[dropcap]এ[/dropcap]কটা বিশেষ প্রয়োজন থেকেই, বিশেষ পরিস্থিতিতে পার্টি পরিচালনা করার যে প্রয়োজন, সেই প্রয়োজন থেকেই আমরা এ কনভেনশনে মিলিত হয়েছি। সেই ইতিহাস আপনারা জানেন। জাসদের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত বিতর্কের এক পর্যায়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে ১৯৮০ সালে আমাদের পার্টি গড়ে উঠেছিল। গত আগস্ট ২০১২ থেকে একটা বিতর্ক শুরু হল। দলের একদল নেতা বলতে চাইলেন, আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠিনি। তরা বলতে চাইলেন, মার্কসবাদী জ্ঞানভাণ্ডারে কমরেড শিবদাস ঘোষের কোনো মৌলিক অবদান নেই, বিপ্লবী দল গড়ে তোলার নীতিগত-পদ্ধতিগত সংগ্রাম এবং বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সংকটগুলোকে বিচার করার যে শিক্ষা কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের সামনে রেখে গেছেন সেগুলো মৌলিক কোনো শিক্ষা নয়। দলের কমরেডদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল যে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার যারা বিরোধিতা করছে তারা আসলে কমিউনিস্ট আদর্শ থেকে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকেই সরে দাঁড়াতে চাইছে। সেজন্য কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা নিয়ে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের নেতাদের একাংশের এই আদর্শগত বিচ্যুতির বিরদ্ধে, শোধনবাদী-সংস্কারবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে আমাদের কমরেডরা তীব্র সংগ্রাম চালিয়ে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এমনকি দলের দূরবর্তী কমরেডরা, নানা কারণে যারা দলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকতে পারেন নি, তারাও সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন এই সংগ্রামে। তারই পরিণতি হচ্ছে আজকের কনভেনশন।
সংগ্রামী বন্ধুগণ, বিশাল গ্রামাঞ্চল নিয়ে হচ্ছে আমাদের দেশ। আর গ্রামের ৭৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাদের জীবনের কি অবস্থা? দেশের সাড়ে ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তিন কোটি পৌণে তিন কোটি মানুষ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৩০/১৩৫ দিন তাদের কাজ থাকে। বাকি ২৩০ দিন তাদের কাজ থাকে না। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪০ বছরে একে একে টেক্সটাইল, জুট ইত্যাদি সব পুরনো শ্রম-নির্ভর দেশীয় কাঁচামাল-নির্ভর শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই হয়েছে। আর অন্যদিকে শিল্প বলতে কেবল গড়ে উঠেছে অনিশ্চিত বিদেশি বাজার ও কাঁচামাল-নির্ভর সস্তা শ্রম-শোষণের গার্মেন্টস কারখানা।
গার্মেন্টগুলোতে বাস্তবে চলছে মজুরি দাসত্ব। গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মতো মজুরিটুকুও দেয়া হয় না। সামান্য মজুরি, সেটাও ঠিক মতো দেয়া হয় না। অথচ প্রতিদিন ঘর ভাড়া বাড়ছে, চালের দাম বাড়ছে, তেলের দাম বাড়ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। কেরোসিনের দাম বাড়ানো হচ্ছে। শ্রমিক পাওনা মজুরি চাইলে মালিকের ভাড়াটিয়া গুন্ডাবাহিনী এসে হামলা করছে, পুলিশ এসে হামলা করছে। এখন আরো একটা গুন্ডাবাহিনী বানানো হয়েছে, নাম দেয়া হয়েছে শিল্প-পুলিশ। এই শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ভবন ধসে মরছে – তার বিচার হয় না, দায়ী মালিকদের শাস্তি হয় না।
কৃষিজীবী, চাষীদের কি অবস্থা? সারের দাম, কীটনাশকের দাম, ডিজেলের নাম প্রতি বছর দু’দফা-তিনদফা করে বাড়ছে। বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে চাষীরা, চাষী বউরা যে বীজ সংরক্ষণ করেছে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ব্যবহার করেছে – এখন আর সে বীজ আমরা ব্যবহার করতে পারব না। চাষীদের হাত থেকে বীজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন মনসান্টো ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানি বীজ-ব্যবসায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। ওদের বীজ ব্যবহার করলে ওদের সার, ওদের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। তা না করলে ফলন হবে না। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, এক কেজি ধানের দাম ১ টাকা হলে এক কেজি বীজ ধানের দাম হতো দেড় টাকা। এখন এক কেজি ধানের দাম যখন ২৫ টাকা বিক্রি করছে তখন সে এক কেজি বীজ ৩০০/৪০০ টাকায় কিনছে। সবজির বীজের দাম হাজার টাকা। কেন এত দাম তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই সব কারণে চাষীর উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। অথচ সে ফসলের দাম পায় না। উৎপাদন খরচ যোগাড় করতে গিয়ে চাষী ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকে ঋণ নেই, মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। গ্রামে চাষীদের লুট করে একদল গ্রামীণ ধনিকশ্রেণী গড়ে উঠেছে। একটা সুদজীবী চক্র গড়ে উঠেছে। এক মাসে ১০০ টাকার সুদ ২০ টাকা। হিসাব করুন এক বছরে ১০০ টাকার সুদ কত হয়। চাষী এভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে, জমি হারাচ্ছে, ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। গ্রাম থেকে উদ্বাস্তুর দল শহরে এসে ভিড় জমাচ্ছে।গ্রাম থেকে শহরে এসে এই গরিব মানুষ কোনো কাজ পায় না। সে রিকশা চালায়, ভিক্ষা করে, ফুটপাতে দোকানদারি করে, হকারি করে। সেখানেও সে মাস্তান-পুলিশের হামলার শিকার হয়। সে চুরি করে, মাস্তানদের চ্যালা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আর একদল মেয়ে সামান্য টাকা রোজগারের জন্যে মানুষরূপী পশুদের উদগ্র লালসার শিকার হয়, দেহ বিক্রি করে। এই তো হচ্ছে আমাদের দেশ।
এ অবস্থা থেকে আমরা সকলে পরিত্রাণ চাইছি। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষ, পাহাড়-সমতলের নিপীড়িত-শোষিত জনগোষ্ঠী, নারী-পুরুষ সবাই মিলে গণআন্দোলন গড়ে তুলেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সে জন্য বামপন্থী বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে সর্বনিম্ন কর্মসূচি, সর্বোচ্চ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গণআন্দোলন গড়ে তুলি। এ কনভেনশন থেকে আমরা ধীরে ধীরে সে দিকে এগিয়ে যাব। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
দুনিয়ার মজদুর এক হও!