Sunday, November 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুন-জুলাই ২০১৬নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক লাঞ্ছনা — এ সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কোথায়?

নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক লাঞ্ছনা — এ সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কোথায়?

পীরগাছা

একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা মানুষ যেন ভুলতে বসেছে। দুর্বিনীত রাজনৈতিক ক্ষমতা, কাড়ি কাড়ি অর্থের দাপটের কাছে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে মনুষ্যত্ব-বিবেক আর মূল্যবোধ। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান-শ্রদ্ধার সম্পর্কের বিপরীতে এ যেন শিষ্টের পালনে দুষ্টের শাসন। এমন-ই একটি ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলে। যেখানে মহাজোট সরকারের সাংসদ সেলিম ওসমান সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা অভিযোগ তুলে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে। শুধুমাত্র ক্ষমতার জোরে এমন নির্লজ্জ ঘটনার জন্ম দিতে পেরেছেন এই সাংসদ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এমন ঘটনা কল্পনারও অতীত। দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়াই করা এদেশের সাধারণ মানুষ তাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদ হয়েছে কিন্তু আজও বিচার হয়নি সেই অভিযুক্ত সাংসদের। বরং ঘটনার সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে ইসলাম রক্ষার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। লাঞ্ছিত সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তিনি নাকি ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ঘটনার সাক্ষী সেই স্কুলের ছাত্র, ছাত্রের অভিভাবক এমনকি কয়েকজন শিক্ষক পর্যন্ত এই অভিযোগকে মিথ্যা বলেছেন। তাহলে কোন্ যুক্তিতে সেলিম ওসমানের সাঙ্গপাঙ্গরা এমন অভিযোগ দাঁড় করাতে পারলো? কোন্ উদ্দেশ্য থেকেই বা তারা তা করলো? নির্যাতিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেছেন, ‘১৭ বছর ধরে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করলেও কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হলো নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাঁর বোনকে এই পদে বসাতে চান।’ বাস্তবে সেলিম ওসমান ওই ব্যবস্থাপনা কমিটির ইন্ধনে প্রধান শিক্ষককে অপমান করেছেন। আজ দেশে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে যেকোনো ধরনের অন্যায় এমনকি মানুষ হত্যা পর্যন্ত জায়েজ করার চেষ্টা হয় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে। তাই ধর্মীয় নৈতিকতার ন্যূনতম কিছু সেলিম ওসমান ধারণ না করলেও ‘ধর্ম রক্ষায়’ তিনি এ কাজ করেছেন। বুর্জোয়া রাজনীতির নোংরা খেলা আর গোষ্ঠীস্বার্থে ধর্ম কীভাবে ব্যবহৃত হয়—এ ঘটনা তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ধর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মানেই কি অপরাধ? আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক ছাড়া সত্যে উপনীত হবার আর কোনো রাস্তা আছে কি? কিন্তু বলতেই হয়, এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ আমাদের দেশে নেই। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই, ধর্মীয় ব্যাখ্যার চেয়ে ভিন্ন কোনো আলোচনা কেউ করলো, তাহলেও কি তাকে অপমান করা যায়, শারীরিকমানসিক নির্যাতন করা যায়? এর সাথে কি গণতন্ত্র-সভ্যতার কোনো সম্পর্ক আছে? এ তো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ইউরোপে মধ্য যুগে খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা এমনকি খ্রিস্টধর্মের সংস্কারের চেষ্টা যারা করতেন তাদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। সেটা ছিল অন্ধকার যুগ। মধ্য যুগের সেই অন্ধকারকে বিদীর্ণ করেই একদিন ইউরোপের দেশে দেশে কালক্রমে পৃথিবী জুড়ে চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা এসেছিলো। ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ এর জায়গায় স্থান পেয়েছিলো ভলতেয়ারের সেই অমোঘ বাণী, ‘What is reasonable, that is acceptable, that is truth.’ অর্থাৎ পূর্বনির্ধারিত ধারণা নয়, যুক্তি আর বিজ্ঞানের কষ্ঠিপাথরে নির্ণীত হবে যেকোনো চিন্তার সত্যতা। নবজাগরণের সেই মহান ধারণাগুলো আজ কোথায়? এদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথেও তো জনগণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ছিলো। কিন্তু আজ কি পরিস্থিতি? এখন এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান, ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষের ২৪ বছরের সংগ্রামের চেতনা আজ অনেকটুকু ম্লান। শাসকরাও চায় জনগণের চেতনার মানকে এই স্তরে নামিয়ে আনতে। ধর্মীয় উন্মাদনার প্রবল জোয়ারে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাকে ধসিয়ে দিতে চায়। তাই আমরা দেখি, ১৭ বছর ধরে সুনামের সাথে যে শিক্ষক শিক্ষকতা করলেন, তাঁর এমন লাঞ্ছনা-অপমানেও উপস্থিত ছাত্র-জনতা সেই সাংসদের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা নিতে পারলো না।

এক চূড়ান্ত পাশবিক ও অমানবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা আজ পথ চলছি। ধর্মের নামে মানুষ খুন হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। তাদের কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউবা খ্রিস্টান, এমনকি মুসলমান। লালনভক্ত বলে খুন হয়েছেন কুষ্টিয়ার একজন মুসলিম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, বর্বরতম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন সঙ্গীত প্রেমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মুক্তবুদ্ধির বিজ্ঞান-লেখক, ব্লগার, প্রকাশক এমনকি সাধারণ মুদি দোকানদার। বিভিন্ন সময়ে এসব হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছে আইএস, আলকায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা বা অন্য কোনো ইসলামি জঙ্গী গোষ্ঠী। সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে এসব হত্যাকান্ডের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার কথা বারবারই অস্বীকার করেছে। জনগণও তাই ধোঁয়াশার মধ্যে। এসব ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধর্মের নামে বর্বরতম কর্মকান্ড এখানে চলছে। আর এসব ঘটনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে সেই রাজনীতি বা সেইসব রাজনৈতিক দল যারা কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। তারাই গোটা দেশ জুড়ে অর্থনৈতিক শোষণ-দুর্নীতি-লুটপাটের মৃগয়া ক্ষেত্র রচনা করে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল অধিকার মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যায়, অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে প্রতিদিন নারী নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করে। সেলিম ওসমানরা এমন নোংরা রাজনীতির-ই ধারক ও বাহক। এরাই সারাদেশে নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় উগ্রতার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশ আজ মহাসংকটের কাল অতিক্রম করছে। এ সংকটের প্রধান কারণ দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সবই আজ ধুলিসাৎ। এ কারণেই দেশে আজ ধর্মকে পুঁজি করে নির্যাতনহত্যাকান্ডের মতো জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এরকম সংকটময় পরিস্থিতিতে, যখন সত্য যুক্তি-ন্যায়বোধ ভুলুণ্ঠিত, তখন দেশের সকল শিক্ষিত-সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্ধকার যখন আজ গোটা জনপথকে গ্রাস করছে তখন নিশ্চুপ থাকার কোনো অবকাশ নেই। ধার্মিক মানুষদেরও এই চরম অধার্মিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সাম্যবাদ জুন-জুলাই ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments