অকালবন্যায় ভেসে গেছে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা এসেছে অনেক। বিভিন্ন দিক থেকে এসেছে বিভিন্ন মূল্যায়ন। তবে এও ঠিক যে, প্রথমদিকে যে তোলপাড় ছিলো তা এখন অনেকটা স্থিমিত। একই বিষয় দীর্ঘদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকে না। নতুন নতুন বিষয় আসে। নতুন খবর আলোচনার টেবিলে জায়গা নেয়। পুরনো বিষয় ধীরে ধীরে সরে যায়। সয়ে যায়। হঠাৎ জেগে ওঠা নাগরিক আবেগও ¤্রয়িমান হয়। কোনরকমে টিকে থাকার জন্য বিষম লড়াইয়ের জীবন মানুষকে বসে থাকতে দেয় না। থিতু হতে দেয় না। এ নাহলে সে দেখতে পেতো যে, একটা ভয়াবহ দুর্যোগের পর একটা গোটা জনগোষ্ঠীর জীবন কিভাবে ওলটপালট হয়ে যায়।
হাওরের কান্না থেমে নেই। থামবেও না এতো সহজে। এ বিরাট অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবারের মধ্যে কোন একটি পরিবারও বোধ হয় আজ অবশিষ্ট নেই যাকে এবারের ভয়াবহতা স্পর্শ করেনি। কাল যে ছেলের স্কুলে পরীক্ষা ছিলো, আজ সে বাবার হাত ধরে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। হালের গরু, ঘরের হাঁস-মুরগী সবই বিক্রি করে দিচ্ছেন গৃহস্থরা। ঘরে মানুষের খাবার নেই, পশুদেরকে কি খাওয়াবেন। এটা একদুইজনের ক্ষেত্রে ঘটছে না, দলে দলে লোক গ্রাম ছাড়ছে। কোনরকমে বাঁচার রাস্তা খুঁজছে। এতবড় Mass migration এ সময়ের মধ্যে এখানে আর হয়নি, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কোথাও হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই।
সুনামগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যানরা পরিচয়পত্র স্বাক্ষর করছেন একের পর এক। কারণ গার্মেন্টসে চাকরি পেতে হলে পরিচয়পত্র লাগে। এসব নিয়ে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে বেশ লেখালেখি হয়েছে। পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে কাঁদছেন এক কৃষক। বড় মেয়েটা ক্লাস টেনে পড়ে, ছেলেটা ক্লাস সেভেনে। সবচেয়ে ছোট যে মেয়েটা সে পড়ে ক্লাস ফোরে। হু হু কান্নায় ভেঙ্গে পড়া এই পিতা কিছুদিন আগেও ভাবেননি নিজে সক্ষম থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের মুখে খাবার দিতে পারবেন না। ভেবে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছেন না তারই মতো শত সহস্র পিতা। হয়তো হাওরের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ঘরে তো ফিরবেন, কিন্তু কিভাবে ফিরবেন? কি আশা নিয়ে?
হাওরের মানুষ বর্ষায় ঘরের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়। কারণ তখন ফসল বিক্রির টাকাটা হাতে থাকে। সিলেট ও ময়মনসিংহের হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঢল নামে। কারণ সবাই তাদের সকল রোগ নিয়ে এই সময়টার জন্যই বসে থাকেন চিকিৎসা করবেন বলে। আজ সব শেষ। হাওরের বাতাসে বাতাসে আজ ‘সব শেষ’ এর সুর বাজছে।
কৃষক ফসল তুললেও মরে, ডুবলেও মরে
গত দুই দশকে প্রতি তিন বছরেও একবার পুরো ফসল ঘরে তুলতে পারেনি হাওরের কৃষকরা। এই সময়ের মধ্যে ২০০৮ সালেই বেশির ভাগ ফসল কৃষকের ঘরে উঠেছে। প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলে কোথ াও বাঁধ ভেঙ্গে, কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। গত বছরও ৬০ শতাংশের মতো ফসল নষ্ট হয়েছে। ২০১৫ সালে নষ্ট হয়েছে ৪০ শতাংশের মতো (সূত্র- কালের কন্ঠ ২৭ এপ্রিল ২০১৭)। এই ফসল নষ্ট হওয়া বছর বছর লেগেই আছে। কিন্তু যতটুকু ফসল কৃষক তুলতে পারে তার কি অবস্থা? ফসলের ন্যায্য মূল্য সে পায় তো?
কৃষি অধিদপ্তরের মতে বর্তমানে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২১ টাকা। সরকার প্রতি কেজি ধান ক্রয় করে ২৩ টাকায়। কিন্তু কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রয় করতে পারে না। তারা বিক্রয় করে আড়তদারের কাছে। আড়তদারের কাছ থেকে কৃষক প্রতি কেজি ধান বিক্রি করে পায় ১২ থেকে ১৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি কৃষকের লোকসান ৬ টাকা। প্রতি মণে কৃষকের লোকসান হয় ২৪০ টাকা। অথচ আড়তদাররা মণপ্রতি লাভ করে ৩২০ টাকা। এতবড় ঝুঁকি নিয়ে বীজতলা তৈরি করা থেকে ধানকাটা পর্যন্ত অপরিসীম কষ্ট করে কৃষক লোকসান গুণে মণপ্রতি ২৪০ টাকা। আর কোন কিছু না করেই আড়তদাররা লাভ করে মণপ্রতি ৩২০ টাকা। এ হলো প্রতি বছরের চিত্র। বাম্পার ফলন হলে টিভিতে প্রধানমন্ত্রী ‘ভি’ চিহ্ন দেখান কিন্তু সারাদেশের কৃষকের মুখ রক্তশূন্য হয়ে নীল হয়ে যায়। কারণ তখন ফসলের দাম আরও কমে। এ হলো ফসল ঠিকমতো ঘরে উঠলেও কৃষকের যে অবস্থা হয় তার চিত্র। আর এরকম অকালবন্যায় যখন সব ফসল ভাসিয়ে নিয়ে কৃষকদের রাস্তায় বসিয়ে দেয়, তখন তার অবস্থা কি হয় বলাই বাহুল্য।
ফসল ডুবেছে অকালবন্যায়, সরকারের কি কোন দায় ছিলো?
এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। সুনামগঞ্জের হাওরগুলি হলো এদেশের প্রধান নি¤œাঞ্চল এলাকা। লুসাই পাহাড় থেকে বরাক নদীর উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের মুখে সে সিলেটের আমলশীদের কাছে সুরমা ও কুশিয়ারা এ দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। এই দুই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এ হাওরগুলো। হাওরবেষ্টিত জেলা বাংলাদেশে ৭টি- সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই সাতটির মধ্যে সুনামগঞ্জ ছাড়া অন্যসব জেলার হাওরগুলোর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৪ মিটার। কিন্তু সুনামগঞ্জের হাওরগুলোর উচ্চতা ২ মিটার। একারণে মেঘালয় বা বরাক উপত্যকার যে কোন বৃষ্টিপাতের পানি সবার আগে সুনামগঞ্জের হাওরের দিকে ধাবিত হয়। ওই এলাকার নিম্নাঞ্চলকে পূর্ণ করার পরই সে সাগরের দিকে যায়। এটি একটি দিক।
আরেকটি দিক হলো বাংলাদেশ ভূখন্ডে গড় বৃষ্টিপাতের হার বছরে ২৩০০ মিমি। কিন্তু সিলেটে এই হার ৪০০০ মিমি আর সুনামগঞ্জে ৫০০০ মিমি’র ও বেশি। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেও এই এলাকাটি অত্যধিক মাত্রায় বন্যাপ্রবণ।
বছরে দুটো সময় (বর্ষা ও শরৎকালে) বন্যা আমাদের এখানে সাধারণ ব্যাপার। এজন্য আমাদের কোন ক্ষতি হয় না বরং আমরা এর মাধ্যমে প্রচুর পানিসম্পদ পাই। আমাদের নদী-নালা-পুকুর-বিল-জলাশয়গুলো এ সময় ভরে উঠে। কিন্তু অকালবন্যা আমাদের জন্য বিরাট দুর্ভোগ ডেকে আনে, যেমন এবারে চৈত্রের শেষের দিকের বন্যা আমাদের বিরাট ক্ষতি করে দিয়ে গেলো।
