জনগণের নিরাপত্তা দেবে কে?
সাম্যবাদ প্রতিবেদক
অপমৃত্যুর মহোৎসব চলছে দেশে। তারই মধ্যে নারায়ণগঞ্জে নৃশংস ৭ খুন এবং ফেনীতে প্রকাশ্য দিবালোকে একজনকে খুন করে গাড়িসহ জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা মানুষের সংবেদনশীলতা ও চেতনায় প্রবল নাড়া দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে সরকারি দলের স্থানীয় দুই নেতার বিরোধে একসাথে ৭ জন মানুষকে অপহরণের পর খুন করে বস্তায় ভরে ইঁট বেঁধে নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেয়া হল। মানুষ কতটা বর্বর ও দয়া-মায়াহীন হলে একজনকে টার্গেট করতে গিয়ে শুধু সাথে থাকার কারণে আরো ৬ জনের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে? এদের মধ্যে একজন আইনজীবী ও দুইজন ড্রাইভার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অপরাধে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন যাদের সাথে খুনীদের কোনো বিরোধ ছিল না। আর তাই মানুষের মনে এ প্রশ্ন জেগেছে — অপরাধীরা কতটা ক্ষমতাশালী ও বেপরোয়া হলে প্রকাশ্যে রাস্তা থেকে এতগুলো লোককে তুলে নিতে পারে এবং অপহৃতদের উদ্ধারের দাবিতে বিক্ষোভ ও মিডিয়ায় তোলপাড়ের মধ্যেও তাদের খুন করে এত লাশ গুম করতে পারে? অর্থাৎ অপরাধীরা নিশ্চিত যে কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। এখান থেকেই জনমনে সন্দেহ দেখা দেয়, এর সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় এলিট বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। কারণ এই বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম-অপহরণ ও বিনা বিচারে হত্যার প্রচুর অভিযোগ অতীতে এসেছে। নিহত নজরুলের স্বজনরা অভিযোগ করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন র্যাব-১১ এর শীর্ষ কর্তাদের ৬ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে এই অপহরণ ও হত্যাকা- সংঘটিত করিয়েছে। লাশগুলো যে বস্তাতে বাঁধা হয় এবং লাশ ডোবানোর কাজে যে ইঁট ব্যবহার করা হয়েছে তার সাথে র্যাবের ব্যবহার্য সামগ্রীর মিল পাওয়া গেছে।
ফেনীতে সরকার দলীয় একজন জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে গাড়িসহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় আভিযোগের আঙুল সেখানকার স্থানীয় সরকার দলীয় এমপির দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় মানুষ সরাসরি র্যাব-পুলিশসহ প্রশাসনের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে। সরকারি দলের গডফাদার নেতাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ এদের সম্মিলিত দুষ্টচক্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রশ্রয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাসের লীলাভূমি আর মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। আর সন্ত্রাস-পেশীশক্তি নির্ভর দুর্বৃত্তায়িত আওয়ামি লীগ-বিএনপিসহ বুর্জোয়া রাজনীতির কাছে এসব সন্ত্রাসের গডফাদাররাই সম্বর্ধনা পেয়েছেন। তাদের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে বড় বড় জনপ্রতিনিধির পদ অলংকৃত করেছেন। প্রশাসনের সামান্য রদবদল, দু’একজনকে বরখাস্ত, তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রশাসনের চাতুর্যপূর্ণ আশ্বাসবাণী, লোকদেখানো গ্রেফতারের প্রহসন ইত্যাদিতে এমন মর্মান্তিক ঘটনাও একসময় ধামাচাপা পড়ে যাবারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে জনমনে আশংকা প্রবল হয়ে উঠছে। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যে জননিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের দায়বদ্ধতার ন্যূনতম পরিচয় মেলে না, বরং সমস্ত দায় ‘চক্রান্তের’ কাহিনী ফেঁদে বিরোধী পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত।
হয়তো অন্য অনেক ঘটনার মতো এটিও ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়ে যেত যদি লাশগুলো নদীতে ভেসে না উঠতো। শীতলক্ষ্যায় একের পর এক পেটচেরা লাশ ভেসে ওঠার দৃশ্য জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, নারায়ণগঞ্জবাসী রাস্তায় নেমে আসে, সারাদেশে বিক্ষোভ দেখা দেয়। গণবিক্ষোভ আঁচ করতে পেরে সরকার মুখ রক্ষার জন্য অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের অবসর প্রদান, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলির মত কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রী ‘যে কোনো মূল্যে’ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। অথচ অপহরণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশ-প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে জানানো হলেও অপহৃতদের উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ তারা নেননি। এমনকি অভিযুক্ত নূর হোসেন প্রকাশ্যে থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অপহরণের পর আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ শামীম ওসমান নূর হোসেনের সাথে বৈঠক করেন এবং ঘোষণা দেন সে এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে না। ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়া এবং নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ার পর এখন তিনি দাবি করছেন, সে যে এত বড় অপরাধী তা তিনি আগে বুঝতে পারেননি!
এদিকে, বিভিন্ন মহলের দাবি এবং আদালতের নির্দেশের ফলে সরকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে এবং এই ঘটনার বিচার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী ‘কঠোর অবস্থান’ নিয়েছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ, বছরের পর বছর ধরে মহাজোট সরকার এবং তার আগের বিএনপি সরকার র্যাবকে অঘোষিত দায়মুক্তি দিয়ে আসছে। সন্ত্রাসী দমনের নামে র্যাব-পুলিশকে বিনা বিচারে হত্যার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা র্যাবের কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের সরকারদলীয় গডফাদার ও সন্ত্রাসীরা যে আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তার জন্যও দায়ী দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উচ্চমহলের আশ্রয়-প্রশ্রয়। নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘ আন্দোলন ও সারাদেশের মানুষের দাবি সত্ত্বেও নিরপরাধ কিশোর ত্বকী হত্যার বিচার এখনো হয়নি, বরং অভিযুক্ত গডফাদার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন।
শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারাদেশে আজ বেপরোয়া লুটপাট-চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। জবরদস্তি ও কূটকৌশলের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়ে মহাজোট সরকার ও সরকারদলীয়রা আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তারা আইন ও জনমতের তোয়াক্কা করছে না। সরকারি দল-প্রশাসন-র্যাব-পুলিশ ও গডফাদারদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অশুভ চক্র যা দেশে জননিরাপত্তা ও আইনের শাসনের প্রধান অন্তরায়। এই হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের। অভিযুক্ত খুনী সরকারী দলের নেতা ও শামীম ওসমানের সহযোগী হিসেবে পরিচিত এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড নেতৃত্ব দেয়া র্যাব অধিনায়ক সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়। এই অবস্থায়, সরকারি দলের আশ্রয়পুষ্ট গডফাদার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম-অপহরণ-বিনা বিচারে হত্যার বিরুদ্ধে জনসাধারণকেই সংগঠিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং গণআন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় গডফাদারদের অপরাধের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। পাশাপাশি খুনী-সন্ত্রাসী-গডফাদারদের লালনপালন ও রক্ষা করে যে রাজনীতি তার ভয়ংকর চেহারা উপলব্ধি করে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী র্যাব কর্তৃক ক্রসফায়ারের নামে বিনাবিচারে হত্যার অভিযোগ এর প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই উঠেছে। পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অপহরণ-গুম। সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে র্যাবকে এসব বেআইনি কর্মকাণ্ড করার লাইসেন্স দিয়ে তাকে খুনি বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। এসবের পরিণতিতে ও আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নিয়ে র্যাবের অনেক সদস্যই অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে একে রসিকতা করে সরকারি ডাক্তারদের ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’-এর সাথে তুলনা করেছেন। নিরপরাধ মানুষ কীভাবে এর শিকার হয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ঝালকাঠির কিশোর লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করার পর আবার মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করার ঘটনা। কিছুদিন ধরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম-হত্যার কাজেও র্যাবকে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবসরে পাঠানো র্যাব-১১ অধিনায়কের নেতৃত্বেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীপুরে মিছিলে গুলি চালিয়ে বিএনপি কর্মী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা র্যাব