করোনায় দুর্দশাগ্রস্ত গরীব-মধ্যবিত্তের জন্য রেশনব্যবস্থা চালু ও লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, নারী-শিশু ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচার, দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ করতে আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সম্পদ বাজেয়াপ্ত, শ্রমিক ছাঁটাই-বেতন কর্তন বন্ধ, রাষ্ট্রীয় পাটকল চালু, চাষীদের ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ক্রয় বাড়ানো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ার-গুম-নির্যাতন বন্ধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারা বাতিল, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি মওকুফসহ ১২ দফা দাবিতে বাসদ(মার্কসবাদী)-র উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
কেন্দ্রঘোষিত ‘দাবি মাস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ ১ নভেম্বর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং সারাদেশে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকায় আজ সকাল ১১.৩০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় নেতা ফখ্রুদ্দিন কবির আতিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জহিরুল ইসলাম, নাঈমা খালেদ মনিকা, মাসুদ রানা, জয়দীপ ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সমাবেশের পর একটি মিছিল পল্টন-গুলিস্তান এলাকা প্রদক্ষিণ করে। দলের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল শেরেবাংলা নগরস্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, “করোনা ভাইরাসে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপর্যস্ত। সংক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থ সরকার জনগণকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, যারা মরার মরবে ও যারা বাঁচার বাঁচবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহরেই বেশিরভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই-এর মতো প্রাথমিক জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা নেই, আইসিইউ-এর জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। দুই মাস লকডাউনেই দেশের বেশিরভাগ পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, অর্থাৎ কাজ বন্ধ থাকলে অল্প কিছুদিন চলবার মতো সঞ্চয় নেই বেশিরভাগ মানুষের। করোনাজনিত অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে ছাঁটাই-বেতন কর্তন চলছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে। প্রবাসীরা অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দিয়ে ৬০ হাজার শ্রমিককে এক ধাক্কায় বেকার করে দিয়েছে, পাটচাষীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভুতুড়ে বিদ্যুৎবিলের বোঝা, বর্ধিত পানির বিল-গাড়িভাড়ায় মানুষ দিশাহারা। অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষ-কৃষক-নিম্নবিত্তকে সহায়তা দেয়ার পরিবর্তে সরকার প্রধানত শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। এই মহামারীর সময়েও যে লাগামহীন দুর্নীতি-প্রতারণা ও জালিয়াতি হতে পারে, সেই নজির স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনাকারীদের দমনে গ্রেপ্তার-নিপীড়ন চালাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ২ বছরে হাজারের বেশি মামলা হয়েছে, দেড় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর সিন্হার মৃত্যু, মাদক দমনের নামে শুধুমাত্র ওই জেলায় ‘ক্রসফায়ারে’ দুই শতাধিক মানুষ হত্যা এসব ঘটনায় উঠে এসেছে – এদেশে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে মানুষের জীবন কতটা নিরাপত্তাহীন। বেআইনী আটক, গুম, হয়রানিমূলক মামলা, পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন, মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়, সভা-সমাবেশে বাধাদান – এসব চলছেই।”
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, “অর্থনৈতিক সংকট থেকে জনগণকে রক্ষা করতে চাই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে সবার জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা-আবাসন-কর্মসংস্থান। মূল্যবৃদ্ধির রোধ করতে দরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের রেশনব্যবস্থা প্রবর্তন, যা আশির দশক পর্যন্ত এদেশে সীমিত আকারে কার্যকর ছিল। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় চাই মানসম্মত ন্যূনতম জাতীয় মজুরি প্রবর্তন, সর্বস্তরে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও সরকারী-বেসরকারী নির্বিশেষে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ক্রয় বহুগুণ বাড়িয়ে ধাপে ধাপে খাদ্যশস্যের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করতে হবে। সেইসাথে কৃষি উপকরণে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিয়ে স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করতে হবে, কৃষকদের মহাজনী ও এনজিও ঋণের শোষণ থেকে রক্ষা করতে সরকারীভাবে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ বাড়ানো ও শস্যবীমা চালু করতে হবে। দুর্নীতিবাজ-কালো টাকার মালিক-ব্যাংক লুটেরা-ঋণখেলাপীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা এবং আয়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ক্রমবর্ধমান নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধে দোষীদের দ্রুত বিচার করা, অভিযোগকারীর হয়রানি বন্ধ করা, মাদক-পর্নোগ্রাফি-নারীকে ভোগ্যপণ্যরূপে উপস্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা এবং পরিবারে-সমাজে নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সেনাশাসন অবিলম্বে অবসান করা জরুরি।
পরিশেষে নেতৃবৃন্দ বলেন, “জনগণের জীবন ও জীবিকার ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে চাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র, গণমুখী প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কিন্তু ভোটডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও গণবিরোধী শাসন কায়েম করেছে। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার লক্ষ্যে অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার অবিলম্বে পদত্যাগ করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।” নেতৃবৃন্দ জনগণের জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১২ দফা আশু দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বাসদ(মার্কসবাদী) উত্থাপিত আশু ১২ দফা দাবিনামা :
১. সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা চাই। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় আয়ের ৬% বা জাতীয় বাজেটের ২০% বরাদ্দ কর। বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাবাণিজ্য বন্ধ কর। ঔষধ, অক্সিজেন ও অন্যান্য চিকিৎসা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর।
২. করোনা ও নন-করোনা সকল রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর-এর ব্যবস্থা কর। চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা-প্রণোদনা নিশ্চিত কর। প্রতিদিন ৫০ হাজার করোনা পরীক্ষা, সকল জেলায় ল্যাব ও উপজেলায় পর্যাপ্ত নমুনা সংগ্রহ কর।
৩. গরীব-মধ্যবিত্তের জন্য স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহে রেশনব্যবস্থা চালু কর। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বর্ধিত বিল প্রত্যাহার কর। রেল-বিআরটিসি’সহ সরকারি গণপরিবহন বাড়াও। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অল্প ভাড়ায় সরকারি আবাসন প্রকল্প বা কলোনী নির্মাণ কর। বাড়িভাড়া-গাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর কর।
৪. দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ কর, আয়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন সম্পদ বাজেয়াপ্ত কর। কালো টাকার মালিক-অর্থপাচারকারী-ঋণখেলাপী-ব্যাংক লুটেরাদের গ্রেপ্তার কর।
৫. কৃষকদের ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে রাষ্ট্রীয় ক্রয় বাড়াও। স্বল্পমূল্যে সার-বীজ-কীটনাশক ইত্যাদি উপকরণ ও কৃষিযন্ত্র সরবরাহ কর, কৃষিখাতে সরকারী বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়াও। মহাজনী ও এনজিও ঋণের সুদ মওকুফ কর, কিস্তি আদায় বন্ধ রাখ।
৬. রাষ্ট্রীয় পাটকল ও চিনিকল আধুনিকীকরণ করে চালু রাখ, লোকসানের জন্য দায়ীদের শাস্তি চাই। ছাঁটাই-বেতন কর্তন বন্ধ কর। অসংগঠিত খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকারি অর্থসহায়তার ব্যবস্থা কর। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ কর। সব শ্রমিকের জন্য অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও ‘সর্বজনীন পেনশন’ ব্যবস্থা চাই।
৭. শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চাই। সরকারিভাবে বেকার জনগোষ্ঠীর নাম তালিকাভুক্ত করে কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় শূন্যপদে নিয়োগ দাও, সরকারি চাকুরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত কর।
৮. করোনাকালে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ফি মওকুফ কর। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন সরকারি তহবিল থেকে দাও। শিক্ষার্থীদের মেস-হোস্টেল ভাড়া রেয়াত করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ চাই। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল কর। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ বন্ধ কর।
৯. নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে দোষীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মাদক-পর্নোগ্রাফি-জুয়া নির্মূল কর। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন চাই। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত কর। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সেনাশাসন প্রত্যাহার কর।
১০. স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান চাই। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বেআইনী আটক, হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ কর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারা বাতিল কর, গ্রেপ্তারকৃতদের জামিন দাও। প্রশাসন-বিচার বিভাগের দলীয়করণ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বন্ধ কর।
১১. অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
১২. ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বন্ধ কর। তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় কর। জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত না করে ভারতকে বন্দর ও রাস্তাঘাট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া চলবে না। সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ব্যয়বহুল-ঝুঁকিপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ কর।