এই বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেয়া হয় হাওরজুড়ে। প্রতি বছরই এজন্য বরাদ্দ আসে। এবছরও বাঁধ নির্মাণের জন্য ৬৮ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এসেছে। ঘটনা যা ঘটে তা হলো, বন্যা যেহেতু সব বছর হয় না সেক্ষেত্রে বাঁধ নির্মাণ না করে কাটিয়ে দিতে পারলে এবং বন্যা না হলে এই টাকার পুরোটাই পকেটস্থ করা যায়। টাকার অঙ্কটাও কম নয়। সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণ শেষ করার কথা। সেটা যেহেতু করা হয় না, না করে চালিয়ে দেয়া যায় কিনা সেজন্য অপেক্ষা করা হয়, তারপর বৃষ্টি পড়লে, জোর হাওয়া দিলে তড়িঘড়ি করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়- সেকারণে এই বাঁধ স্রোতের সামান্য ধাক্কায়ও আর টেকে না। এ বাঁধগুলো মাটি দিয়ে তৈরি। এমনিতেই বড় কোন স্রোত মোকাবেলা করার সামর্থ্য তার নেই। তার উপর ঠিক সময়ে দিলে তা যতটুকু শক্ত হতে পারতো, অন্তিম মূহুর্তে একেবারে তড়িঘড়ি করে দেয়ার কারণে সে কাঁচা মাটির বাঁধ হয়েই থাকে। কোন প্রবল ¯্রােত মোকাবেলার সামর্থ্য সে রাখে না। বাঁধ দেয়ার ক্ষেত্রে এই গাফিলতির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি উভয়েই দায়ী। কারণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি করা হয়, তাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি উভয়েই থাকেন। এই তহবিলকে লুটপাট করার ঘটনা উভয়ের হস্তক্ষেপেই ঘটে।
ফসল নষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ ফসলের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন
পূর্বে এই হাওর এলাকায় স্থানীয় বোরো ফসলের চাষ হতো। এটি ১২০ দিনেই মাঠ থেকে তুলে নেয়া যেতো। ফলে চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই এই ধান গোলায় উঠে যেতো। কিন্তু এখন উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের চাষ হয়। এতে একরপ্রতি ফলন আগের থেকে প্রায় তিনগুণ বাড়লেও বীজতলা থেকে ধানপাকা পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ দিন। ফলে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত লেগে যায় এই ধান তুলতে। এই কারণে এই ধান অকালবন্যা থেকে শুরু করে কালবোশেখির থাবা সকল কিছুর জন্যই সংবেদনশীল।
গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের অবস্থা খুবই করুণ
দুই ধরনের প্রথায় হাওর অঞ্চলে ধান চাষ হয়। ৫০/৬০ বিঘা জমির মালিক অনেকেই আর নিজে কৃষিকাজ করেন না। বেশিরভাগই শহরে থাকেন। জমিগুলো হয় বর্গা দেন অথবা চুক্তিতে (স্থানীয় ভাষায় বলে ‘রঙজমা’) দেন। বর্গার নিয়ম হলো যে কৃষক চাষের জন্য তার জমি নেবে সে তাকে ফসলের অর্ধেক দেবে। আর চুক্তিতে তিনি কিছু টাকার বিনিময়ে কৃষককে জমিটা এক বছরের জন্য দেবেন। সেখান থেকে সে যা উৎপাদন করতে পারবে সেটা তার। লোকসান হলেও তার হবে। এই চুক্তির জমি যারা নিয়েছেন (নিজের প্রচুর চাষের জমি নেই বলেই নিয়েছেন), তারা সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বিরাট সংখ্যক ক্ষেতমজুর যারা এইসব লোকের অধীনে মজুরির বিনিময়ে ধান তোলাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন এই সময় তারা পুরোপুরি বেকার হয়ে বসে আছেন। আর বর্গাতে যারা জমি নিয়েছেন তারা ফসল তো পেলেনই না, উপরন্তু চাষের জন্য যে খরচ করলেন তার পুরোটাই ঋণ হিসেবে ঘাড়ে চেপে বসেছে।
যারা ৫০/৬০ বিঘার মতো জমির মালিক, নিজেরা হয়তো চাষ করেন না, হয় বর্গা না হয় চুক্তিতে জমিগুলো দিয়ে দেন তাদের পরিস্থিতিও খারাপ। এরা অনেকেই শহরে বাস করেন। কেউ চাকরি করেন, কেউবা ছোট ব্যবসা করেন। গ্রামের জমি থেকে আসা চাল দিয়ে হয়তো তাদের সারা বছরের খোরাক হয়ে যায়। অথবা এখান থেকে আসা কিছু টাকা থেকে পরিবারের বয়স্কদের চিকিৎসা বা অন্য প্রয়োজন মেটানো হয়। এরা কেউই খুব সম্পদশালী ব্যক্তি নন। লেখাপড়া করে চাকুরি নিয়ে কিংবা ছোটখাট ব্যবসা করে শহরে একটা মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করেন। এই টাকা কিংবা চাল তার জন্য খুব প্রয়োজনীয়ও। তাদেরকেও একটি বড় রকমের দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলো এই দুর্যোগ।
এটি কি দুর্গত এলাকা?
সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের হাসির খোরাক জোগানো বক্তব্য বাংলাদেশে কোন নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এরকম একটা দুর্যোগে হাস্যকর কথা বলা হয় কোন রকম বুদ্ধিবৃত্তিক বৈকল্য কিংবা চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও নিস্পৃহতাকে নির্দেশ করে। এক কর্মকর্তা বলেছেন, ৫০ ভাগ লোক মারা না গেলে নাকি দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় না। আরেকজন বললেন, একটা ছাগলও মরলো না তাহলে এটা কিসের দুর্গত এলাকা। এধরনের মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। একটি ঘটনা একটি এলাকার মানুষের জনজীবনে কি কি পরিবর্তন এনেছে ও ভবিষ্যতে আনবে তা হিসেব করেই সে দুর্গত কিনা এই মূল্যায়নটি করতে হয়। এ প্রসঙ্গে কিছু বিষয় মাথায় রাখা দরকার।
প্রথমত, হাওর অঞ্চলের জমিগুলো একফসলি। বছরে একবারই চাষ হয়। বাকি সময় পানির নিচে থাকে বলে সেখানে অন্য কোন শাকসব্জীরও চাষ হয় না। অন্যান্য জায়গায় যেমন বন্যার পানি নেমে গেলে পলি পড়া জমি উর্বর হয়, ভাল ফসল ফলে, হাওরের জমির ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তাদের ফসল একবার ভেসে গেলে তাদের টিকে থাকার আর কোন পথ থাকে না।
দ্বিতীয়ত, হাওর অঞ্চলের মানুষের কৃষিজমি বাদে আরেকটি আর্থিক উৎস হলো মাছ। কিন্তু বিল থেকে, ছোট ছোট জলা থেকে মাছ আহরণ করার কোন রাস্তা এখন খোলা নেই। আগে এ অঞ্চলের লোকেরা যেখানে ইচ্ছা মাছ ধরতে পারতো। এখন আর তা সম্ভব নয়। কারণ এখন হাওরগুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে এবং বিলগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে ইজারা দেয়া হয়। এই ইজারাদাররা খুবই প্রভাবশালী লোক। এরা জলাগুলোতে সশস্ত্র পাহাড়া বসান। ফলে মাছ ধরা কৃষকদের ক্ষেত্রে একভাবে বন্ধই বলা যায়।
তৃতীয়ত, এই দুর্যোগের ফলে শুধু কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তা নয়। এসকল এলাকার উপজেলা সদরের বাজার থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে অবস্থিত সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের উপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এটি আস্তে আস্তে সামনে আসা শুরু হয়েছে, যত সময় যাবে এটি আরও তীব্র হবে। যেসকল কৃষিমজুর ফসল তোলার সময়ে মজুর খাটতো তারা কাজ পাবে না, কাপড়-জুতা-স্বর্ণ-মিষ্টি-বেকারিসহ বিভিন্ন ব্যবসায় ইতিমধ্যেই মন্দা শুরু হয়েছে। প্রথম ধাক্কায় এসকল জায়গা থেকে একটা বড় অংশের কর্মচারীরা কাজ হারাবেন। পরবর্তীতে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হবেন। পুরো বছরব্যাপী এই প্রভাব থাকবে।
চতুর্থত, এই বিরাট অংশের বেকারত্ব, কর্মহীনতা, কোনরকমে টিকে থাকার জন্য যে কোন কিছু করার চেষ্টা- পুরো ব্যাপারটির সামাজিক প্রভাবও গভীর। এরকম পরিস্থিতিতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে, অন্যায়-অপকর্ম বাড়ে। ধীরে ধীরে এই প্রভাব ওই অঞ্চলের লোকেরা প্রত্যক্ষ করবে।
এসকল বিচারের ভিত্তিতেই ঠিক করতে হবে, একে দুর্গত এলাকা বলা যায় কিনা। কিছু নির্দিষ্ট প্যারামিটার মিললেই সেটা দুর্গত এলাকা হবে, না মিললে হবেনা- ব্যাপারটা এরকম নয়। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের একাডেমিশিয়ানরাও ব্যাপারটা এভাবে দেখেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও সরকারের এমন ভাষ্য একবাক্যে নাকচ করেছেন। তবে এটাই সবচেয়ে নির্মম ও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে, একটি এলাকার বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনে একটা বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেলো এবং সামনে আরও বড় বিপর্যয় যেখানে অপেক্ষা করছে- সে অবস্থায় রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের মুখে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। এদের পাশে সবকিছু নিয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিলো যে রাষ্ট্রের তার ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
হাওরের ব্যাপারে সরকারের করণীয় কী?
হাওর অঞ্চল প্রচুর সম্পদে পরিপূর্ণ একটি অঞ্চল। দেশের বোরো ফসলের একটা বিরাট অংশ সে সরবরাহ করে শুধু তার জন্য নয়, দেশের মৎস্য সম্পদ, গবাদি পশু লালন-পালনের দিক থেকেও হাওর অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই হাওর অঞ্চলের লোকেদের না খেয়ে মারা যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু একটি সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবের কারণে হাওরের দুর্দশার আজ শেষ নেই। হাওর অঞ্চল ও তার আশেপাশের জেলাগুলোকে কেন্দ্র করে সরকারের একটি বিশেষ পরিকল্পনা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে নি¤েœাক্ত প্রস্তাবনাগুলোকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে যা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে এসেছে।
১. বন্যা প্রতিরোধের জন্য নদীসমূহে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং এর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বন্যার পানি সে পথ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
২. হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দিয়ে ফসল চাষ বন্ধ করা উচিত। মাছ চাষে গুরুত্ব দেয়া উচিত। মাছ আহরণের ক্ষেত্রে সবরকম প্রতিবন্ধকতা দূর করা উচিত এবং খালবিল লিজ দেয়া বন্ধ করে মৎসক্ষেত্রকে স্থানীয় আহরণকারীদের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত।
৩. ১২০ দিনে ঘরে তোলা যায় এমন উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত আবিষ্কারের লক্ষ্যে চেষ্টা করা উচিত।
৪. মাছ, ধান ও হাঁস-মুরগীসহ নানাপ্রকার গবাদি পশু পালন- এই তিনটি বিভাগকে কেন্দ্র করে একটি সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ণ করা উচিত।
৫. বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটির বাঁধের পরিবর্তে স্থায়ী বাঁধ ভাবা উচিত যাতে এর উপর দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা দাঁড় করানো যায়।