Wednesday, December 25, 2024
Homeফিচারধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে

ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে

এদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বড় বাজেট উত্থাপন করে শাসক দল যখন স্মিত হাস্যে, স্ফীত বুকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তখন এদেশের শ্রমিক-কৃষক, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ আবার তীব্র অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। বাজেট বলতে এদেশের সাধারণ জনগণ অর্থনীতির নিগূঢ় তত্ত্ব বুঝেন না এটা ঠিক। কিন্তু তারা বুঝেন যে, কোন কাজ করতে হলে তার আয় কোন খাত থেকে আসবে এবং কোন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তার একটা পরিকল্পনা। বুর্জোয়া অর্থনীতির একাডেমিক আলোচনায় প্র্রবশে না করলেও এটাই বাজেটের মূল কথা। বাজেটের মূল আলোচনায় প্র্রবেশ করার আগে একটা কথা উল্লেখ করা প্র্রয়োজন যে, আমাদের দেশ ধনী ও গরিব (শ্রমিক ও মালিক) এ দু’ভাগে বিভক্ত। তাই কোন একটি সিদ্ধান্ত বা ঘটনা কোন ভাবেই উভয় শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। আর এ সত্যকে ভুলে গেলে বাস্তবের যথার্থ উপলব্ধি তৈরি হয় না। আজকে যখন সরকার আওয়াজ তুলছে “সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ/ সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের” – তখন মেহনতি মানুষদের যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে নির্ধারণ করতে হবে সমৃদ্ধিটা আসলে কার? মেহনতি জনতার না ধনিক শ্রেণীর? দাম বাড়বে নিত্য প্র্রয়োজনীয় পণ্যের?

২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষিত হয়েছে। এ বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। বাজেটের অধিকাংশ অর্থ অর্থাৎ প্র্রায় ৬৩ শতাংশ অর্থের যোগান হবে পরোক্ষ কর থেকে। যে টাকা ট্যাক্স আকারে সরকার জনগণকে দেয়, সেই খাত থেকে। তাহলে বাজেটের অর্থ যোগানদাতা জনগণের জন্য কী আছে এই বাজেটে? আগামী অর্থবছরের বাজেটে বেশকিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্যাকেটজাত তরল দুধ, গুঁড়ো দুধ, আমদানি করা কাঁচা চিনি ও প্র্রক্রিয়াজাত চিনি, প্র্রাকৃতিক মধু, সব ধরনের অলিভ অয়েল, এসি মোটর, প্র্রক্রিয়াজাত মিক্সড খাদ্য, ফ্লাস্ক, বোতল, জার, প্রট, গ্যাস, রান্নার ওভেন ও চুলা। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে আসছে অর্থবছরে। আমদানি করা ভোজ্যতেল, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য এতদিন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি পেয়ে আসছিল। কিন্তু ভ্যাট আরোপের ফলে আমদানি করা সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, সূর্যমুখী তেল ও সরিষার তেলের দাম বাড়তে পারে। নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাবে অস্থির হয়ে উঠেছে গরম মসলার বাজার। অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার পরপরই বেড়ে গেছে প্র্রায় সব ধরনের মসলার দাম। বর্তমানে আমদানি করা গরম মসলায় ৬০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে মসলা আমদানিতে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্র্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এ কারণে বাজেট ঘোষণার পর থেকে জিরা, দারচিনি, মিষ্টি জিরা, এলাচ, জয়ত্রী ও গোল মরিচের দাম বেড়ে গেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় এসকল পণ্যের দাম বাড়ার ফলে জনজীবন অস্থির হয়ে উঠবে।

বড় বাজেটের আড়ালে অর্থনৈতিক অস্থিরতা

সরকার জোর গলায় প্র্রচার করছে যে, এবার তারা বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট প্র্রণয়ন করেছে। অথচ এই বৃহৎ বাজেটের আড়ালে লুকিয়ে আছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম অস্থিরতা । ফলে আজ যে বাজেট তারা প্র্রণয়ন করেছে, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পরের বার তাদেরকে আরও বড়, তার পরের বার তার চেয়েও বড় বাজেট প্র্রণয়ন করতে হবে। ফলে বাজেটের আকার দেখিয়ে জনগণকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলেও জনগণের উপর তার কু-প্র্রভাব বর্তাতে বাধ্য। বর্তমান বাজেট পর্যালোচনা করলে তাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বুর্জোয়া অর্থনীতিতে সুষম ও অসম বাজেট – এ দু’প্র্রকার বাজেট আছে। সরকারের আয়ের সাথে ব্যয় সমান হলে তাকে সুষম বাজেট বলে। আর আয়-ব্যয় সমান না হলে তাকে অসম বাজেট বলে। অসম বাজেট আবার ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত বাজেটও হতে পারে।

