দেশে দেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গোটা দুনিয়াজুড়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়গত- মৌলবাদী পথ-পন্থার বলি হচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ধর্মকে ব্যবহার করেই প্রধানত তাদের স্বার্থ হাসিল করছে। ধর্মের সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এখন বেশ আলোচিত। আমরা ‘সাম্যবাদ’র পক্ষ থেকে এই সব বিষয়ের সাথে যুক্ত নানা প্রশ্ন-প্রসঙ্গ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করছি।
বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস-সংঘাত বাড়ছে
গত কয়েকদিন আগের মিশর। নামাজ পড়ছিল মানুষ। আচমকা বিস্ফোরণের শব্দ। দিদ্বিদিক ছোটাছুটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেমে এলো বুলেট বৃষ্টি। মুহূর্তেই ধড়ফড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে নিথর হলো দুইশ আশিটি তাজা প্রাণ! যেন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো রক্তবাণ বয়ে গেল। পাকিস্তানের একটা স্কুলে শতাধিক শিশুদের গুলি করে হত্যা করার খবর নিশ্চয়ই আমরা কেউ ভুলিনি। রক্তাক্ত হলো গ্রীস, প্যারিস, মুম্বাই। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য যেন বোমা-গুলি,আহাজারি-রক্ত-মৃত্যু আর ধ্বংসের ধূসর ভূখন্ডে পরিণত হয়েছে। এমন সন্ত্রাস-সহিংসতায় প্রতিটা দিন মানব সভ্যতা যেন লাশের ভারে ভারী হয়ে চলেছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এন্টোনিও গটারেস প্রকাশিত পরিসংখ্যানে ২০১৬ সালে মোট ১০০টি দেশে ১১,০০০ সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। আর তাতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৫,০০০ মানুষ। আহত হয়েছেন ৩৩,০০০ মানুষ। এই হামলার তিন চতুর্থাংশ ঘটেছে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়াতে। এসব হামলা-সন্ত্রাস-সহিংসতার অন্তর্গত কারণ কী, বোঝা দরকার সেটাই।
ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ধর্মের রূপ আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের তৎপরতা এক কথা নয়
মানব সভ্যতায় বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে ঐ সময়ের প্রাসঙ্গিক কারণেই। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ক্রমে সেই ধর্মও বিবর্তিত হয়েছে। একেকটি ধর্মেরই নানান ধারা-উপধারার মতাবলম্বী গড়ে উঠেছে। সামন্তবাদের গোড়াপত্তনকাল থেকে আধুনিক পুঁজিবাদের উন্মেষকাল — ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন অবশ্যই উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দরুন। আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠেছে এই সময়ে। শিল্প বিপ্লব কিংবা রেনেসাঁ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইহজাগতিক ভাবধারার জন্ম হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রই নাগরিকের ধর্মীয় বিশ্বাসকে তার রাষ্ট্রিক আচার থেকে ধর্মকে পৃথক করে। ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়া, সাম্রাজ্যবাদী রূপ ধারণ করায় তা আর অগ্রসর করতে পারেনি। বরং ধর্মকে কেন্দ্র করে জাত-পাত-বর্ণ-গোত্র নানাভাবে মানুষকে বিভক্ত করে তুলেছে।
সাধারণভাবে ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছে ধর্মের রূপ আর কোনো ধর্ম কিংবা তার কোনো ধারা-উপধারার উপর ভিত্তি করে কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক তৎপরতা এক কথা নয়। কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী-সংগঠন যখন ধর্মের মৌল আদর্শ নিজেদের মতো সংজ্ঞায়িত করে এবং অন্যের মত বিশ্বাস চর্চাকে অস্বীকার করে তা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে, তখন তা তৈরি করে সহিংস পরিস্থিতি। জোর করে চাপানোর এই মতাদর্শিক পরিস্থিতিই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জন্ম দেয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-শিবসেনা-আরএসএস‘র সৈনিকরা কী না করছে! মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মোদি মুসলিম নিধনে কসাইগিরি করেছেন। আর এখন তো সে-ই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই ধর্মাশ্রয়ী শাসকদের মধ্যে কোথায় রামকৃষ্ণ, চৈতন্যদেব, বিবেকানন্দের ধর্মবোধ! অসংখ্য ধর্মপ্রচারক শান্তির (ইসলাম) বাণী নিয়ে যে মধ্যপ্রাচ্যে এসেছিলেন, আজ সেখানে শিয়া-সুন্নিসহ অসংখ্য মাজহাবে (গোত্রে) বিভক্ত হয়ে প্রতিদিনই সহিংসতা চলছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে, ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ধর্মকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে, আপোষ করছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই ধর্মীয় সন্ত্রাসের চাষ করছে
তালেবান, আলকায়েদা, আইসিসসহ যেসব সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীকে দমন করার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে দখলদারিত্বের জাল ফেলেছে তারা সবাই মার্কিন সৃষ্ট, তাদেরই লালিত-পালিত দানব। আগাগোড়া ধর্মীয় বিভিন্ন সন্ত্রাসী-জঙ্গী গোষ্ঠী-সংগঠন তৈরিতে কারিগরের ভূমিকা পালন করেছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তার নিজস্ব স্বার্থেই। উপনিবেশ পরবর্তী সময়ে সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে খুঁটি ধরে রাখতে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরি করে সমাজতন্ত্র ও দেশে দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। আফগানিস্তানের নজিবুল্লাহ্ সরকারকে উৎখাত করার জন্য প্রশিক্ষণ, অর্থ, অস্ত্রসহ সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুজাহেদিন বাহিনী তৈরি করে। ইউএসএইড‘কে দিয়ে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব স্তরেই সরবরাহ করে ধর্মীয় উন্মাদনার বই-পুস্তক। যে বইয়ে সোভিয়েত সৈন্যের চোখ উপড়ে ফেললে পুরস্কার হিসেবে বেহেশতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংগঠন সিআইএ সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেও মাঠের কাজে লাগায়। মুজাহেদিনের পর আবার সন্ত্রাস-সহিংসতা জারি রাখতে তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে তালেবান। সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে আশির দশকে যে সমস্ত ইসলামী সশস্ত্র সংগঠনের সাথে ঐক্য হয় পরবর্তীতে তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। সারা দুনিয়া বর্তমানে এদের বিষময়তায় আক্রান্ত। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর শত্রুপক্ষ বদলে যায়। ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে নিজেই জন্ম দিয়ে তার বিরুদ্ধে কথিত লড়াইকে একটি বৈশ্বিক এজেন্ডা হিসেবে জায়েজ করে নেয়।
সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নেপথ্যে তেল আর অস্ত্রের ব্যবসা
১৯৯৭ সালের ২৪ মে তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে। আর ঠিক তার আগের দিন মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তার সম্পাদকীয়তে লেখে, “আফগানিস্তান হচ্ছে মধ্য এশিয়ার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য গ্যাস রপ্তানির প্রধান পথ। … তাদের পছন্দ করো বা না করো, ইতিহাসের এই পর্যায়ে তালেবানরাই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত।” এর এক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস বলে- “ক্লিনটন প্রশাসন মনে করে যে তালেবানদের বিজয় ইরানের পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। …এমন একটি বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করবে, যা এই অঞ্চলে ইরান ও রাশিয়ার প্রভাবকে দুর্বল করবে”। মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনোকল ক্লিনটন প্রশাসন ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বক্তব্যকে ‘খুবই ইতিবাচক’ অগ্রগতি বলে অভিহিত করে। ঐ বছরেই যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিকভাবে শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক করার জন্য ‘প্রজেক্ট নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ নেয়া হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ডিক চিনি, রামসফেল্ড, জেব বুশ, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা প্রমুখ তেল ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। প্রাকৃতিকভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। পৃথিবীর প্রমাণিত মজুদের বেশিরভাগ পরিমাণ এই অঞ্চলে। একদিকে মুসলিম রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা অন্যদিকে জায়নবাদী ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা করার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ ভৌগোলিক অঞ্চল করায়ত্ত করে রেখেছে। সন্ত্রাসী-জঙ্গী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ, যুদ্ধ, যুদ্ধভাব জিইয়ে রেখে চলছে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা তথা অর্থনীতির সামরিকীকরণ। সর্বশেষ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইহুদি জায়নবাদী ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছে আর ফিলিস্তিনি হামাস জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে।