প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা বলে সরকার দায় এড়াতে পারে না
ঢাকা শহরে এই দৃশ্যগুলো খুব পরিচিত। সারি সারি ফ্লাইওভার, সুউচ্চ অট্টালিকা, কোটি টাকার বিলাসবহুল প্রাইভেট কার আর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে সরকারের উন্নয়নের খতিয়ান। একটা স্লোগানও যে কারও চোখে পড়বে – ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র-শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র।’ মন্ত্রী-এমপিদের মুখেও কেবল উন্নয়নের গল্প। তারা দলের লোক তাই হয়তো এমন বলতে পারেন। কিন্তু শুধু কি তারা? সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি, প্রশাসনিক আমলা-পুলিশ-বিচারপতি-নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমন অনেকে আছেন যারা সরকারের উন্নয়নের গুণগানে পঞ্চমুখ। উন্নয়নের এই প্রবল চিৎকারের পরও আরেকটা ছবি চোখ এড়ায় না। এটাও নিত্যদিনের ব্যাপার, সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগ করে। যেমন ঢাকা শহরে চলাচল করতে ২০ মিনিটের পথ হয়তো লেগে যাবে ২ ঘন্টা। এক প্রতিবেদন বলছে এ কারণে প্রতিদিন ৩২ লক্ষ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, মানুষের পায়ে হাঁটার গতি আর যান চলাচলের গতি এখন প্রায় সমান – ঘন্টায় ৭ কিলোমিটার! বেকারত্ব বাড়ছে তীব্রভাবে। সোনার হরিণ চাকুরির পিছনে ছ্টুছে লক্ষ লক্ষ অনার্স-মাস্টার্স পাশ করা তরুণতরুণী। আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই এমন মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৭১ লাখ। শ্রমশক্তির কী নিদারুণ অপচয়! পারিবারিক-ব্যক্তিগত জীবনে হতাশা-কলহ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য বলছে, প্রতি মিনিটে ১৩৮৯ পিস ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। জীবনের সকল কৌতূহল, সাধ-আহ্লাদ ভুলে গিয়ে তরুণতরুণীরা ডুবে যাচ্ছে নেশার নীল জগতে। দেশের সাধারণ মানুষের যখন এই অবস্থা তখন উন্নয়নটা হচ্ছে কার?
উন্নয়নের এই ধাক্কা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি লেগেছে রাজধানী ঢাকার বুকে। দেশের বড় বড় ধনীদের বাস এই শহরে; তাদের বিত্ত-বৈভবের প্রকাশ আকাশ ছোঁয়া। কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প এই ঢাকাকে ঘিরেই। এই শহরের এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে দিন-রাতের পার্থক্য বোঝা যাবে না; পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর মতোই উজ্জ্বলতা সেখানে। কিন্তু আরেকটি চিত্রও আছে। এই শহরটি গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে। পাশে ছিল আরও নদী- তুরাগ, বালু। ৫০ বছর আগের ঢাকাতেও ছিল জলাশয়, গাছপালা, বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ। আজ তার অবস্থা কী? বুড়িগঙ্গা নদী আজ বিষাক্ত। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়; দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। প্রতিনিয়ত এর আয়তন কমছে। চর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে দখলদাররা। এই শহরে একসময় অজস্র খেলার মাঠ ছিল। আজ তার বেশিরভাগগুলোতে উঠেছে সুউচ্চ দালানকোঠা, মার্কেট। ইট, পাথর আর কংক্রিটে ঢাকা এই শহরে এখন একখ- মাটি খুঁজে পাওয়া কঠিন। সারি সারি বাড়ি কিন্তু যাবার রাস্তা নেই। অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স ঢোকানোর অবস্থা নেই। পানি নিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভীষণ দুর্বল। যত্রতত্র ময়লা ফেলার স্থান। পানি যাবার জায়গা নেই বলে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে কোমর সমান পানির উচ্চতা। এর সাথে আরও বর্জ্য মিশে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানে সারাবছর মানুষ পানিবন্দী থাকে। মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন আর তা থেকে নির্গত ধোঁয়া, সিসা, বিষাক্ত গ্যাস নিঃশেষ হবার জায়গা নেই বলে ঢাকা এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বিষাক্ত বায়ুর শহর। এ সবই হয়েছে সরকারের তথাকথিত ‘উন্নয়ন’র বিষাক্ত ছোবলে। গত চার দশকে এমন উন্নয়নের ফলাফলে নদীনালা, খালবিল, বন জঙ্গল সবকিছু ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চলেছে। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা প্রত্যেকে এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। তাই পাহাড় থেকে পীরগঞ্জ সবক্ষেত্রেই প্রকৃতি এবং মানুষ সমানভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
গত কিছুদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মারা গেল ১১২ জন। এর আগেও এমন মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এবার ঘটলো ভয়াবহতম ঘটনা। ঘটবেই না বা কেন? প্রতিবছর পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ে দখলদারদের সহযোগিতায় অবৈধ বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। বন উজাড় করে, মাটি কেটে পাহাড়ে ‘উন্নয়ন’ চলছে বহুদিন ধরে। এবারের ঘটনা তারই প্রতিক্রিয়ায়। প্রকৃতি ধ্বংস হলে যে মানুষের অস্তিত্ব থাকে না, তা এ ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গে কয়েকটি জেলায় হলো ভয়াবহ বন্যা। বিশেষত ভাটি অঞ্চলের বন্যায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হলো। সহায়-সম্বল সব হারিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব-অসহায় মানুষগুলো কোথায় যাবে, কেউ জানে না। ঢাকা শহরে কিছুদিন আগে মহামারী আকারে দেখা দিলো ‘চিকনগুনিয়া’ একটি মশাবাহিত রোগ। অন্তত ২০ লাখ লোক মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে আজও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এর আগে ডেঙ্গু মহামারী আকার নিয়েছিল, এখন জন্ডিস হচ্ছে অনেকের। তার কিছুদিন আগে হলো তীব্র দাবদাহ। আগে শোনা যেত ভাদ্রমাসের গরমে কাঠাল-তাল পাকে। এখন গরমের পরিমাণ এমন যে মনে হয় মানুষও পেকে যাবে। হিটস্ট্রোকের যোগাড় অনেকের।
সাধারণ চোখে এই বিপর্যয়গুলো দেখলে মনে হবে এগুলো প্রাকৃতিক ঘটনা। সরকারও তাই বলে। প্রকৃতি নামের ‘নন্দ ঘোষ’র উপর নিজেদের দায় চাপায়। কিন্তু চাইলেই কি এই দায় থেকে মুক্ত হওয়া যায়? আমরা জানি, প্রকৃতিতে বিপর্যয় যেমন আছে তেমনি আছে তার প্রতিকারের ব্যবস্থাও। যেমন ঘূর্ণিঝড় গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি করে আবার ভাঙা গাছের ডাল থেকে নতুন চারার জন্ম হয়। যেটা আমরা সুন্দরবনে দেখলাম সিডর, আইলা হবার পর। নদী-নালা উপচে যেমন বন্যা হয়, বন্যায় জান-মালের ক্ষতি হয়; তেমনি বন্যার পানি বয়ে নিয়ে আসে পলিমাটি যাতে মাটি উর্বর হয়, ভালো ফসল হয়। মানুষ বহু সংগ্রাম থেকে, প্রকৃতির সাথে বহু অভিজ্ঞতায় এসব নিয়মকে আয়ত্ত করেছে; নিয়মকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কল্যাণে ব্যবহার করেছে। মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছে প্রকৃতিকে পদানত করলে সভ্যতার অস্তিত্বই থাকবে না। পশু-পাখি, জীব-জন্তু, গাছ-পালা, নদী-নালা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই প্রয়োজনীয়। একে ধ্বংস করে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না।
নদীর পানি সমুদ্রের দিকে গড়াবেই। মেঘ বৃষ্টি ঝরাবেই। এটাই প্রকৃতির কাজ। কিন্তু নদীর প্রবাহমানতার মাঝে যদি বাঁধ দেয়া হয়, তাহলে কী দাঁড়াবে? নদী যদি বিগড়ে যায়, তাহলে সেটা প্রকৃতির ঘাড়ে চাপানো যাবে? পাহাড় বিশেষ প্রাকৃতিক কারণে গড়ে ওঠে। মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। সেই পাহাড় কেটে, তার বুকে বেড়ে ওঠা গাছপালা যদি কেটে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি করা হয় তাহলে পাহাড় ধসকে কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যাবে? বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম দায়িত্ব পালন না করে যদি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার দায় নাগরিকদের উপর দেয়া হয় তাহলে কি তা সঠিক হবে? তাহলে যারা দেশ চালান, শহর চালান তাদের দায়িত্ব কী?
প্রকৃতি তার নিয়মে চলে। মানুষের উচিত সেই নিয়মকে অনুধাবন করে তার অনুপাতে কর্মকান্ডকে পরিচালিত করা। যেমন মেঘালয়ের পাহাড়ের ঢল আমাদের সুনামগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার নিচু ভূমি দিয়েই বয়ে যাবে। এটাই প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত ব্যাপার। আবার এই পানি স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার জন্য ভারতীয় সীমান্তের সাথে আমাদের ২০টিরও বেশি আন্তসীমান্ত নদী আছে। কিন্তু এসব নদী যদি সঠিক সময়ে ড্রেজিং না হয়, যদি ভরাট থাকে, যদি ভারত বা বাংলাদেশ সরকার এই পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে কোনো বাধা তৈরি করে তাহলে অনিবার্যভাবে বন্যা হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নদীশাসনের নামে নদীর নিয়মের বিরুদ্ধে যাবার কারণেই আজ এমন পরিণতি হচ্ছে। ফলে আজ আমাদের ভাটি অঞ্চলের যে বন্যা হচ্ছে তা প্রাকৃতিকভাবে যতটা না তার চেয়ে অনেক বেশি মনুষ্যসৃষ্ট। একইভাবে পাহাড় ধসে মারা যাবার ঘটনাও পাহাড়কে ঘিরে মুনাফার থেকেই তৈরি হয়েছে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এমন ঘটনাগুলো নতুন নয়। একইভাবে নতুন নয় এই বিপর্যয়কে হাতিয়ার করে লুটপাটের ঘটনাও। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে একদল লোকের পকেট ভারী হয়। কেননা জনগণকে উদ্ধারের কথা বলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা তছরুপ করা যায়। এবারও যেমন হাওর অঞ্চলের বিপর্যয়ের কথা বলে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের নামে এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ২০১২-২০৩২ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এর আগেও এমন কোটি কোটি টাকা হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের কথা বলে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলে বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু জনগণের টাকাগুলো লুটপাট ছাড়া যে আর কিছুই হয়নি তা এবারের বন্যা পরিস্থিতি দেখে খুব সহজেই বোঝা যায়।
দেশীয় লুটেরারা কেবল নয়, আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশের উপর আক্রমণ করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও। পাশের দেশ ভারত আমাদের নদীগুলোর উপর আগ্রাসন চালিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। ভারতের বাঁধের কারণে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে যেমন মরুকরণ চলছে তেমনি দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। উত্তরবঙ্গে পানির স্তর অনেক নীচে নেমে গেছে, তীব্র হচ্ছে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব। দক্ষিণবঙ্গে পানির লবণাক্ততার কারণে কৃষিব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যশোর-খুলনায় ভবদহ জলাবদ্ধতায় প্রতিবছর মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের পরও এখনও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। নতুন করে সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। ভারত এবং বাংলাদেশের পুঁজিপতিদের স্বার্থে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অনেকগুলো শিল্প কারখানা সুন্দরবনের চারপাশে গড়ে উঠছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়বে। একইসাথে সেখানকার নদী-কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দুর্গত হবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সুন্দরবন ধ্বংস হলে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় চারকোটি মানুষ সরাসরি আক্রান্ত হবে, একইসাথে আক্রান্ত হবে পুরো দেশ।
তাই একথাটি খুব সহজেই বলা যায়, প্রকৃতির বিপর্যয় ডেকে আনছে মানুষের বিপন্নতা। আর দুইয়ের বিপর্যয় তৈরি করছে মুনাফালোভী শাসকরা। শাসকদের লোভ আর লাভের বলি হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। একথা আজ স্পষ্টভাবে অনুধাবনের সময় এসেছে যে, প্রকৃতি, চারপাশের পরিবেশ আর মানুষের বেঁচে থাকা একসূত্রে গাঁথা। তাই নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রকৃতিবিনাশী যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। শাসকরা যাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে চিত্রিত করে তা যে তাদের নিজেদেরই সৃষ্টি তাও আজ পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে। একইভাবে প্রকৃতি এবং মানুষের নিদারুণ পরিস্থিতির জন্য যে মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা দায়ী, তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।