Tuesday, December 24, 2024
Homeফিচারপাটকলের শ্রমিক - আবারও নামতে হবে রাস্তায়

পাটকলের শ্রমিক – আবারও নামতে হবে রাস্তায়

পাটকলশ্রমিকরা কারখানা ছেড়ে রাস্তায় নামলেন গত মে মাসে, ঈদের আগে। মজুরি কমিশন, বকেয়া মজুরিসহ ৯ দফা দাবিতে গত ২ এপ্রিল থেকে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করেন তারা, একইসঙ্গে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এরপর ১৫ এপ্রিল থেকে তারা ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন। ১৫ এপ্রিল রাতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও বিজেএমসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের পর তাদের আশ্বাসে শ্রমিকরা কর্মসূচি স্থগিত করেন। শ্রমিকদের আন্দোলনের চাপে ঈদের আগে সরকার বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি পূরণ হয়েছে কি? তাদের কি আর এই দাবিগুলোকে কেন্দ্র করে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না? সরকার কি সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

মজুরি কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে কোন কথা নেই সরকারের

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ বাজারে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকলের শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ৪২০০ টাকা। অথচ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সেই ২০১৫ সালেই সরকারি পাটকলের শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশন ৮৪০০ টাকা মজুরির ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর চার বছর কেটে গেল, সরকার কথা রাখেনি। এবারের আন্দোলনে তাই বকেয়া বেতনের সাথে মজুরি কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবি উঠেছিল। ঈদের আগে সরকার সব দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তা ছিল বকেয়া বেতন পরিশোধ করে শ্রমিকদের বাড়ি পাঠানোর নাটকমাত্র। সে কারণে ঈদের পর এই মজুরি কমিশন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোন কথা নেই। কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বরা হচ্ছে, শুধুমাত্র খুলনার ৯টি সরকারি পাটকলে সাপ্তাহিক মজুরি ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। মজুরি কমিশন কার্যকর হলে মজুরি হবে প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া মজুরি কমিশনের ৪ বছরের এরিয়ার জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এ টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ৯টি পাটকলে গড়ে বছরে লোকসান হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রির অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। সে কারণে সময়মতো মজুরি দিতে পারছেন না কর্মকর্তারা, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন কিভাবে করবেন তা নিয়েও তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

সত্যিই কি বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা কমে গেছে? সত্যিই কি বিক্রি করতে না পারার কারণে লোকসানে আছে পাটশিল্প ও পাটখাত?

পাটশিল্প বিপুল সম্ভাবনাময়

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়বে বিপুলভাবে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিতকরণে আইন পাস করেছে। তারা এর বর্তমান ব্যবহারের ৮০ শতাংশ কমিয়ে দিতে চায়। আগামী ২০২০ সাল থেকে সারা ইউরোপে একযোগে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এ রকম পরিস্থিতিতে ‘রিসার্চ অ্যান্ড মার্টস’র এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ শুধু পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজার দাঁড়াবে ২৬০ কোটি ডলারের। বিশ্বে বর্তমানে ফুডগ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা যেখানে ৩২ মিলিয়ন এবং পাটের শপিংব্যাগের বৈশ্বিক বার্ষিক চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন সেখানে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত মিলে সরবরাহ করতে পারে মাত্র ফুডগ্রেড পাটের ব্যাগ ১২ মিলিয়ন আর শপিংব্যাগ মাত্র ৪০ মিলিয়ন। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জুট জিও টেক্সটাইলের (পাট থেকে তৈরি একধরণের টেক্সটাইল – যা রাস্তা, বাঁধ, বন্দর, পাইপলাইন সহ নানা নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়) চাহিদা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক মোবারক আহমদ খান পাটের আঁশ থেকে পলিমার ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ২০০৯ সালে এই বিজ্ঞানী পাটের সঙ্গে পলিমারের মিশ্রণ ঘটিয়ে মজবুত, তাপ বিকিরণরোধী ও সাশ্রয়ী ঢেউটিন ‘জুটিন’ বানান। একই প্রযুক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে তিনি হালকা অথচ মজবুত হেলমেট, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের রিং, চেয়ার, টেবিল, টাইলসসহ বেশ কয়েকটি নিত্যব্যবহার্য পণ্য তৈরি করেছেন। পাটের তৈরি পলিমারের ব্যাগ সাধারণ পলিব্যাগের চেয়ে দেড় গুণ টেকসই ও মজবুত। মাটি চাপা পড়লে পাট পলিব্যাগ চার থেকে পাঁচ মাস পর পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে। পানিনিরোধক এই পলিব্যাগ দামেও খুব একটা বেশি নয়। শহরকে পলিথিন মুক্ত ঘোষণা করতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ এই পলিব্যাগ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এরই মধ্যে ২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করছে। ‘ন্যাচারাল ফাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ নামে একটি সংস্থার ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের শুরুতে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পাটের দাম ১০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটা বড় অংশ তৈরি করবে পাটজাত পণ্য দিয়ে। পাট থেকে ভিসকস উন্নতমানের মিহি সুতা, জুটন (পাট ও তুলার সংমিশ্রনে তৈরি কাপড়) উদ্ভাবন পাটের সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু পাটের আঁশ নয়, পাটকাঠি বা পাটের সোলাও আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পাটকাঠি থেকে জ্বালানি হিসেবে চারকোল ও এর গুঁড়া থেকে ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি তৈরি হচ্ছে। পাট থেকে মন্ড ও কাগজ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া উপযোগী মাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকায় বাংলাদেশে পৃথিবীর সেরা জাতের পাট উৎপাদন হয়। আমাদের আছে গত ৫০-৬০ বছরে গড়ে উঠা অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি। পাট একসঙ্গে কৃষি ও শিল্পের সাথে যুক্ত থাকায় এ দুই খাতের বিকাশই এর উপর নির্ভরশীল। পাটকে কেন্দ্র করে কৃষি ও শিল্পখাতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন পাট শিল্প বিকাশে সরকারের সঠিক নীতি, পরিকল্পনা ও তার যথাযথ প্রয়োগ। সম্ভাবনা আছে বলেই বেসরকারী পাটকলগুলো লাভ করছে। এখন প্রশ্ন, এত বিপুল সম্ভাবনা সত্তে¡ও বাংলাদেশের পাট খাত ধুঁকছে কেন? আমাদের দেশের অর্থনীতকে তো আমাদের দেশের উৎপাদন ও দক্ষতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। উপরের আলোচনা থেকেও বোঝা যায় যে, এক্ষেত্রে সম্ভাবনা প্রচুর। তাহলে আসলেই কি লোকসান হচ্ছে নাকি কৃত্রিমভাবে লোকসান দেখানো হচ্ছে?

পাটশিল্পের লোকসান সমাচার

বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬টি রাষ্ট্রায়াত্ত¡ পাটকল ও ৭৬টি বেসরকারি পাটকল রয়েছে। পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা। ‘মিলস ফার্নিশিংস লিমিটেড’ নামের নন-জুট কারখানা ছাড়া বাকি ২৪টি প্রতিষ্ঠানই লোকসানে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর (জুট ও নন-জুট) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। পাটকলে লোকসানের বড় কারণ, যথাসময়ে পাট ক্রয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ না দেওয়া। জুলাই মাসে পাট কেনার মৌসুম হলেও অর্থ বরাদ্দে দেরীর অজুহাতে সরকারী কর্মকর্তারা সে পাট কেনেন অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে। ফলে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় যে পাট কেনা যায়; তা কিনতে হয় ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। ফলে লোকসানের বোঝা বাড়তেই থাকে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়াত্ত¡ কারখানাগুলোর কোনো আধুনিকায়ন হয়নি। চট্টগ্রামের আমিন জুট মিল স্থাপিত হয় ১৯৫৪ সালে, গত ৬৫ বছর ধরে সেই পুরনো যন্ত্রপাতিই চলছে। সবগুলো কারখানায় বেশিরভাগ তাঁতই বিকল ও পুরাতন হয়ে পড়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ২০১৮-১৯ সালে বিজেএমসি’র পাট ক্রয়ের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ১৭.৯০ লক্ষ কুইন্টাল। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত পাট ক্রয় করা হয় ১.৫৮ লক্ষ কুইন্টাল যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮.৮৩%। অপরদিকে ১১,০২৩ টি তাঁতের বিপরীতে সচল আছে মাত্র ৫৫৪৮টি। ফলে ৮.৮৩% কাঁচামাল আর ৫০% সচল তাঁত দিয়ে অদক্ষ আমলা প্রশাসনের ভ্রান্ত নীতির বিপরীতে আমাদের পাটকল শ্রমিকরা তাঁদের দক্ষতায় সরকারি পাটকলসমূহকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অথচ সরকারী আমলারা লোকসানের  দায়ভার শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেন। বিজেএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান স¤প্রতি প্রথম আলোকে বলেন,“স্থায়ী শ্রমিকদের উচ্চ মজুরি পাটকলগুলোর লোকসানের প্রধান কারণ। প্রয়োজনের চেয়ে শ্রমিক বেশি। এ জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ে।” এর সাথে আমলারা শ্রমিক অসন্তোষকেও লোকসানের কারণ হিসেবে দেখান। অথচ পাট মন্ত্রণালয়েরই এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরের লোকসান ৪২১ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকা শ্রমিক আন্দোলন থেকে সৃষ্টি। আর প্রয়োজনের চেয়ে শ্রমিক বেশি নয়, বাস্তবে কারখানার উৎপাদনক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করা হয় না।

পাটশিল্পকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার জন্যই এই কৃত্রিম লোকসান

সম্প্রতি পাটমন্ত্রী মির্জা আজম যমুনা টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পাটকলগুলোর লোকসান কাটাতে জনগণের টাকা থেকে এভাবে বছর বছর ভর্তুকি দেয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রায়াত্ত¡ পাটকলগুলোকে পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ) অধীনে ছেড়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ সোজা কথায় বেসরকারীকরণ করা হবে। সরকার কি চায় তা পাট মন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই ভ্রান্ত নীতি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না দেওয়া, মাথাভারী প্রশাসন বৃদ্ধি, মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে পাটখাতে সংকট, লোকসান বাড়তে থাকে। এ লোকসান কমানোর জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২০০০ কোটি টাকা ঋণ দেয় এবং ঋণের শর্ত হিসেবে পাট খাত সংকোচন বা ডাউনসাইজিং করা শুরু হয়। এর ফলে লোকসান আরো বাড়তে থাকে। মাত্র ১২০০ কোটি টাকা লোকসানকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একের পর এক পাটকল বন্ধ করা হয়। দিনমজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে বেসরকারী পাটকল চালু হলেও পাটশিল্পের সংকোচননীতি চলতে থাকে। পাট শিল্পকে লাভজনক করার অনেক প্রতিশ্রæতি দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত ৫টি পাটকল চালু করে সরকার বাহবা নিলেও, পাটকলকে লাভজনক করতে কোন পদক্ষেপই তারা নেয়নি। সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘পাট দিবস’ পালন করছে, প্রধানমন্ত্রী ’পাটের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনা’র  ঘোষণা দিচ্ছেন অথচ একই সময়ে পাট শ্রমিকদের মাসের পর মাস মজুরি বকেয়া থাকছে। পাটমন্ত্রী বার বার অভিযোগ করছেন – অর্থ মন্ত্রণালয়  প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিচ্ছেনা। সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক হয়, অর্থমন্ত্রী কেন টাকা দেবেন না ? এ কি বাস্তব না বিশ্বাসযোগ্য ?

