদের সাথে যোগাযোগ করেনি। আগে জানালে তারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে আরও বড় সমাবেশ করতে সহযোগিতা করত। তারা আক্ষেপ করে বলেছে, ভাই বড় বড় অনেক পার্টি আছে। কই, তারাতো এ বিপদে এগিয়ে আসেনি। আমরা আপনাদের পার্টি করিনা, আপনারা ছোট পার্টি, অথচ আপনারাই আমাদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছেন। আপনাদের এ আন্দোলনের সাথে আমরা আছি।
বিকাল ৫টায় রোডমার্চ তিস্তা ব্যারেজে পৌঁছে। রোডমার্চের শত শত মানুষ তিস্তার রুক্ষ শুষ্ক চিত্র দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তার একি হাল! যতদূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। তিস্তায় পানি নেই, এটা সবাই জানতো। কিন্তু নদীতে পানি না থাকার দৃশ্য এতো নিদারুণ কষ্টের অনুভূতি জাগায়, সেটা নিজ চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা কঠিন।
এরপর রোডমার্চ দোয়ানী বাজারে পৌঁছে। সেখানে সমাপনী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার মানুষ রোডমার্চের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। নেতৃবৃন্দের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা শপথবাক্য পাঠ করেন Ñ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের আন্দোলন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে।
দোয়ানী বাজারের সমাবেশসহ বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ গাইবান্ধা জেলা আহবায়ক কমরেড আহসানুল হাবীব সাঈদ, পঞ্চগড় জেলা সমন্বয়ক অধ্যাপক তরিকুল আলম, বগুড়া জেলা সমন্বয়ক কৃষ্ণ কমল, দিনাজপুর জেলা সমন্বয়ক রেজাউল ইসলাম সবুজ, ঠাকুরগাও জেলা সমন্বয়ক মাহাবুব আলম রুবেল, নীলফামারী জেলা সংগঠক ইয়াসিন আদনান রাজীব, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে একতরফাভাবে একের পর এক নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে চলছে। ফারাক্কা দিয়ে পদ্মা ধ্বংস করার পর এখন ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরার উপক্রম হয়েছে। তিস্তায় এখন স্মরণকালের ভয়াবহ পানি সংকট চলছে। ঐতিহাসিকভাবে শীত মৌসুমে তিস্তা নদীতে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। বর্তমানে এই প্রবাহ কমে ৩০০-৫০০ কিউসেকে নেমে এসেছে। ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি প্রত্যাহারের ফলে একদিকে যেমন এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বিপন্ন, অন্যদিকে মৎস্য সম্পদ, গাছপালা, প্রাণী-পাখী অর্থাৎ গোটা পরিবেশই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪২ বছরে শাসকগোষ্ঠীর ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নতজানু নীতি ও জনস্বার্থ বিরোধী অবস্থানের কারণে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। নেতৃবৃন্দ উত্তরবঙ্গকে মরুকরণের কবল থেকে রক্ষা ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান। একইসাথে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে ভারতের গণতন্ত্রকামী ও শোষিত জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments