Saturday, December 21, 2024
Homeসাম্যবাদন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলনে আলুচাষীরা

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলনে আলুচাষীরা

potato-001কৃষিমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আল্লা তুমি আরো আলু দাও’, আর অন্যদিকে দাম না পেয়ে হাহাকার করছে উত্তরবঙ্গের আলুচাষীরা। পাওনাদারদের ভয়ে তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত আলুচাষীরা সরকারি অব্যবস্থাপনা, কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের কারসাজি আর মধ্যস্বত্তভোগী ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের বীরগঞ্জে আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আলুচাষীরা দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কে বস্তা বস্তা আলু ফেলে ১ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। ফেলে দেয়া আলুর ওপর শুয়ে জানায় তাদের আহাজারি আর কষ্টের কথা। নিজেদের দুর্দশা আর দাবি-দাওয়ার কথা জানাতে চাষীরা এরপর যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে, ইউএনওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
মহাজন বা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজের সামান্য জমিতে অথবা বর্গা জমিতে আলু চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন উত্তরবঙ্গের অনেক কৃষক। উদয়াস্ত রক্তজল করা শ্রম দেন। বাম্পার ফলনও হয়। দারিদ্র্যের পীড়ন তবু কমে না কিছুতেই। বরং বাম্পার ফলন চাষীদের জীবনে দুঃখই নিয়ে আসে কেবল। কয়েক বছর ধরে নিয়মিতই ঘটছে এ ঘটনা। অনেক কষ্ট করে ধার-দেনায় আলু চাষ করে উৎপাদন খরচই তুলতে পারছে না আলুচাষীরা। এ বছর ১ একর জমিতে আলু চাষ করতে যেখানে খরচ হয়েছে ৬৩ হাজার ২০০ টাকা সেখানে ১ টাকা ৮০ পয়সা কেজি দরে আলু বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। আলু পঁচনশীল সবজি। হয় কোল্ডস্টোরেজে রাখতে হবে, নয়ত বিক্রি করতে হবে। এলাকাগুলোতে যত আলুর ফলন হয়, তত কোল্ডস্টোরেজ নেই। যেসব কোল্ডস্টোরেজ আছে সেখানেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা। বাজারে যে দাম ওঠে, তাতে অনেক সময় কোল্ডস্টোরেজে রাখার খরচও ওঠে না। এমনই নানা সমস্যার জালে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে আছেন দেশের আলুচাষীরা।
Dinajpur_Potato-4আসলে শুধু আলুচাষীরাই নন, দেশের মধ্যচাষী, গরিবচাষী সকলেরই এক অবস্থা। ধান-আলু-সবজি কোনো ফসলেই চাষীদের লোকসান ছাড়া লাভ হয় না। উত্তরবঙ্গের মাঠে মাঠে যখন আলু বিক্রি হচ্ছে দেড় টাকা-দুই টাকা কেজি দরে, রাজধানীসহ দেশের শহরাঞ্চলের বাজারগুলোতে আলুর দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকার কম নয়। জলের দরে আলু বিক্রি হলেও দেশের খুচরো বাজারে নেই তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন। বাজার অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে মধ্যস্বত্তভোগীরা বিশাল অঙ্কের মুনাফা লুটছে। অন্যান্য সবজি, রবিশস্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
সর্বস্বান্ত আলুচাষীরা বার বার সরকারের কাছে প্রতিকার চাইলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচার তাগিদে তারা রাস্তায় নেমে এসেছেন। গড়ে তুলেছেন আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদ। এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়ার গ্রামে গ্রামে, হাটে-হাটে সভা-সমাবেশ করে আলুচাষীদের সংগঠিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় বীরগঞ্জ পৌর শহরের পুরাতম শহীদ মিনারের সামনে দিনাজপুর-পঞ্চগড় সড়কে আলুচাষীদের এ প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদ বীরগঞ্জ উপজেলা শাখার আহ্বায়ক ফারুক হোসাইন, আলুচাষীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নিজপাড়া ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের মো. আলীমুদ্দিন, শম্ভুগাঁও গ্রামের মো. ইউসুফ আলী, ভোগনগর ইউনিয়নের ভোগনগর গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম, পাল্টাপুর ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামের মো. আব্দুস সালাম, সাতোর ইউনিয়নের প্রাণনগর গ্রামের মো. আব্দুর রশিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব এবং সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর আলম মিঠু।
আলুচাষী আলীমুদ্দিন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ৩ একর আলু চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ১লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু দাম না থাকায় ক্ষেতেই আলু পড়ে আছে। পাইকার এসে ৩একর আলু ১০ হাজার টাকা বলে গেছে। তাই আলু তুলে নিয়ে এসে রাস্তায় ফেলে দিলাম। দেশবাসী জানুক, কৃষকরা কেমন কষ্টে আছে। আলুচাষীরা দুঃখ করে বলছেন, এক কাপ চায়ের দামে তিন কেজি আলু পাওয়া যায়, ১৮ কেজি আলু বিক্রি করে এক কেজি চাল কিনতে পারি না। পাওনাদারদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা যে দুর্দশার মধ্যে আছি, দেশের সরকার তা দেখেও দেখে না।
শুধু আলীমুদ্দিন নন, রাস্তা অবরোধ করে শত শত কৃষক দেশবাসীর বিবেকের কাছে এই প্রশ্নই রেখেছে,নিজের গায়ের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে দেশবাসীর আহার জোগায় যে কৃষক দিনান্তে কিনা সেই থাকে উপবাসী? এ অন্যায় অবিচার আর কতদিন চলবে? তাই রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম তথা গোটা উত্তরবঙ্গের কৃষকদের সাথে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদ। সরকারি উদ্যোগে উৎপাদন খরচের সাথে ৩৫% মূল্য সহায়তা দিয়ে চাষীদের কাছ থেকে আলু ও সব্জি ক্রয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোল্ডস্টোরেজে প্রকৃত চাষীদের আলু সংরক্ষণ, বস্তা প্রতি কোল্ডস্টোরেজের ভাড়া ১৫০ টাকা নির্ধারণ, আলু ও সব্জি সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ, বেসরকারি কোল্ডস্টোরেজের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, বিএডিসি-কে সচল ও সার-বীজ-কীটনাশক সরবরাহ করে আলু চাষের এলাকায় আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা,কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষিত আলুর উপর সহজ শর্তে প্রকৃত চাষীদের কৃষি ঋণ ও কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষিত আলু পঁচে গেলে/ক্ষতি হলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবিতে সংগঠিত হচ্ছে আলু চাষীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কৃষকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।Potato_6_42113

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments