গত বছর দেড়েক ধরে দেশের মানুষ এক অস্বাভাবিক ও অস্থির সময় পার করছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কখনো কখনো কিছুটা কমলেও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এখনো শনাক্তের হার ৯ শতাংশের উপরে। প্রতিদিনই হাজারের উপর করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সবমিলিয়ে দেশে ৮ লক্ষাধিক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। সরকারি হিসাবেই মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৩ হাজার। সম্প্রতি আবার সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। গত দু’মাস ধরেই এ নিয়ে আতঙ্ক আর অস্থিরতায় সময় কাটছে। সরকার একে কেন্দ্র করে দফায় দফায় লকডাউন বাড়িয়েছে। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পিতভাবে লকডাউন না করায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে সীমাহীন। সরকার গণপরিবহন বা মার্কেট শুরুতে বন্ধ রেখেছে, আবার মালিকদের চাপের মুখে খুলে দিয়েছে। ঈদের সময় দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সীমাহীন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে মানুষ গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। আবার একই সময়ে ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। ট্রলারে নদী পার হওয়ার সময় ট্রলার ডুবে প্রাণ হারিয়েছে ২৪ জন। এই মৃত্যুর দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। বাস্তবে প্রায় সমস্ত কিছুই খোলা রেখে লকডাউনের নামে প্রহসন করে সরকার সংক্রমণের দায় জনগণের কাঁধে চাপাতে চায়। এখনো আমরা দেখছি বাজার-ঘাটসহ সমস্ত জনপরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেই। অথচ, স্বাস্থ্যবিধির নাম করে গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া আদায় করছে, যা মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করছে। এমনিতেই করোনা অতিমারীতে জনগণের আয় কমে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাড়তি বাসভাড়া দিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
গোটা অতিমারী কালে এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পঙ্গুচিত্র নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। সরকার চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। বরং কোভিভ-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সেই চিত্র ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং সম্প্রতি দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে হেনস্থা ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঔপনিবেশিক আমলের তৈরি ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’-এ মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে সাংবাদিক ও জনতার প্রতিবাদের মুখে তাকে জামিন দেওয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার চক্রান্ত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান। একদিকে সরকারের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করছে, অন্যদিকে জনগণের ক্ষোভ-রোষ ও আন্দোলন থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য দমনের নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করছে।
করোনা চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেনি। এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য বিশ^জুড়ে কয়েকটি টিকা ইতোমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদনের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। টিকা আমদানি করে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারেও নানা টালবাহানা করছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা আমদানি করলেও তা সরাসরি না করে বেক্সিমকো কোম্পানির মাধ্যমে আমদানির চুক্তি করেছে। অতিরিক্ত দামে সরকার আবার বেক্সিমকো থেকে এই টিকা ক্রয় করছে। এভাবে জনগণের অর্থ একটি কোম্পানির কাছে তুলে দিচ্ছে। বাস্তবে সরকারের কাজই হল জনস্বার্থ না দেখে মালিকশ্রেণির সেবা করা। এই ঘটনার মাধ্যমে তা আবার স্পষ্টরূপে প্রতিভাত।
এই মালিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার আরেকটি দৃষ্টান্ত বাঁশখালির ঘটনা। বাঁশখালিতে এস আলম গ্রুপ কর্তৃক নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন, কর্মঘণ্টা কমানো ও ছুটিসহ ন্যায্য দাবিতে বিক্ষোভ করলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৭ জন শ্রমিককে হত্যা করেছে। শুধু বাঁশখালি নয়, টঙ্গিতে হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপরও পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ন্যায্য আন্দোলনে পুলিশি দমন-পীড়ন-গুলির ঘটনাই প্রমাণ করে পুলিশ জনগণের সেবক নয়, মালিকশ্রেণি ও ক্ষমতাসীন দলের পাহারাদার।
সরকারের কাজই হলো মালিকশ্রেণির সেবা করা। এমনকি হত্যা খুনের মতো ঘটনা ঘটিয়েও মালিকশ্রেণি পার পেয়ে যায়। তেমনটি সম্প্রতি আবারও দেখা গেছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের ক্ষেত্রে। কলেজ ছাত্রী মুনিয়ার আত্মহত্যায় সরাসরি ইন্ধন থাকার পরও আনভীরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সরকার যতই বলুক ‘আইন নিজের গতিতে চলে’, কিন্তু দেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বোঝে যে, আইন বাস্তবে চলে টাকা ও ক্ষমতার জোরে। তাই আনভীরকে গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি সে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের পরিচালক পদে সর্বোচ্চ ভোটে জয়ী হয়েছে। পত্রিকায় সেই খবর এসেছে। শুধু মুনিয়া হত্যা নয়, আনভীরের পরিচালক পদে জয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় – সমাজের নৈতিক ভিত কতটা ক্ষয়ে গেছে।
অন্যদিকে উন্নয়নের নাম করে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন চলছে লাগামহীন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেক প্রাচীন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের অজুহাতে। উদ্যান ঘিরে যে মাস্টারপ্ল্যান, তাতে দেখা যাচ্ছে এখানে রেস্টুরেন্ট বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস অতিমারীতে বিশ্ব জুড়ে আওয়াজ উঠছে প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেওয়ার। আর সেই সময় আমাদের সরকার সুরক্ষা তো নয়ই, নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের আয়োজন করছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আবার মন্তব্য করেছেন, গাছ কাটার বিরোধিতা নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের/জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেই তাকে উন্নয়ন বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী আখ্যা দিয়ে সরকার জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চায়। মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চায়।
এইভাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা জনস্বার্থবিরোধী। যদিও আমরা দেখি সরকার পরিচালনা করে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু উপরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপের মতো বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলোর স্বার্থ ও চাওয়ার বাইরে সরকারের কিছু করার জো নেই। কারণ বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরাই সবকিছু নির্ধারণ করে। কে ক্ষমতায় আসবে-যাবে, তাও নির্ধারণ করে পুঁজিপতিরাই। যে দল সবচেয়ে ভালোভাবে পুঁজিপতিদের সেবা করতে, স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে – তাকেই পুঁজিপতিরা ক্ষমতায় বসায়। এই পুঁজিপতিদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন। তাই পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালনা করছে। ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্ষা ও অধিকার রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকারের দমন, দুর্নীতি আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম রচনাই সময়ের প্রয়োজন।