আমরা দেখছি, দুই মন্ত্রণালয়ের ঠোকাঠুকির নাটক যখন চলছে তখন মঞ্চের পাশেই অতীতের পাটশিল্প বিরোধী নীতির বাস্তবায়ন তো দ্রুতগতিতে চলছে। বাস্তবে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারার নীতি নিয়েছে। রাষ্ট্রয়াত্ত্ব পাটকলগুলোকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সেখানে ধীরে ধীরে ব্যক্তিমালিকানকে উৎসাহিত করা হবে। ইতিমধ্যে পাটখাতকে ‘পিপিপি’র আওতায় আনার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এতে ইতিমধ্যে গড়ে উঠা রাষ্ট্রয়াত্ত¡ পাটকলের অবকাঠামো ব্যবহার করা যাবে আবার গোটা পাটের বাজারটাই ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। চীনের একটি প্রতিষ্ঠান দেখাচ্ছে মাত্র ২৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেই রাষ্ট্রায়াত্ত¡ পাটকলের অধুনিকায়ন সম্ভব। কিন্তু সরকার সে বরাদ্ধ করছে না। যে দেশের অর্থমন্ত্রী  বেসিক ব্যাংকের অর্থলুটের ঘটনায় বলতে পারেন ৪৫০০ কোটি টাকা কোন ব্যাপার নয়, সে দেশের সরকার এ টাকা বরাদ্দ দিতে পারবেনা, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ এ মিলগুলোকে আধুনিকায়নের জন্য সরকার ২০১৬ সালে  চীনের রাষ্ট্রায়াত্ত¡ প্রতিষ্ঠান ‘সিটেক্স আইসি’র সাথে সমঝোতা চুক্তি করেছে। চীন সরকার এ অর্থ ২০ বছর মেয়াদী  ১.৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। এ ঋণের শর্তে আছে, মিলগুলো আধুনিকায়নের পর উৎপাদিত পণ্য চীনকে বিপণন ও রপ্তানির অধিকার দিতে হবে। (বণিক বার্তা-২৭ জুলাই,২০১৯)। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে যখন মিলগুলোর আধুনিকায়ন সম্ভব, সেখানে এধরণের কঠিন শর্তে কেন চীনের সাথে চুক্তি করা হলো,তার কোন উত্তর আছে কি? কিন্তু যেকোন রাজনীতি সচেতন মানুষই বুঝতে পারেন এর প্রকৃত কারণ কি?

পাটখাতে পিপিপির প্রস্তাবনা বেসরকারীকরণেরই চক্রান্ত, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান

উপরের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি,  পাটখাতের লোকসান কৃত্রিম। গত চার দশক ধরে চলে আসা পাট শিল্পবিরোধী নীতি ছেড়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী পাটনীতি প্রনয়ণ ও অনুসরণ, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতি-লুটপাট বন্ধ, পাটখাতকে লাভজনক করা সম্ভব। সে পথে না হেঁটে এখন লোকসানের সমাধান হিসেবে ১৪ টি পাটকলকে পিপিপি’র (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ) আওতায় ছেড়ে দেওয়া হবে বলে পাটমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ মিল, যন্ত্রপাতি থাকবে রাষ্ট্রের আর তাতে ব্যবসা করবে ব্যবসায়ীরা। যাকে এক কথায় বলা যায়, পাবলিকের পকেটের টাকায় প্রাইভেট কোম্পানির মালিকদের মুনাফা। ফলে পাটখাতকে লাভজনক করা এবং পাটখাতকে পিপিপির নামে বেসরকারীকরণের চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি সমস্বরে তোলা দরকার। রাষ্ট্রায়াত্ত¡ পাটকল শ্রমিকদের ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনকে আমরা বেগবান করার আহবান জানাই। পাশাপাশি আমরা পাটকল শ্রমিকদের আহবান জানাই, আন্দোলনকে শুধুমাত্র মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন বা পেশাগত দাবিতে গন্ডীবদ্ধ না রেখে পাটখাতকে লাভজনক করা এবং পাটখাতকে পিপিপির নামে বেসরকারীকরণের চক্রান্ত বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন জোরদার করুন। তাহলেই এ শিল্প তথা আপনাদের জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে।

সাম্যবাদ আগষ্ট ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments