বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সারাদেশে অব্যাহত নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আজ ৭ অক্টোবর ২০২০ নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করেছেন:
“সারাদেশের শোষিত নির্যাতিত মানুষ এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাথে আমরা উদ্বিগ্নতার সাথে লক্ষ করছি যে, আমাদের দেশের বুকে কী ভয়াবহ নারী নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে। আপনারা জানেন-সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলি লক্ষ করলেই দেখতে পারবেন-ঘটনার পর ঘটনা ঘটছে। আমি কিন্তু সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি না। কারণ, অনেক ঘটনা আপনারা নিজেরা জানেন। আমি দুই-তিনটি মর্মান্তিক ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। এই ঘটনাগুলি হলো-আপনারা জানেন যে, কুষ্টিয়ায় একটা ঘটনা ঘটেছে, যেখানে স্বামী তার স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করছিল। এমন সময় স্ত্রীর বোন তাকে রক্ষা করতে যায়। তখন তাকে তার স্বামী রেপ করে। তারপরে তার স্বামীর ভাইয়েরা মেয়েটিকে রেপ করে। এ কী ভয়ংকর দৃশ্য! এসব কান্ড বাংলাদেশে ঘটে চলেছে। তারপরে মাদ্রাসার এক ছাত্রী, তাকে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ধর্ষণ করে পালিয়ে গেছে। মাদ্রাসাগুলি হয়ে গেছে একেবারে নারীনির্যাতনের বড় কেন্দ্র। আপনারা জানেন যে, সিলেটে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন কীভাবে একজন গৃহবধূকে নির্যাতন করল। তার স্বামীকে বেঁধে রেখে এ কী ভয়ংকর অত্যাচার। আরও একটা ঘটনা বলি, নোয়াখালীতে এক গৃহবধুকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হলো। কারা এগুলো ঘটনা ঘটাচ্ছে তা আপনারা জানেন। আমি কয়েকটি ঘটনার কথা বললাম। কী অবস্থা দেখুন-মানুষের নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ কোথায় নেমে গেছে! আমাদের যুব সমাজ কি তাদের মা-বোন-আত্মীয় স্বজনের সম্মান রক্ষার ক্ষমতা রাখে? বাবা হয়ে সন্তানকেও অত্যাচার করেছে-এমন ঘটনাও আছে। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে। মেয়েরা কিছু কিছু প্রতিবাদ করছে, কিন্তু যে প্রতিবাদ সারাদেশে হওয়া দরকার, তা হচ্ছে না। এটাতো শুধু মেয়েদের বিষয় না, এটা সমস্ত মানব সমাজের ব্যাপার, সমস্ত সভ্য শিক্ষিত মানুষের জন্য ভয়ংকর ব্যাপার।
নারী নির্যাতন শুরু হয়েছে সেই নারী যখন পুরুষের অধীনস্থ হলো তখন থেকে। আর এখন পুঁজিবাদী সমাজে আরও বীভৎস রূপ নিচ্ছে। এভাবে আমাদের দেশে মানুষ আর মানুষ থাকছে না, আত্মকেন্দ্রিক এবং সমস্ত ধরনের মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে। এই যে ভয়ংকর কান্ড কোথা থেকে এটা হচ্ছে? শোষক শ্রেণির যে চেহারা, তারা যে লুটপাট করছে, সমস্ত ধরনের সামাজিক অন্যায়-অবিচার করছে, বড়লোক হচ্ছে-তা দেখে যুব সমাজের মধ্যে আর কোনো বাঁধন নেই। তারা এসব দেখে ভাবছে-বাঁচতে হলে এই করতে হবে। লুটপাট করতে হবে, জবরদস্তি করতে হবে। যখন সমাজে অন্যায় চলে, তখন নারীর ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার আসে। কারণ নারীকে কেন্দ্র করে পুরুষ মানুষের যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তা আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গড়ে ওঠেনি। আমেরিকা-ইউরোপে সমান অধিকারের ধারণা গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দালাল রাজাকার-আলবদররা আমাদের মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছিল, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মেয়েদেরকে যে অত্যাচার করেছে, তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। লাখ লাখ মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছে। এসময় যারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে কিছুটা নীতি-নৈতিকতার ধারণা ছিল। দেশের স্বাধীনতার যে লড়াই সেটাই মানুষের মধ্যে এই নৈতিকতার ধারণা দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এই পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হয়েছে। এরশাদ যে ছিল, সে কী ভয়নক লোক ছিল আপনারা জানেন। মেয়েদের নিয়ে কি নোংরামি সে করেছে।
যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা আছে, তা চালু থাকলে মেয়েদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আর উপায় নেই। ফলে আসুন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। আমি সমস্ত সেক্টরের মেয়েদের, সিনেমা-শিক্ষা-বিজ্ঞান সমস্ত সেক্টরের মেয়েদের এগিয়ে আসতে বলছি। আমরা জানি নারী-পুরুষ মিলেই একটা সমাজ। তাই সবাইকে বলছি প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে। আমি সমস্ত বাম-প্রগতিশীল শক্তিকে জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ করে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রতিরোধই পারে অপরাধকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অপরাধকে আমরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে।”