সংকটগ্রস্ত পুুঁঁজিবাদী বিশ্বে কোথাও কোন সরকার সাধারণভাবে আজ আর সুষম বাজেট কিংবা উদ্বৃত্ত বাজেট প্র্রণয়ন করতে পারে না। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোটা অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ঋণের উপর। তীব্র বাজার সংকটে নিপতিত বুর্জোয়া অর্থনীতিকে রক্ষা করতে এখন বলা হচ্ছে ‘ঘাটতি বাজেট’ই উত্তম। এতে ওই দেশের অর্থনীতিতে যেমন কৃত্রিম তেজী ভাব তৈরি করা যায়, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের পুঁজি রপ্তানি এবং আগ্রাসনও একটা বৈধতা পেয়ে যায়। কারণ ঘাটতি বাজেট হলে আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এ টোটকা দাওয়াইও শেষ রক্ষা করতে পারে না। অতিরিক্ত ঋণ (আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক) গোটা অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে। বাংলাদেশ এই সংকটে পড়েছে। “আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৩৮ ২১২ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে।” তাহলে এর ৬০ ভাগই আসছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বেশি, তা পরিশোধ করতে গিয়ে বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। যার ফলে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরাই ধারণা করছেন, এভাবে চললে আগামী ৪/৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। আর তা সামাল দেয়ার জন্যে তারা প্র্রস্তাব করছেন রাজস্ব আয় বাড়াতে। সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে নানাভাবে করারোপ করছে, বিভিন্ন সময়ে করের হার বাড়াচ্ছে, এবার প্র্রত্যক্ষ করের আওতায় ৪ কোটি মানুষকে আনার প্র্রস্তাব করেছে। বর্তমানে দেশের জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার ১০ শতাংশ। যাকে অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্র্রস্তাব করছেন বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা। ইতোমধ্যেই পরোক্ষ করে জনগণ বিপর্যস্ত। শুধুমাত্র মোবাইলে ১’শ টাকা ব্যবহার করলে ২৭ টাকা পরোক্ষ কর দিতে হয়। এমনকি সরকার বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজের ওপর যে কর আরোপ করে সেটাও পরোক্ষ করের মারপ্যাঁচে বাস্তবে জনগণকেই দিতে হয়। এখন সরকার প্র্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানোর কথা বলছে, লক্ষ্যসীমা নির্ধারণ করেছে ৪ কোটি মানুষ। ৪ কোটি মানুষের কাছ থেকে কর আদায়ের বাস্তব কোন পরিস্থিতি নেই, একথা বলছে সিপিডি। তাই রাজস্ব আয় বাড়িয়ে এ সংকট সমাধানের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। ফলে সরকার বিদেশী ঋণের দিকে হাঁটবে। বিদেশী ঋণ মানেই শর্ত, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। আর এই ঘাটতি পূরণের জন্য ক্রমাগত আরও ঋণ করতে হয়, সেটা পূরণের জন্য আরও ঋণ করতে হয়। যার ফলে বাজটের আকার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে গোটা অর্থনীতিই এক সংকটের মধ্যে আছে। যার বোঝা বহন করতে হবে জনগণকে ।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতসহ সেবাখাতসমূহে বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরাণিত হবে

চলতি কথায় শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয়। ইউনেস্কো’র ঘোষণা মতে, দেশের শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ বরাদ্দ করার কথা। আমাদের দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রআন্দোলন থেকে বারবার এ দাবিটি উচ্চারিত হচ্ছে। সরকার এর যৌক্তিকতা সরাসরি অস্বীকার না করলেও তা বাস্তবায়ন করছে না। বাজেট বক্তৃতায় বলা হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে ‘মেইজি বিপ্লব’ সংগঠিত করা হবে। জাপানের সম্রাট মেইজির মত এদেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে, এমনকি তার জন্য বিলেত থেকে শিক্ষক ‘আমদানি’ করা হবে! অথচ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্র্রয়োজনের তুলনায় এই বরাদ্দ অপ্রর্যাপ্ত। তাহলে চলবে কি করে? চলার একমাত্র উপায় ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ। আমরা পূর্বেই দেখেছি সরকারের বরাদ্দ যত কমেছে, ততই বেড়েছে দেশি-বিদেশি পুুঁঁজির বিনিয়োগ। যার ফলে ক্রমাগত শিক্ষাব্যয় যেমন বেড়েছে একইভাবে সংকোচিত হচ্ছে শিক্ষার অধিকার। সরকার একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বললেও কূপমন্ডূক মাদ্রাসা শিক্ষাকে সম্প্রসারণ করছে। এ বাবদ এবারের বাজেটে বরাদ্দ করেছে ৫ হাজর ৭৫৮ কোটি টাকা (কারিগরি ও মাদ্রাসা),আর নির্মাণ করা হচ্ছে মাদ্রাসার নতুন ১৮’শ ভবন। অন্যদিকে ডিজিটালাইজেশনের নামে কারিগরি শিক্ষা ও প্র্রযুক্তির উপর জোর দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলানোর জন্য এখন ‘শেখানো হবে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেনোলজি, রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স….ব্লকচেইন টেকনোলজি ইত্যাদি’। ফলে বাজেট পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষাখাতে দেশি-বিদেশি পুঁজির আবাধ অনুপ্র্রবেশ ঘটবে, আর একটা পশ্চাৎপদ ভাবমানসের সাথে বিজ্ঞানের কারিগরি দিকটি সংমিশ্রণ ঘটানো হবে; যা ফ্যাসিবাদী শাসনের সাংস্কৃতিক জমিন তৈরি করবে। এর ফলে লাভবান হবে এদেশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা। একই চিত্র স্বাস্থ্যখাতে। টাকার অভাবে মানুষ চিকিৎসা করাতে পারে না, প্র্রয়োজনীয় ঔষধ কিনতে পারে না। এমতাবস্থায় সরকারি উদ্যোগে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটলো না। চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৪.৯ শতাংশ। সাধারণ মানুষের জন্য সরকার এ খাতে বিশেষ কোন ব্যবস্থা না নিলেও ঔষধ শিল্প রক্ষার নামে ঔষধ কোম্পানির মালিকদের জন্য ঠিকই ২০ শতাংশ প্র্রণোদনা প্র্রদান করেছে। সরকার গর্ব করে ঘোষণা করছে, তারা সারা দেশে ১১১টি মেডিকেল কলেজ গড়ে তুলেছে, অথচ ভুলে যাচ্ছে এর মধ্যে ৭৭টি কলেজই প্র্রাইভেট। এই প্র্রাইভেট মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা ব্যয় যেমন বেশি, একইভাবে যারা শিক্ষার্থী, তাদেরও গুণতে হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। অপরদিকে সরকারি মেডিকেলগুলোতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অবকাঠামো স্বল্পতা আমাদের সবার জানা। ফলে চিকিৎসা খাত সম্পূর্ণটাই প্র্রায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলছে।

