গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম কমানোর দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের আহবানে গত ৭ জুলাই দেশব্যাপী পালিত হলো অর্ধদিবস হরতাল। জনগণের দাবি নিয়ে এই হরতার, তাই হরতালের প্রতি জনগরণর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। হরতালের আগের দিন চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ হরতালের প্রচার মিছিলে হামলা চালায়, দলীয় অফিসে অবৈধভাবে তল্লাশী চালায়। হরতালের দিনও ঢাকা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, মানিকগঞ্জে পুলিশ বাঁধা দেয়।
পুরো দেশবাসী গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে অন্যায় ও অযৌক্তিক মনে করার পরও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একে ‘যৌক্তিক’ বলে সমানে বক্তব্য রাখছেন। হরতালের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন,“অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে আন্দোলন না করে গ্যাসের দামবৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিতেই হবে।” অর্থাৎ উন্নয়ন চাইলে দাম দিতে হবে। এটা উন্নয়নের দাম – ‘ডেভেলপমেন্ট কস্ট’।
ফলে সরকারি ভুল পদক্ষেপের নিন্দা করলে আপনি উন্নয়নবিরোধী হবেন। সরকারের গণবিরোধী কোন পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেই আপনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, দেশদ্রোহী হয়ে পড়বেন মূহুর্তেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কে না চায়? প্রশ্ন হচ্ছে উন্নয়নটা কার হচ্ছে? কৃষক ফসলের উৎপাদন মূল্যও পাচ্ছেনা, শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেনা। একদিকে দেশে অতি ধনী হু হু করে বাড়ছে, অন্যদিকে গরীব সাধারণ মানুষের আয় কমছে। বেকারত্ব বাড়ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিল্প, কৃষি, সার, যানবাহন সবকিছুর দাম বাড়ে। ফলে বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে, বাসাভাড়া, গাড়িভাড়া, খাবার খরচ সবই বেড়েছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পক্ষে সরকারের প্রধান যুক্তি হলো, দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাস উৎপাদন কম, গ্যাসের সংকট। তাই বিদেশ থেকে বেশি দামে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে তা কম দামে দেয়ায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এটি সমন্বয় করার জন্যই দাম বাড়াতে হচ্ছে। একথাটাও ঠিক নয়। পাশের দেশ ভারত যেখানে সৌদি আরব থেকে ৬ ডলারে এলএনজি কিনছে, সেখানে বাংলাদেশ ১০ ডলারে কাতার, ওমান থেকে কিনছে। কেন? – তার উত্তর হয়তো সবাই জানেন। এখানে দেশের লোককে দু’বার জবাই করা হয়। বেশিদামে কিনে লোকসান পোষাবার জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, আবার বেশি ক্রয়মূল্য পরিশোধ করে সরকারি কোষাগার খালি করা হয় – যার চাপ জনগণের উপরই পড়ে। বর্ধিত মূল্যের একটা অংশ লুটপাট হয়।তাই ‘বর্ধিত মূল্যে আমরা গ্যাস কিনলাম কেন?’- হাইকোর্টের এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর সরকার এ পর্যন্ত দিতে পারেনি।
সত্যিই কি দেশে গ্যাস সংকট, এলএনজি আমদানী জরুরী?
একসময় বলা হলো, ‘দেশ গ্যাসের উপর ভাসছে’ – ফলে গ্যাস রপ্তানি করো। আর আজ বলা হচ্ছে ‘দেশে গ্যাসের সংকট, তাই গ্যাস আমদানি করতে হবে।’ সত্য ঘটনাটা কী? বাংলাদেশের স্থলভাগ ও সমুদ্রবক্ষে যে তেল ও গ্যাসের মজুত আছে এবং ভবিষ্যতে নতুন তেল-গ্যাস মজুদ পাওয়ার যে সম্ভাবনা আছে, সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে, তা হলে গ্যাসের সংকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের পর গত ২০ বছরে নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করা হয়নি। সরকার গত ১০ বছরে এলএনজি নিয়ে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু কোন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান বা গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়নি। সামর্থ্য ছিলনা কি? ভারত, মায়ানমারের থেকে সমুদ্রজয় নিয়ে বিরাট মাতামাতি হলো, এমনকি শেখ হাসিনাকে সমুদ্রমাতা উপাধিতে ভূষিত করা হলো, কিন্তু সাগরের যে বিপুল গ্যাস, তা উত্তোলন করে গ্যাস সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হলোনা। অথচ পাশাপাশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ইতিমধ্যে ভারত, মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলন করছে। এভাবে গ্যাস সংকট অনিবার্য করে উচ্চমূল্যের এলএনজির দাম ভোক্তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হলো। স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সম্পূর্ণ সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও, তাকে বসিয়ে রেখে বিদেশী প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার ‘গ্যাজপ্রম’, আজারবাইজানের ‘সোকার’কে দিয়ে গ্যাসকূপ খননের কাজ করছে। একটি কূপ খননে যেখানে বাপেক্সের খরচ হয় ৬০-৮০ কোটি টাকা, সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে দিতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সারা দেশের স্থলভাগে ১১০টি কূপ খনন করা হবে। এসব কূপ যদি ‘গ্যাজপ্রম’ ও অন্যান্য বিদেশী কোম্পানি দিয়ে করা হয়, তাহলে সরকারের বার্ষিক ক্ষতি হবে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। কম দামে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হবে এভাবেই। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “প্রতিবছর বাংলাদেশে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হবে, তাতে খরচ হবে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এ খরচটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতি ব্যাপক চাপ তৈরি করবে।” এ বিরাট ঘাটতি মেটাতে কিছুদিন পর পরই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়বে। ফলে জনগণের জন্য ভবিষ্যতে আরো দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।
গ্যাস নিয়ে বিরাট মুনাফার ব্যবসা
আবাসিকে ও শিল্পে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলো গ্যাস সংকটের কথা বলে। গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য- এতে মানুষ বেশি দামে এলপিজি কিনতে বাধ্য হবে। ভবিষ্যতে ৪০ লাখ টন এলপিজির নিশ্চিত বাজার সম্ভাবনায় দেশের সমস্ত বড় ব্যবসায়ীরাই এলএনজি ব্যবসায় নেমে পড়লেন। ইতোমধ্যে ৫০-৬০টি কোম্পানিকে সরকার এলএনজি সিলিন্ডার বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়েছে। বসুন্ধরা, যমুনা, সামিট এই বিরাট বিরাট শিল্পগোষ্ঠীসহ ১৫-১৬টি কোম্পানি ইতোমধ্যেই বাজারে নেমেছে। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারক খানের সামিট গ্রুপ বেসরকারী বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬০-৭০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদেরকে দেশের প্রথম এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে। সরকারের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ঠ এস আলম গ্রুপও প্ল্যান্ট করার অনুমতি পেয়েছে। দেশের সিলিন্ডার ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে সমিতিও গঠন করেছে, যার সভাপতি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কুখ্যাত ঋণখেলাপী সালমান এফ রহমান। তাঁরা ইতোমধ্যে দাবি তুলেছিলÑ তাদের সিলিন্ডার গ্যাসের তুলনায় লাইনের গ্যাসের দাম কম, ফলে লাইনের গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে, না হলে এক দেশে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, লোকসান হচ্ছে। সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বললেন, “বৈষম্য চলতে পারেনা, দাম সমন্বয় করা হবে।” অর্থাৎ লাইনের গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এলএনজি গ্যাসের সমান করা হবে। তারা বৈষম্য শুধু জনগণের ব্যবহার করা গ্যাস, বিদ্যুতেই খোঁজেন! মন্ত্রীরা বেতন ও আনুষঙ্গিক ভাতা মিলে মাসে কয়েক লাখ টাকা পান, অথচ গার্মেন্টস্ শ্রমিক যে মাসে ৮০০০ টাকা পান, সে বৈষম্য সম্পর্কে তারা নির্বিকার। সমাজে ধনীর আয় বাড়ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আয় কমছে, সে বৈষম্যও তাদের চোখে পড়েনা।
১২ কেজি একটি সিলিন্ডারের দাম ৪৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, অথচ দেশি –বিদেশী বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১১০০ টাকায়। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে ১৪.২ কেজি সিলিন্ডারের দাম বাংলাদেশি টাকায় পড়ে ৪৮৩ টাকা। আইন অনুযায়ী, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করার কথা বিইআরসি’র। কিন্তু এক্ষেত্রে সিলিন্ডার ব্যবসায়ীরাই তাদের মতো করে দাম নির্ধারণ করে, সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ এখানে নেই। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বিপিসি’র (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের মূল্য ৭০০ টাকা, কিন্তু বাজারে তার দেখা পাওয়া যায়না। দেশে বাৎসরিক এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ১০ লাখ মেট্রিকটন, কিন্তু বিপিসি সরবরাহ করে মাত্র ১৬ হাজার মেট্রিকটন। ২০০৯ সাল থেকেই সরকার বলে আসছে, বিপিসি’র মাধ্যমে এলপিজি’র সরবরাহ বাড়িয়ে গ্রাহক ভোগান্তি দূর করা হবে। অথচ তা করা হয়নি। যেখানে সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে বিপিসির ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তার বিপরীতে বাজার তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে।
তাহলে আমরা দেখছি, সরকারের ভুল জ¦ালানি নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে গ্যাসক্ষেত্র বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, স্থল ও সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ না নেয়াÑ এসবের মাধ্যমে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। একইসাথে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে মানুষকে এলপিজি ব্যবহারে বাধ্য করা হচ্ছে। স্পষ্টতই মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী ও দেশিবিদেশি সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই গ্যাসের এ মূল্যবৃদ্ধি।