দলটিকে ঘেরাও করে ফেললে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। গত উপজেলা নির্বাচনের আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে একজন বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে অপহরণ করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এর কোনো বিচার-শাস্তি হয়নি। সরকার নিজেই যখন র্যাবকে দিয়ে গুম-ক্রসফায়ার করাচ্ছে তখন তারাও সুযোগ মতো ব্যক্তিস্বার্থে তাদের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। গত ফেব্রুয়ারি মাসে র্যাবের এক মেজরের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরিকে অপহরণ করে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক পীরের দরবারে অভিযান চালানোর নামে ২ কোটি টাকা ডাকাতির অভিযোগে মামলা হয়েছিল র্যাব-৭ এর অধিনায়কের নামে। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়ারা গণতন্ত্রের বুলি জপতে জপতেই আজ আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করে ফ্যাসিবাদী শাসন পরিচালিত হচ্ছে। বিনা বিচারে আটক, সন্দেহবশত হত্যা বাড়ছে, সর্বজনস্বীকৃত নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বিএনপি আমলে র্যাব গঠন করা হয়েছিল অপারেশন ক্লিনহার্ট নামক ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ সেনা অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ধারাবাহিকতায়। শুরুতে র্যাব শীর্ষসন্ত্রাসী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘ক্রসফায়ার’ চালায়। পরবর্তীতে জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার না করলেও তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করে। এসবের মাধ্যমে জনমতকে বিভ্রান্ত করে বেআইনি কর্মকা- চালানোর ক্ষেত্র তৈরি করে। কিন্তু যতই অভিযান চালানো হোক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কিন্তু নির্মূল হয়নি। কারণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত সন্ত্রাস বন্ধ করা যায় না, এর জন্য চাই আর্থসামাজিক পরিবর্তন। উপরন্তু, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এই ব্যবস্থা আজ রাষ্ট্রের হাতে দমন-পীড়নের অসীম ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। আগামীতে যে-কোনো গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে। যেমন, সন্ত্রাস দমনের নামে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় শ্রমিকনেতাদের গ্রেপ্তার ও ভয় দেখানোর কাজে র্যাবকে ব্যবহার করা হয়েছে। যত অন্যায়ই করুক, র্যাবের মতো বিশেষ বাহিনী শাসকশ্র্রেণীর দরকার জনগণ ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি ও দমন-পীড়ন চালানোর জন্য। অবাধ শোষণ ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে এদেশে যে ধনকুবের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তারা এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে এরকম একটি বাহিনী হাতে রাখতে চায় যাদের দিয়ে আইনী পোশাকে যেকোনো কিছু করানো যায়। র্যাব শুরু থেকেই আইন-বিচার ও মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেনি, সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে এ বাহিনী পরিচালনা করা হয়েছে সামরিক কায়দায় মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নীতিতে। ফলে আইনের শাসন ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে হলে এ বাহিনী বিলুপ্ত করা দরকার। সরকার আন্তরিক হলে ও পক্ষপাতহীনভাবে আইনের প্রয়োগ করলে প্রচলিত সিভিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই সন্ত্রাসী-গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।
দেশে ছিনতাই, চাঁদাবাজী, নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন, গুম আর অপহরণ। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ৪ বছরে (২০১০-’১৪) প্রায় ২৬৫ জন মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৫ জন নিখোঁজ হয়েছে। অপরাধীরা বুক চিতিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে আর বিচার-প্রার্থী সাধারণ মানুষ ভয়-ভীতি-হুমকির মুখে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দিশাহারা, নয়ত মুখ বুজে ভয়াল দানবের পদতলে গুটি মেরে নীরব আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। গত ৪৩ বছরে এ ধরনের সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে আজ যে ব্যাপক রূপ নিয়েছে আর আমরাও সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা করে দেয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি – এর কারণ কি? এর উৎস কোথায় তার সন্ধান আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সূচনালগ্নে বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্বে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অর্থনীতিতে যেমন বেপরোয়া দুর্নীতি-লুটপাট তৈরী হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রশাসনে জবরদস্তি, দমনপীড়ন আর কালাকানুনের মাধ্যমে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এ পথে বুর্জোয়া রাজনীতিতে নীতি আদর্শের স্থান দখল করে নিয়েছে টাকা আর পেশী শক্তি। সমাজের স্তরে স্তরে কায়েমী স্বার্থের শক্তিকে মদদ দিয়ে পরিপুষ্ট করা হয়েছে। দেশের বিপুল বেকার যুবশক্তির একাংশকে অধঃপতিত করে সন্ত্রাসী বহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার এরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ‘ফ্রাঙ্কেনষ্টাইনের দানব’ হয়ে উঠলে সন্ত্রাস দমনের নামে ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’-র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চালানো হচ্ছে। দায়মুক্তি পাওয়া এ হত্যাযজ্ঞে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও বাদ যাচ্ছে না। এভাবে নীতি-আদর্শহীন বুর্জোয়া রাজনীতির ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়ে জনগণের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। একের পর এক লোমহর্ষক গুম-খুন-অপহরণের ঘটনায় তাদের হিংস্র নখ-দন্ত বেরিয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এরই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে।
গণতন্ত্রের অন্যতম একটা দিক প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। কিন্তু তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’-র আজ এ হাল দাঁড়িয়েছে যে জনমতকে শাসকরা কোন মূল্যই দেন না। পুলিশ প্রশাসন, আমলাবাহিনী দিয়ে শাসন চালান। পুলিশ-র্যাবও তাই এসব অপকর্মের সহযোগী। বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে, সার্চ করার নামে তাদের ঘরবাড়ি তছনছ করে, মহিলাদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করে এবং অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অনুগত গুন্ডাবাহিনীর যাবতীয় অপকর্মের বিষয়ে চোখ বুজে থেকে পুলিশ ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। দুর্নীতির মধুচক্রে ভাগ বসানোর জন্য সরকারি রাজনৈতিক দল, সমাজের টাকাওয়ালা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পুলিশ বিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজন মিলে পরস্পরের স্বার্থরক্ষার মধ্য দিয়ে যে অশুভ আঁতাত গড়ে তুলেছে তা থেকেই মূলত এ সন্ত্রাসের জন্ম নিচ্ছে। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে আলাদা করে কি ভূত তাড়ানো যাবে? আইনের রক্ষকই হয়ে উঠেছে আজ আইন ভঙ্গকারী, সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের রক্ষক অগণতান্ত্রিক শাসন-রূপ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার।
