পাঠক নয়, বইয়ের ভালো-মন্দ এখন বিচার করবে পুলিশ! কথাটা বিস্ময়কর হলেও সত্য। এবারের বইমেলা শুরুর সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের কমিশনার এমনটাই বলেছেন। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বই মেলায় তারা নজরদারি করবে। আসলে দেখবে কোনো বই ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত হানছে কিনা। লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তার জন্যই নাকি তারা এ কাজটি করছে।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসে, বইয়ের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা পুলিশকে কে দিয়েছে? পুলিশের কি এমন এখতিয়ার আছে নাকি থাকা উচিত? কোনো একটি বই যদি অশ্লীল হয়, মানুষের মানবিক অনুভূতিকে আঘাত করে, বইয়ে যদি সমাজবিরোধী উপাদান থাকে — তাহলে তা পাঠকসমাজ বর্জন করবে। প্রয়োজনে প্রতিবাদ করবে। লেখা দিয়ে লেখার প্রতিবাদ হবে। এভাবেই তো গণতান্ত্রিক মত ও পথের সৃষ্টি হয়। মানুষ বিষয়ের সঠিকতা-বেঠিকতা বুঝতে পারে, একটা যুক্তিবাদী মন তৈরি হয়। লেখক লেখেন, প্রকাশক তা বই আকারে প্রকাশ করেন, পাঠক পড়ে মতামত দেন। এটাই একটা গণতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু, এর কোনোটিই না হয়ে পুলিশের হাতে বই বিচারের ক্ষমতা দিলে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়?
বলা হচ্ছে নিরাপত্তার কথা। বাংলাদেশের আগেও কখনো ভিন্নচিন্তার লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। এগুলো কেবল কথার কথা। ২০০৪ সালে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদকে মেলা প্রাঙ্গণেই কোপানো হয়। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। আজও এর বিচার হয়নি। ২০১৫ সালের বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে মেলা প্রাঙ্গণেই খুন করা হয়, তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহন হন। ওই বছরের অক্টোবরে অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ও জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়। দীপনকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিনই অভিজিৎ রায়ের আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ২০১৫ সালে ইরানের নির্বাসিত লেখক আলী দস্তি রচিত ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটি বের করার অপরাধে ‘রোদেলা প্রকাশনী’র স্টল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এই সবগুলো ঘটনার সাথে দেশের উগ্রপন্থী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো জড়িত ছিল। তাদের ব্যাপারে পুলিশ কিন্তু কিছু করতে পারেনি। প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা করতে না পারলেও বারবার মৌলবাদী শক্তিগুলোর কথাতেই আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও ‘সতর্কভাবে’ লেখালেখির কথা বলেছেন।
এদেশে এখন ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ নামক বস্তুটি বড়ই চলতি। কথায় কথায় এই অনুভূতির কথা বলা হয়। এসব কথার পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার কথা বলা হলেও আসলে আড়ালে থাকে শাসকদের স্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারা। এমন অপতৎপরতা নতুন নয়। যে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে তারও ইতিহাস ঘাঁটলে এমন বিষয় পাওয়া যাবে। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভাজনের কৃত্রিম বাতাবরণ তৈরি করে ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তান হবার পর ‘মুসলিম স্বার্থের’ কথা বলে সবকিছুর ইসলামিকরণ শুরু হয়। এমনকি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিও বাদ থাকে না। সেদিন উর্দুকে বলা হয়েছিল মুসলমানের ভাষা আর বাংলা অভিধা পেয়েছিল ‘হিন্দু’ বা ‘বিধর্মী’দের ভাষা বলে। পূর্ববঙ্গের মানুষ শাসকের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিল। তাকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষার জন্য লড়াই করে সৃষ্টি করেছিল অনন্য এক ইতিহাস। সেই থেকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ আমাদের ভাষা দিবস আর তাকে স্মরণ করে প্রতিবছর মাসব্যাপী পালিত হয় বইমেলা। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে ধর্মনিরেপক্ষতারও লড়াই। বাঙালি জাতির এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আজ ভূলুণ্ঠিত করছে সরকার। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আঁতাত করে মানুষের মধ্যে বিভাজনের সেই পুরোনো অস্ত্র ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ কেই ব্যবহার করছে বারবার। মৌলবাদীরা দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিমনা মানুষদের মধ্যে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চায়, শাসকরা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে দিয়ে তাকেই আরও ত্বরান্বিত করছে।
কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতির কথা বললেও, শাসকদের আর অন্য কোনো অনুভূতি আহত হয় না। প্রতিদিন মানবিকতার কত শত অপমান হচ্ছে, নারী-শিশুরা ধর্ষিত-গণধর্ষিত হচ্ছে, না খেতে পেয়ে পথেই মানুষ মরছে, এক টুকরো কাপড়ের অভাবে শীতে কাঁপছে, খোলা আকাশের নীচে আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের আবাস — এগুলোর কোনোটিতেও শাসকের মানবিক অনুভূতি আহত হয় না। তাদের সব অনুভূতি এক জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে আছে।
আর লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তা দেবার কথাটাও তো বানোয়াট। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, ব্যাংকগুলো থেকে জনগণের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুর্নীতিবাজরা কিন্তু আইন শৃঙ্খলাবাহিনী জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। হত্যা-খুন পরিণত হয়েছে নৈমিত্তিক ব্যাপারে। ক্ষমতাবানদের দখলে দেশের নদী-নালা-খাল-বিল-জায়গা-সম্পত্তি। এসব ক্ষেত্রে অসহায় জনগণ রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাবাহিনীকে পাশে পায় না। সারাদেশের এমন পরিস্থিতিতে তারা লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তা দেবেন কতটুকু?
নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতায় যাবার জন্য শাসক দলগুলোর নানা হিসাব-নিকাশও চলছে। কয়েকদিন আগে হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হয়তো তাদের মধ্যে আগামী সময়ের নানা বিষয় নিয়ে কথাও হয়েছে। মাঝে মাঝেই তাদের মধ্যে এমন বৈঠক দেখলে বোঝা যায় কী দারুণ সখ্যতা। হেফাজতের প্রস্তাবনাতেই তো এ সরকার প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করেছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও কিছু করবে। এবারের বইমেলায় প্রকাশিতব্য প্রায় চার হাজার বই, সবমিলিয়ে লক্ষ লক্ষ বই-ম্যাগাজিন নিয়ে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কতটুকু নজরদারি করতে পারবে তা হয়তো অনিশ্চিত। কিন্তু, হেফাজতে ইসলামের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর প্রস্তাবনায় বিশেষ বিশেষ বইগুলো সম্পর্কে সরকারের যে সরব ভূমিকা থাকবে তা — বোধহয় বলাই যায়। এখন দেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দায়িত্ব — তারা এ ব্যাপারটিকে কীভাবে গ্রহণ করবে।