আগামী ১৭মার্চ ‘মুজিববর্ষ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকায় আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলাদেশ সরকার সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদীকে, যিনি ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়ে হাজারো মানুষকে খুন করেছেন। সম্প্রতি দিল্লীতে তার দল বিজেপি’র সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক আক্রমণে ৪৮ জন নিহত হয়েছে। মুসলিম মহল্লাগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, গৃহহারা হয়েছে লক্ষ মানুষ। পুলিশ ও প্রশাসন ছিল নিস্ক্রিয়। বিজেপি-আরএসএস ধর্মের নামে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করছে। ভারতের সংসদে ধর্মীয় বিভেদমূলক নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) পাশ করানো হয়েছে। নাগরিকত্ব যাচাইয়ে জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) তৈরির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আসামসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে রোহিঙ্গাদের মত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর শংকা তৈরি হয়েছে। কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীকার কেড়ে নিয়ে সামরিক দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। বিজেপির সহযোগী আরএসএস-বজরং দল-শিবসেনা মুসলমানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, গো-রক্ষার নামে আক্রমণ, এমনকি পিটিয়ে হত্যার বর্বর ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা প্রতিদিন মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছে ধর্মীয় উগ্রতার বিষাক্ত বীজ।
এটা ভারতবর্ষের একটা চিত্র, এর বিপরীত চিত্রও আছে। নাগরিকত্ব আইনের নামে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার চক্রান্ত রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতের সাধারণ মানুষ। শিল্পী-সাহিত্যিকরা সরকারী পুরস্কার বর্জন করেছেন, বিজ্ঞানীরা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন, লেখক-সাংবাদিক-চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়। দিল্লীতে যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালালো বিজেপি, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অনেক মুসলিম পরিবারকে বাঁচিয়েছেন প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ। ভারতের জনগণের এই অভূতপূর্ব লড়াইকে সংহতি জানিয়ে ঢাকায় ছাত্ররা মিছিলে শ্লোগান তুলেছে — ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ-ভারত একসাথে।’ অন্যায়ের-শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের লড়াইয়ের সাথে বাংলাদেশের জনগণ একাত্মতা বোধ করে, প্রেরণা পায়।
ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণীর শোষণে সাধারণ মানুষের দিশেহারা অবস্থা। অর্থনীতিতে সংকট চলছে। রাজ্যে রাজ্যে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে। অথচ বিরাট বিরাট কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সম্পদ বাড়ছে। জনজীবনের দুর্দশা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো ও জনগণকে বিভক্ত করে আন্দোলন গড়ে উঠার পথ বন্ধ করার জন্যই উগ্র ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন যোগাচ্ছে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠী। ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে বিজেপি বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিক তালিকা ইত্যাদি সামনে এনেছে। এর বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ গণজাগরণকে ধ্বংস করতেই আজ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালানো হচ্ছে। বিজেপি সরকারের এই অশুভ পদক্ষেপ সারা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে বাড়িয়ে তুলছে। ধর্ম-বর্ণ-জাতিগত বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মিলিত প্রতিরোধ আজ জরুরি প্রয়োজন।
অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার তার ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করতে ভারতের প্রতি নতজানু নীতি অনুসরণ করে চলেছে। যার কারণে বিজেপি সরকার কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলায় প্রশ্রয়দানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটুকুও জানাতে পারছে না। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের কথা এদেশের মানুষ জানেন। তিস্তাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারত একতরফা পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অথচ ভারতের বন্ধুত্ব লাভে গর্বিত এই সরকার বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যাটুকু আদায় করতে পারছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারত বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। ট্রানজিটের নামে ভারতের মালামাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের বিপর্যস্ত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রায় বিনা শুল্কে। দেশের প্রয়োজন ঠিকমত মেটাতে না পারা চট্টগ্রাম বন্দরকে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি পরিচালিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ভারতীয় পণ্যের অন্যতম বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ, অথচ এদেশের পণ্য ভারতে ঢুকতে নানা অজুহাতে বাধা দেয়া হয়। সীমান্তে প্রায়ই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। প্রতিবাদ করা তো দূরে থাক্, বাংলাদেশের মন্ত্রীরা হত্যাকান্ডের পক্ষে সাফাই গাইছেন নিহতদের ‘গরুচোর’ বলে।
নিরপরাধ মানুষের রক্তে হাত রাঙানো ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদির অভ্যর্থনা বাংলাদেশে হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন চালিয়ে গণতন্ত্রকে পদদলিত করছে প্রতিদিন। তাদের সাথে নরেন্দ্র মোদির কোন বিরোধ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক চিন্তার মানুষ এদেশে মোদির আগমনে ক্ষুব্ধ। ভারতের জনগণ ১৯৭১ সালে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল। কিন্তু, ভারতের শোষিত-নিপীড়িত জনগণ আর সে দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী এক নয়। ভারত রাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল-শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশের সাথে আধিপত্যবাদী আচরণ করছে। ভারতের শাসকদের সমর্থনের বিনিময়ে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিচ্ছে — তা এদেশের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ মেনে নিতে পারে না। তাই আসুন, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবিতে ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিকারী নরেন্দ্র মোদীকে ঢাকায় আমন্ত্রণের প্রতিবাদ জানাই। পাশাপশি, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্য গড়ে তুলি। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বাসদ (মার্কসবাদী)সহ বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বিভিন্ন বামপন্থী দল যুক্তভাবে নরেন্দ্র মোদীর সফরের প্রতিবাদে কালোপতাকা প্রদর্শনসহ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। এতে আপনাদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন প্রত্যাশা করি।