যেভাবে দেশ চলছে তাতে একদিকে সন্ত্রাসের উদ্ধত সঙ্গীণ উঁচিয়ে মানুষকে ত্রাস আর অজানা শঙ্কার মধ্যে ফেলে ভীতি প্রর্দশন করা হবে, অন্যদিকে জনগণের উপর শোষণ আরো তীব্রতর, মজবুত ও পাকাপোক্ত করা হবে। আর একই সাথে শাসক দলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ঢাকের বাদ্য বাজানো হবে। চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখেও দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় তথা বুদ্ধিজীবী মহলের একটা অংশ স্বার্থ-সুবিধার পঙ্কে নিমজ্জিত করে নিজেদের অধঃপতিত করেছেন। তারা শাসক দলের মিথ্যা প্রচারণার সরব অংশীদার। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তিলমাত্র অনুভব করেন না। অপর ক্ষুদ্র অংশের মানববন্ধন মার্কা প্রতিবাদে এ প্রতাপশালী অন্যায়কারী চক্রের কেশাগ্রও স্পর্শ করা যাচ্ছে না। খ্যাতনামা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র বহু বছর আগে এদের সর্ম্পকে বলেছিলেন, ‘‘দেশের বড় মঙ্গল — তোমরা একবার মঙ্গলের জন্য জয়ধ্বনি কর। এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটা কথা জিজ্ঞাসা করার আছে, কাহার মঙ্গল? হাশিম শেখ আর রামা কৈবর্ত দুই প্রহর রৌদ্রে খালি মাথায় এক হাটুঁ কাদার উপর দিয়ে দুইটা অস্থিচর্ম বিশিষ্ট বলদে হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে। উহাদের কি মঙ্গল হইতেছে? উপবাস, সপরিবারে উপবাস। বল দেখি, চশমা নাকে বাবু, ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে? তুমি লেখাপড়া করিয়া ইহাদের কি মঙ্গল সাধিয়াছ? আমি বলি অনুমাত্র না, কণামাত্র না।”
গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথেই দেশে বিরাজিত সন্ত্রাস অরাজকতা ও জনগণের জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী শাসকগোষ্ঠীর এসব কর্মকা- মোকাবেলা করা সম্ভব। জনগণের প্রবল আকুতি থাকা সত্ত্বেও আকাক্সিক্ষত সেই গণআন্দোলনের ধারা গড়ে উঠছে না। বামপন্থী শক্তির কিছু বিক্ষিপ্ত বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে ব্যাপক জনগণকে যুক্ত করা যাবে না একথা প্রমাণিত। আর তাতে এ দুঃশাসনের গায়ে সামান্য আচঁড় বসানোও সম্ভব নয়। কীসের অভাব? এদেশে নিষ্ঠাবান ত্যাগী নেতা-কর্মীর অভাব তো কখনও হয়নি। সমাজদেহে প্রবাহিত প্রবল ব্যক্তিস্বার্থ-ভোগবাদী সংস্কৃতির চোরাস্রোত মোকবেলা করে হাজার হাজার কর্মীরা এখনো রাজপথে সক্রিয়। অথচ গণআন্দোলন গড়ে উঠছে কই? বামপন্থীদের একটা অংশ দোদুল্যমানতায় আচ্ছন্ন, নয়তো বিভ্রান্তির জটাজালে বন্দি। সমস্ত সংকটের উৎস যে এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা — এ কথা অনেকে স্পষ্টভাবে আজও বুঝতে পারছেন না। গত ৪৩ বছর ধরে পুঁজিবাদ ক্রমাগত সংহত হয়েছে, আপেক্ষিক অর্থে শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলেছে, মুষ্টিমেয় ধনকুবের গোষ্ঠীর জম্ম দিয়েছে। তারাই আজ প্রবল প্রতাপে শাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে তারা ভয়-ভীতি-ত্রাসের রাজত্ব কায়ম করেছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের খোলস পড়ে ফ্যাসীবাদ আনছে। মিডিয়া কখনো ‘শক অবজারভার’-এর মতো ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে ‘ওপেনিয়ন ম্যানুফ্যাকচারিং’-এর মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের সহযোগী হয়ে উঠে।
আমরা বাম গণতান্ত্রিক দল ও শক্তির প্রতি এ পুঁজিবাদী শোষণ ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের পথে জনগণের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহবান জানাই। জনগণের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, গণসংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলি। কারণ লড়াই ছাড়া বাঁচার ভিন্ন কোন পথ নেই। আসুন — খুনী বাহিনী র্যাব বিলুপ্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম-অপহরণ-ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করা, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যাসহ প্রতিটি গুরুতর অভিযোগের তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করা, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের সাথে জড়িত র্যাব কর্মকর্তা ও সন্ত্রাসী-গডফাদারদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার-বিচার এবং সন্ত্রাসী-গডফাদারদের সরকারি প্রশ্রয়দান বন্ধ করার আশু দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলি।