কৃষি-কৃষক-ক্ষেতমজুর ও দেশ বাঁচাতে ৯-দফা দাবিতে কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষষদের উদ্যোগে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী দাবিপক্ষ আজ শুরু হয়েছে। দাবিপক্ষে সারাদেশে পথসভা, হাটসভা, পদযাত্রা, মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হবে। দাবিপক্ষের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সকাল ১১টায় ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, সাইফুল হক, অ্যাড. এম এ সবুর, সাজ্জাদ জহির চন্দন, বজলুর রশীদ ফিরোজ, অ্যাড. আনোয়ার হোসেন রেজা, শরিফুজ্জামান শরিফ, অর্ণব সরকার, লিয়াকত হোসেন, ফিরোজ আহসান, নিখিল দাস প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, এদেশের কৃষক কিনতে ঠকে, আবার বেচতেও ঠকে। যে কৃষক উৎপাদন করে ১৭ কোটি মানুষের মুখের ভাত যোগায়, যাদের শ্রমে-ঘামে খাদ্য উৎপাদনে দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ; সরকার যার কৃতিত্ব দাবি করে, কিন্তু এই কৃষকরাই দেশে সবচেয়ে অবহেলিত ও শোষিত। ১৯৭২ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি, খাদ্য উৎপাদন হতো ১ কোটি মেট্রিক টন। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৭ কোটি, খাদ্য উৎপাদন বেড়ে হয়েছে পৌনে ৪ কোটি মেট্রিক টন। অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া দুই গুণ, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। তারপরও কেন দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে থাকে? সরকার ঘোষিত মূল্যে ধানসহ ফসল বিক্রি করতে না পেরে লোকসান দেয় কৃষক। লাভবান হয় মধ্যস্বত্তভোগী ফড়িয়া ও চাতাল মালিক, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, এখন আলু তোলার মৌসুম চলছে। বাম্পার ফলনও হয়েছে, মৌসুমের শুরুতে প্রথম সপ্তাহে মণপ্রতি দাম ছিল ৪০০ টাকা, বর্তমানে কমে হয়েছে মণপ্রতি আলুভেদে ১৪০ টাকা থেকে ২৭০ টাকা। ফলে আলু চাষীদের বিঘাপ্রতি ৮/৯ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। তাছাড়া নেই পর্যাপ্ত সরকারি কোল্ডস্টোরেজ ও বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ। নেই কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা নির্মাণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
সমাবেশে বক্তরা বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারী কৃষক ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা কৃষিঋণ নিয়ে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানিতে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ১ লাখ ৬৮ হাজার কৃষকের নামে দায়ের করা হয়েছে হয়রানিমূলক সার্টিফিকেট মামলা ও প্রায় ১২ হাজার কৃষকের নামে জারি হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এই ঋণের পরিমাণ মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকারের আশ্রয় প্রশ্রয়ে দেশের ব্যাংক থেকে ১০ বছরে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুট করেছে অসৎ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা (অবলোপনকৃত ঋণসহ)। সেই টাকা উদ্ধারে সরকারের তেমন কার্যকর তৎপরতা নাই। একদেশে দুই আইন চলতে পারে না।
বক্তরা আরও বলেন, কৃষকের পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে এদেশের শ্রমজীবী গ্রামের মেহনতি মজুররা। তাদের সারা বছর কাজের নিশ্চয়তা না থাকায় তাদের জীবনযাপন দূরহ হয়ে পড়ছে। তাদের সারা বছর যেমন কাজ নেই, নেই ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা। এই গ্রামীণ মজুরদের জন্য পল্লী রেশন চালু করতে হবে যাতে তাদের স্বল্প আয়ে খাবারের নিশ্চয়তা করা যায়। একইসঙ্গে তাদের সারা বছর কাজের জন্য ১২০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি সকল উপজেলায় চালু করতে হবে। গ্রামের গরিব মানুষের জন্য সরকারি সামান্য যে বরাদ্দ আছে তা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, স্থানীয় টাউটদের মাধ্যমে লুট হয়ে যায়। গ্রামীণ সকল কর্মসূচি ও বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং লুটপাট দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বয়স্ক ভাতার নামে সামান্য যে অর্থ দেওয়া হয় এই অর্থে একজন বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই দরিদ্র বয়স্কদের জন্য অবিলম্বে পেনশন স্ক্রীম চালু করতে হবে।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ কৃষি-কৃষক-ক্ষেতমজুর ও দেশ বাঁচাতে সংগ্রাম পরিষদের নিন্মোক্ত ৯-দফা দাবি মেনে নেয়ার আহŸান জানান :
১. ধান, আলুসহ কৃষি ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত কর; প্রতি ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র চালু করে উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ফসল ক্রয় কর। সরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ কর। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়াও।
২. ক্ষেতমজুরদের সারা বছরের কাজ দাও; স্বল্পমূল্যে গ্রামীণ রেশনিং ব্যবস্থা ও ১২০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প চালু কর। দুস্থভাতা, কাবিখা, কাবিটা, ভিজিএফ, ভিজিডি, টেস্টরিলিফ, বয়স্কভাতাসহ সকল গ্রামীণ প্রকল্পের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ বন্ধ কর।
৩. খাস জমি উদ্ধার করে প্রকৃত ভ‚মিহীনদের নামে সমবায়ের ভিত্তিতে বরাদ্দ দাও। বেকার যুবকদের সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দাও, কর্মসংস্থান কর।
৪. ভ‚মি অফিস, তহসিল অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, পল্লী বিদ্যুৎ ও ব্যাংক ঋণের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ কর। পুলিশী হয়রানী, জুলুম, নিপীড়ন, মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার, গ্রেপ্তার বাণিজ্য বন্ধ কর।
৫. কৃষকের নামে দায়েরকৃত সার্টিফিকেট মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার কর। ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ সুদাসলে মওকুফ কর। শস্য বীমা চালু কর। এনজিও ও মহাজনী ঋণের হয়রানি বন্ধ কর।
৬. কৃষি জমি অকৃষি খাতে ব্যবহার রোধ কর। কৃষি জমি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কর। আখচাষিদের রক্ষা কর, বকেয়া পাওনা পরিশোধ কর। আম চাষিদের রক্ষা কর। নদী-খাল খনন কর, দখল-দূষণ বন্ধ কর, নদীভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নাও। হাওর সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নাও।
৭. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর কর; লবণাক্ততা রোধে ব্যবস্থা নাও। তিস্তাসহ সকল অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্যহিস্যা আদায় কর; বাংলাদেশকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা কর।
৮. পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাও; মাতৃভাষায় শিক্ষা ও ভূমির অধিকার এবং জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত কর।
৯. নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন বাতিল করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে দ্রæত নির্বাচন দাও; জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা কর। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কর।