উপেক্ষিত কৃষি এবং কৃষক

বাজেট প্র্রণয়নের পূর্বে এদেশের কৃষি ও কৃষকের দুরবস্থার চিত্রটি অত্যন্ত নগ্নভাবে সকলের সামনে এসেছিল। প্র্রত্যাশা ছিল আসন্ন বাজেট অন্তত কৃষক ও কৃষিবান্ধব হবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর অর্থনৈতিক দেশ। খোদ বাজেট বক্তব্যেও বলা হচ্ছে, “কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি; দেশের মোট শ্রম শক্তির ৪০.৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত”। এ বাস্তব সত্য, একে অস্বীকার করা যায় না, অর্থমন্ত্রীও পারেননি। কিন্তু তারপরও বাজেটে যে বরাদ্দ ও নীতি গ্রহণ করা হলো, তা কোনক্রমেই কৃষকদের উপযোগী নয়। এবার কৃষিখাতে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ করার প্র্রস্তাব করেছে। খোদ কৃষকদের জন্য বরাদ্দ না করলেও কৃষিপণ্য রপ্তানিকারী ব্যবসায়ীদের জন্য ২০ শতাংশ প্র্রণোদনার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান কৃষিখাতের অবস্থা ও বাজেট পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বাংলাদেশ সরকারের কৃষিনীতির কারণে প্র্রতি বছর নিঃস্ব-রিক্ত হচ্ছেন হাজার হাজার কৃষক। কৃষকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে ফসল উৎপাদন করেন, তার ন্যায্যমূল্য পান না। কিন্তু একথা দিয়ে লোকসানের প্র্রকৃত চিত্র অনুধাবন করা যাবে না। যেমন এবছর বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে রেকর্ড ২ কোটি টন, আর সরকার কিনবে মাত্র দেড় লাখ টন। তাও এর মধ্যে বেশিরভাগটাই চাল কিনবে। ফলে উৎপাদিত ফসলের ব্যাপক অংশ কৃষককে খোলা বাজারে বিক্রি করতে হয়। এক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো, কৃষকের প্র্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়ে ২৫ টাকা করে, সরকার অবশ্য কিনে ২৬ টাকায়। কিন্তু সরকার কতটুকু ক্রয় করে তার চিত্র তো উপরেই আছে। ফলে বিপুল প্ররিমাণ উৎপাদিত ফসল নিয়ে কৃষক বিপদে পড়েন। অপরদিকে ফসল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত আয়োজনও নেই। তাই বাধ্য হয়ে কৃষকদের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ধান বিক্রি করতে হয়। তারা কেজি প্র্রতি প্র্রায় অর্ধেক দামে অর্থাৎ ১৪/১৫ টাকা দিয়ে ক্রয় করে। ফলে প্র্রতি বছরই সাধারণ ও মাঝারি কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়ে। আবার কৃষি উৎপাদনের জন্য সার, সেচ, কীটনাশকসহ প্র্রয়োজনীয় উপাদান সরকার প্র্রদান করে না, তাই প্র্রতি বছর কৃষিঋণ নিতে হয়। ফলে একদিকে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, আরেক দিকে ক্রমাগত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু কৃষকদের রক্ষায় সরকারের কোন উদ্যোগ নেই।

বেকার সমস্যার সমাধান হবে কি?

বর্তমানে দেশের কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার জন। এই বেকারত্বকে পুুঁঁজি করে শাসক দল ঘরে ঘরে চাকরির প্র্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু তার সমাধান তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ কি ভয়াবহ তা আমরা টের পাই যখন মালয়েশিয়ার গণকবরে কিংবা সমুদ্রে হাজার হাজার বাংলাদেশি বেকারের সলিল সমাধির খবর আসে। এবারের বাজেটেও বেকার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোন কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাজেট প্র্রণয়নকালে অর্থমন্ত্রী সমস্যাটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন। তিনি বলছেন ‘একদিকে শ্রমবাজারে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তির আগমন, অন্যদিকে আধুনিক প্র্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে।’ নিজেদের ব্যর্থতার দায় প্র্রযুক্তির উপর চাপিয়ে দিলেন। বাজেটে বিশেষ ১’শটি অর্থনৈতিক জোন কার্যকর হলে বেকার সমস্যা সমাধান এবং আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবার অলীক স্বপ্ন দেখানো ছাড়া আর বিশেষ কোন প্র্রস্তাবনা নেই। আবার দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে এখন বিশ্বের ৫৩টি শ্রমশক্তি রপ্তানির কথা ভাবছেন। বাস্তবে পুুঁঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নিয়মেই প্র্রতিনিয়ত বেকারের সংখ্যা বাড়ে। তাই নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, আগামীদিনে বেকার সমস্যা আরও তীব্র হবে।

আপনার ঋণ কত?

প্র্রশ্ন শুনে আৎকে উঠলেন! না, আপনার ব্যক্তিগত কোন ঋণের কথা বলা হচ্ছে না! ভাবছেন তাহলে আবার ঋণ কি? আপনি ব্যক্তিগতভাবে ঋণ করুন আর না করুন, আপনার দু’বেলা খাবার জুটুক আর না জুটুক ঋণ কিন্তু আপনার আছে। তাও অল্প নয়, ৬৭ হাজার ২৩৩ টাকা। কি তাজ্জব ব্যাপার? এ কিভাবে সম্ভব? বুঝলেন না, এ হলো রাষ্ট্রের ঋণ। যা অবধারিতভাবে আপনার মাথায় পড়েছে। এবারের বাজেটে সরকার ঋণ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ করেছে টাকা। যা বাজেটে কোন একক খাত হিসেবে তৃতীয়। সেদিক থেকে দেখলে “বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ। এ হিসেবে প্র্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৬৭ হাজার টাকা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৬০ হাজার টাকা। এ হিসেবে ১ বছরে বেড়েছে ৭ হাজার ২৩৩ টাকা।” প্র্রস্তাবিত এ বাজেটে আগামী বছর তা আরও ৫ হাজার ৫৮৭ টাকা করে বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই ঋণ প্ররিশোধ বাবদ মোট বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে আপনি অবগত থাকেন বা না থাকেন, এই ঋণের বোঝা আপনাকে বইতে হবে।

শাণিত হবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন

পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে ঘাটতি বাজেট বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণিকে ক্রমাগত ঋণের দিকে ঠেলছে। গোটা বাজেট মূল্যায়ন করলে এ চিত্রটি আরোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু ঋণ নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যে সকল প্র্রকল্প নেয়া হচ্ছে, তার সাথেও জড়িয়ে আছে এ শক্তিগুলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার এখন গ্যাসের ওপর চাপ কমানোর কথা বলে কয়লা বা পারমাণবিক উৎসের দিকে যাচ্ছে। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালি ও মাতারবাড়ি প্র্রকল্পগুলো নির্মাণের কাজ বহুজাতিক কোম্পানি সম্পন্ন করবে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোম্পানির সাথে ৪টি চুক্তি সম্পাদন করেছে। সারাদেশে যে ১’শটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে, তাও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাধ্যমেই সম্পাদিত হবে। শুধু তাই নয়, রেল-সড়ক যোগাযোগের কাজটাও একইভাবে সম্পাদিত হবে। এখানে এই সমস্ত কর্মকাÐগুলো প্র্রধানত সম্পাদিত হবে ভারত, রাশিয়া ও চীনের কোম্পানিসমূহের দ্বারা; যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতি প্র্রবাহেরও নির্দেশক। ফলে সরকার যে উন্নয়নের প্র্রচার করছে, তা বাস্তবে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডটাই ভেঙে দেবে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ যেমন তীব্র হবে, তেমনি রাজনীতিতে শাণিত হবে ভারত-চীন-রাশিয়াসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্র্রবল আধিপত্য।

এ বাজেট জনস্বার্থ বিরোধী

ভোট ডাকাতির মাধ্যমে অনির্বাচিত অবৈধ সরকারের অগণতান্ত্রিক কায়দায় প্র্রণীত এ বাজেটে জনগণের প্র্রতি কোন প্র্রকার দায়বদ্ধতা প্র্রতিফলিত হয়নি। বরং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের জন্য অন্যায্য সুবিধা প্র্রদানের মধ্য দিয়ে ধনিক শ্রেণী তোষণের এ বাজেট বর্তমান শোষণ-বৈষম্যের চিত্রকেই তুলে ধরেছে। নিত্য পণ্যের উপর করারোপের ফলে জনগণের উপর আবারো মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপবে। ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে সুস্পষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। নেই শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘবে কোন প্র্রকার ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীদের কর ছাড়, সারচার্জ কমানোর ঘোষণা থাকলেও কৃষকদের ফসলের নায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কোনো প্র্রকার প্র্রণোদনা কিংবা প্ররিকল্পনা নেই। ব্যাংকসহ আর্থিক খাত ধ্বংসের জন্য দায়ী খেলাপীঋণ আদায়ে ও টাকা পাচার বন্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে বরং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অপরাধীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। উপরন্তু বিশাল অংকের ঋণের বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না রেখে মাথাভারী প্র্রশাসন ও তথাকথিত মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে মেগা দুর্নীতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এ বাজেট গণবিরোধী।

সাম্যবাদ জুলাই ২০১৯

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments