Wednesday, November 20, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধপুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ নয়, পুঁজিবাদের বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্র - সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ নয়, পুঁজিবাদের বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্র – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

Shirajul

প্রীতিভাজন সভাপতি ও উপস্থিত বন্ধুগণ,

আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের এই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

আজকে যখন এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে ভালো নেই এটা আমরা সবাই জানি। পরিস্থিতি কখনই ভালো ছিল না। তবে আমরা দীর্ঘকাল চেষ্টা করেছি, সংগ্রাম করেছি এই পরিস্থিতি বদলাবার জন্য, কিন্তু বদলাতে পারিনি। সংগ্রাম চলেছে, আত্মত্যাগ ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থাটা বদলায়নি এবং সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ সত্ত্বেও ব্যবস্থাটা বদলায়নি বলেই এই ব্যবস্থাকে আরো খারাপ মনে হচ্ছে। তাছাড়া ব্যবস্থা যে ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে সেই বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।

আজকে আমাদের এই দেশে কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। ব্যাংকে টাকা থাকলে সেটা লোপাট হয়ে যাচ্ছে, দেশী দুর্বৃত্তরা লোপাট করছে, বিদেশি দুর্বৃত্তরা লোপাট করছে, স্থানীয়দের সাথে যোগসাজশে। যে টাকা বাইরে থেকে আমাদের মেহনতি ভাই ও বোনেরা পাঠাচ্ছেন সেই টাকা এইভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে, যে টাকা গার্মেন্টস-এর শ্রমিকরা উপার্জন করছেন সেই টাকাও ওই একইভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে। এবং যেটা খুব পরিষ্কার সত্য এবং যে সত্যের মধ্য দিয়ে এই বাস্তবতা, আজকের এই বাস্তবতা, উন্মোচিত হয়ে যায় সেটা হলো মেয়েদের অবস্থা। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এখানে ছাত্রী ছিলো মাত্র একজন, আজকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা হয়েছে সতের হাজারেরও বেশি, কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়েনি। এবং নিরাপত্তার অবস্থা মেয়েদের জন্য যে কতটা খারাপ সেটা অতি সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, যে নির্মম ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড ঘটেছে, সোহাগী জাহান তনু যেভাবে নিহত হয়েছে সেইটাই তা উন্মোচিত করেছে। তনু একজন কিশোরী, সে ধর্ষিত ও নিহত হলো বাংলাদেশের সবচাইতে সুরক্ষিত যে এলাকা সেখানে এবং আমরা দেখলাম যে সেই হত্যাকা- ধামাচাপা দেয়া হত যদি না তার সহপাঠীরা প্রতিবাদ করতো, এবং যদি না সারা বাংলাদেশ জুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতো। সঠিক তদন্ত হচ্ছে না, অপরাধীরা চিহ্নিত হচ্ছে না। এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বিচারটা। এটা প্রতীকের মতো ঘটনা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি অসংখ্য ঘটনার একটি এবং এ ঘটনা বাস্তব সত্যকে উন্মোচিত করে দেয়। আমরা ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের তদন্তের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী তৎপরতা দেখেছি। আমরা দেখেছি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ড। কতদিন চলে গেলো। মাসের পর মাস চলে গেলো। বলা হয়েছিলো ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উন্মোচিত হবে। ৪৮ ঘণ্টা, ৪৮ দিন, ৪৮ মাস চলে গেছে। কিন্তু রহস্য উন্মোচিত হয়নি; অপরাধীরা চিহ্নিত হয়নি। বিচার তো দূরের কথা। বিচার হয়নি এই জন্য যে ঐ দাবিটা প্রবলভাবে তোলা যায়নি। বিচার ব্যবস্থা একটা স্বাধীন স্বাভাবিক ব্যবস্থা হওয়ার কথা, কিন্তু বিচারের জন্য এখানে দাবি করতে হয়, প্রবলভাবে দাবি না করলে বিচার হয়না। সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। সাংবাদিকদের সেই অনৈক্যের কারণে সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ঘটনার পিছনের ঘটনা উন্মোচিত হয়নি, অপরাধীরা শাস্তি পায়নি। আজকে এই যে তনু হত্যাকান্ডের বিচার হবে বলে আমরা আশা করছি তার একটা মাত্র কারণ আছে, একটাই মাত্র ভরসা আছে, সেটা হলো সারাদেশ জুড়ে ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। এই বিক্ষোভটাই হচ্ছে ভরসা এবং এর উপরই ভরসা করে আমরা আছি, টিকে আছি এবং আমরা ভাবছি যে, আমাদের সুদিন আসবে।

আমাদের দেশে যে ব্যবস্থা বিদ্যমান সেই ব্যবস্থাটাকে চিহ্নিত করবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে একে পুঁজিবাদী নাম দেওয়া। এক সময়ে পুঁজিবাদের কিছু কিছু ভালো দিক ছিলো। সেই দিকগুলো আমাদের দেশে আমরা দেখি না। পুঁজিবাদ উৎপাদন বৃদ্ধি করে, পুঁজিবাদ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, পুঁজিবাদ মত প্রকাশের এক প্রকারের স্বাধীনতা দেয়। আমাদের দেশে সেই গুণগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি সেটা হলো পুঁজিবাদের সবচাইতে নিকৃষ্ট দিকগুলোই। আমার দেখতে পাচ্ছি বিচ্ছিন্নতা, আমরা দেখতে পাচ্ছি ভোগবাদিতা, আমরা দেখতে পাচ্ছি নিপীড়ন। আর এই যে বিচ্ছিন্নতার বিষয় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ’৭১ সালে ওই যে হানাদাররা গণহত্যা করেছে আমাদের দেশে, তারা আশা করেছিলো যে আক্রান্ত মানুষগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। প্রত্যেকে নিজের কথা ভাববে, নিজের স্বার্থ দেখবে, নিজের জান বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করবে। আমরা যে তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছি সেটার কারণ হচ্ছে একটাই। কারণ হলো আমরা বিচ্ছিন্ন হইনি, আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। এই ঐক্যই ছিল সেদিন শক্তি ।

cover onnushilon copyবিচ্ছিন্নতার বিষয়টিকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব এক জিনিস নয়। উদাহরণ দিলে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবো। সাহিত্যে দুটো খুব বিখ্যাত চরিত্র আছে। দু’জনেই তরুণ। আপনাদের মতো। একজনের নাম রবিনসন ক্রুসো আর একজনের নাম হ্যামলেট। আমরা দেখি যে রবিনসন ক্রুসো অল্প বয়সে একটা নির্জন দ্বীপে সাঁতরিয়ে গিয়ে উঠেছিলো। তার জাহাজ ডুবে গেছে, সাঁতরিয়ে একাকী সেই নির্জন দ্বীপে এই তরুণ এসে উঠেছে। একাকী অবশ্যই, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। রবিনসন ক্রুসোর হাতের কাছে কিছু হাতিয়ার ছিলো যা ভগ্ন জাহাজটি থেকে সে উদ্ধার করে আনতে পেরেছে। সেগুলো উৎপাদনের কাজে লেগেছে। সে চাষবাস করেছে, মাছ ধরেছে, সে ছাগল পুষেছে, সে প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করেছে, সে গাছের ফল সংগ্রহ করেছে। সে একটা তোতা পাখি সংগ্রহ করেছে। একজন মানুষকেও পেয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। তার একাকীত্ব ছিল, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা ছিল না। এবং এই তরুণ তার বিচ্ছিন্নতা দূর করবার আরেকটি উপায় খুঁজে ছিলো, সেটা হলো বাইবেল পড়া। এই যে মানুষ ধর্মের দিকে ঝোঁকে তার মূল কারণ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। মানুষ যখন চারদিকে কোনো আশা দেখেনা, কেবল বিপদ দেখে, কেবলি শত্রু দেখতে পায় অন্যকিছু না দেখে, তখন সে ধর্মের কাছে আশ্রয় খোঁজে। রবিনসন ক্রুসোর ক্ষেত্রেও সেইটা ঘটেছিল। রবিনসন ক্রুসো চতুর্দিকে অন্ধকার দেখেছে, নিঃসঙ্গ নির্জন দ্বীপ, কিন্তু সেখানে বাইবেল পড়ে সে সান্ত¡না পেয়েছে এবং নিজের বিচ্ছিন্নতা কিছুটা দূর করতে পেরেছে।

আমরা এর বিপরীতে আর একটি চরিত্র দেখি। অত্যন্ত পরিচিত চরিত্র, শেকস্পীয়ারের হ্যামলেট। হ্যামলেট কিন্তু একাকী ছিলো না। হ্যামলেট ছাত্র, হ্যামলেট তখনকার দিনের জার্মানিতে সবচাইতে বিখ্যাত যে বিশ্ববিদ্যালয় উইটেনবার্গ, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হ্যামলেট দর্শনের ছাত্র। হ্যামলেটের বন্ধু আছে, হ্যামলেট নাটক লিখতে পারে, অভিনয় করতে পারে, তলোয়ার চালাতে পারে। তার আছে উদ্ভাবনী শক্তি। মেধাতে হ্যামলেট তার ওই রাজ্যে, ডেনমার্কের ওই রাজ্যে, সবচাইতে উচ্চ পর্যায়ের মানুষ। কিন্তু হ্যামলেট দেখছে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এই যে ভিড় চতুর্দিকে তার, মানুষ আছে, অনেক মানুষ, রাজপুত্র সে, সবাই তার সমর্থক, কিন্তু সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার পিতা মারা গেছে, রটিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে পিতাকে সাপে কামড়েছে। তার পিতা মারা যাওয়ার পরে তার চাচা রাজা হয়েছে এবং তার মা, হ্যামলেটের মা, নতুন রাজাকে বিয়ে করেছে। এই সব ঘটনা হ্যামলেটকে বিচলিত করছিলো। এর মধ্যে হ্যামলেটের বাবার প্রেতাত্মা এসে দেখা দিলো, এবং বললো যে আমি খুব কঠিন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি, তুমি যদি এর প্রতিশোধ না নেও তাহলে আমার এই দুর্ভোগ, এই যন্ত্রণা দূর হবেনা। ঘটনা কি? প্রেতাত্মা বললো সাপে কাটেনি আমাকে। আমাকে ওই যে দুর্বৃত্ত, তোমার পিতৃব্য, তোমার চাচা, সে-ই হত্যা করেছে। আমার কানের ভেতর বিষ ঢেলে দিয়েছিলো। বাগানে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। এটার তুমি প্রতিশোধ নেবে। এবং বলল কিন্তু তুমি তোমার মাকে যন্ত্রণা দেবেনা। হ্যামলেট তার মাকে ভালোবাসে, পিতাকে ভালোবাসে এবং সে দেখতে পাচ্ছে যে, একটি দুর্বৃত্ত তার পিতাকে হত্যা করেছে, তার মাকে বিয়ে করেছে এবং মায়ের বিয়ে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেননা সে মনে করে তার মায়ের সাথে তার চাচার সম্পর্কটা হওয়া উচিত ছিলো আপন ভাই-বোনের সম্পর্ক। ভাই-বোনের জায়গাতে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর, সেটা অত্যন্ত অপবিত্র একটা সম্পর্ক। হ্যামলেট তাই প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু কি করে প্রতিশোধ নেবে? সে তো একা হয়ে যাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে যে, যদি রাজাকে সে হত্যা করে তাহলে একটা রাজা গেলো ঠিকই, কিন্তু অন্যায় তো দূর হলো না। সে দেখতে পাচ্ছে যে, সমস্ত দেশ জুড়ে যা ঘটছে সেটা হচ্ছে, সময় দু-টুকরো হয়ে গেছে এবং এই দু-টুকরো সময়কে একত্রিত করার দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছে, যে রাজা সে দুর্বৃত্ত, যে মা সে তার শত্রু। মা ওই দুর্বৃত্তকেই বিয়ে করেছে। হ্যামলেট দেখতে পাচ্ছে যে, যে-মেয়েটিকে সে বিয়ে করবেÑ ওফিলিয়াÑ সে দুর্বলচিত্তের, এবং ওফিলিয়ার পিতা নিজের কন্যাকে ব্যবহার করছে হ্যামলেটের উপরে গুপ্তচর বৃত্তির জন্য এবং সে দেখতে পাচ্ছে তার অতি আপন দুইজন স্কুলের বন্ধু, তারা তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, তারা চর হয়েছে রাজার। সে তো লড়ছে ন্যায়ের জন্য, কিন্তু একাকী লড়ছে এবং তার কোনো সঙ্গী নেই। হতাশ হয়ে সে একবার ভাবলো আত্মহত্যা করবে। কিন্তু দেখলো যে আত্মহত্যা করেও তো মুক্ত হবে না। যদি এমন হয় যে মরার পরে দুঃস্বপ্ন হিসেবে এই বাস্তব জগত তাকে তাড়া করে? তাহলে কি হবে? একবার সে সুযোগ পেয়েছিলো রাজাকে হত্যা করার। রাজা প্রার্থনা করছিলো। কিন্তু সে হত্যা করলো না। হত্যা করলো না এইজন্য যে, প্রার্থনারত অবস্থায় রাজাকে হত্যা করলে রাজা হয়তো স্বর্গে চলে যাবে। ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ চলছে। হ্যামলেট দেখতে পাচ্ছে সে একাকী ন্যায়ের পক্ষে লড়ছে। কেউ তার সাথে নেই। সকলেই তার বিরুদ্ধে। এবং ঘটনাক্রমে সে আবার একজনের পিতৃহন্তা হয়ে পড়লো। যে ওফেলিয়াকে তার বিয়ে করার কথা, সেই ওফেলিয়ার পিতাকে সে হত্যা করে ফেললো। বিচ্ছিন্নতার চরম একটা দৃষ্টান্ত আমরা দেখলাম। এই তরুণ অভ্যুত্থান ঘটাতে পারতো। কিন্তু সে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারেনি। সে একা, নিজের কথা ভেবেছে, সে সব দায়িত্ব একা নিলো এবং শেষ পর্যন্ত সে মারা গেলো। এখানে যে সত্যটা উন্মেচিত হলো সেটা হলো এই যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন মানুষ যদি একাকী লড়াই করে তাহলে সে জয়ী হবে না। তাকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। হ্যামলেট ওই কাজটা করতে পারেনি।

আমরা যে ব্যবস্থার মধ্যে আছি সেটা হ্যামলেটের ডেনমার্কের মতোই অন্যায় ব্যবস্থা। এখানে ন্যায় পর্যুদস্ত হচ্ছে। সুবিচার নেই। শোষণ-নিপীড়ন চলছে। এখানে আজ কোনো প্রকার নিরাপত্তা নেই। আমরা যদি এই ব্যবস্থাটাকে বদলাতে চাই তাহলে একা কেউ পারবো না। সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং সেইখানে সংগঠনের প্রয়োজন। আমরা আন্দোলন দেখেছি, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের সংগঠিত সুষ্ঠু আন্দোলন। ধারাবাহিক আন্দোলন। আমরা মুক্তির যে স¦প্নের কথা ভেবেছিলাম সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা পুরাতন ব্যবস্থাটাকে বদলাইনি। আমরা রাষ্ট্র বদলিয়েছি। একবার ৪৭-এ রাষ্ট্র বদলালাম, দেশভাগ করলাম, একবার ৭১-এ রাষ্ট্র ভাঙ্গলাম, পাকিস্তান রাষ্ট্রকে দু-টুকরো করে বেরিয়ে এলাম। রাষ্ট্র ছোট হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র বদল হলো না। মানুষের মুক্তি এলো না। তার কারণ হচ্ছে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলো না। সমাজ মানে অনেকগুলো সামাজিক সম্পর্ক, সেই সম্পর্কগুলো বদলালো না। সম্পর্ক রয়ে গেলো প্রভু এবং ভৃত্যের, সম্পর্ক রয়ে গেলো ধনী এবং দরিদ্রের; এবং এই ভৃত্য ও দরিদ্র এখন নিপীড়িত হচ্ছে।

এই যে তনু মেয়েটি, সে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন কিশোরী। তার বাবা স্কুলের সামান্য কর্মচারী। মেয়েটি দু’টো বাড়ীতে পড়ায়। গৃহশিক্ষকতা করে খরচ মেটায়। কিন্তু তার অপরাধ হচ্ছে সে সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত। সে চোখে পড়ে। সেজন্য তনু হিজাব পরতো, কিন্তু হিজাব তাকে বাঁচাতে পারেনি। এই যে বিপদের মধ্যে আছে সকল তনু এই বাংলাদেশে, সমস্ত মানুষই বিপদের মধ্যে আছে, তার মানে সমাজ বদলায়নি।

৪৫ বছরে যে উন্নতি হয়েছে সে উন্নতি পুঁজিবাদী উন্নতি, সেই উন্নতি কয়েকজনের উন্নতি, বাকি মানুষকে বঞ্চিত করে। এই উন্নতি পাহাড়ের মতো, এই উন্নতি নদীর মতো নয়। আমরা নদীর মতো উন্নতি চাই, যে উন্নতি সর্বত্র প্রবহমান হবে। এবং যে উন্নতি সকল মানুষের জীবনকে স্পর্শ করবে। ভূমিকে উর্বর করবে, প্রকৃতিকে বাঁচাবে। সেই উন্নতি বাংলাদেশে কিছুতেই আসবে না, যদি না আমরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারি। সমাজে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সব পরিবর্তনই পুঁজিবাদী পরিবর্তন।

আমি এখানে রবীন্দ্রনাথের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলবো। সেই অভিজ্ঞতা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চীন দেশে গিয়েছিলেন, চীন তখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ নানান দেশে গেছেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বহু দেশ তাঁকে আহ্বান করেছে, নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। যেখানেই তিনি গিয়েছেন প্রাচ্যের মাহাত্ম্যের কথা বলেছেন, তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। জাপানে গিয়ে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তিনি বলেছেন যুদ্ধের সময়, ১৯১৬ সালে। আমেরিকায় গিয়েও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেই বলেছেন, ওই সময়েই। স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ হয়েছে, বিরূপ মন্তব্য গিয়েছে, কিন্তু সবমিলিয়ে তাঁকে উপেক্ষাই করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, পরাধীন দেশের একটা লোক, এর বলা না-বলার কি দাম আছে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন চীনে গেলেন ১৯২৪ সালে তখন দেখলেন তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। কারণ কি? কারণ চীনের তরুণরা, ছাত্ররা জেগে উঠেছে এবং সেই ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতে চায়। রবীন্দ্রনাথের লেখা তারা পড়েছে, ইংরেজিতে পড়েছে, চীনা ভাষায় অনুবাদ করে পড়েছে, তারা বুঝতে চায় যে তাঁর বাণীটা কি। সেই তরুণদের ভেতর তখন বিপ্লবী চেতনা দেখা দিয়েছে, তরুণরা তখন সংগঠিত হচ্ছে, তারা পত্রিকা বের করছে, সভা-সমিতি করছে, সংগঠন করছে, সাহিত্যচর্চা করছে, সংস্কৃতির চর্চা করছে। ১৯২১ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়ে গেছে। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গেছেন। ওই তরুণদের মধ্যে তরুণ মাও সেতুংও ছিলেন। তারা রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য শুনেছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, ভাববাদ জিনিসটা খারাপ, কেননা ভাববাদ চরমপন্থী এবং সঙ্কীর্ণ। বলেছেন বস্তুবাদ জিনিসটাও খারাপ, বস্তুবাদ জিনিসটাও সঙ্কীর্ণ। এই তরুণরা বলছে, তারা বিপ্লবের পক্ষে কথা শুনতে আগ্রহী। তরুণরা রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা-সভাতেই প্রচারপত্র বিলি করেছে, তারা বলেছে, আমরা ভাববাদবিরোধী। আমরা দেখেছি ভাববাদী কনফুসিয়াস আমাদেরকে কত পিছিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমরা তো এগুতে চাই, আমরা আত্মা চাই, কিন্তু আত্মার আগেই আমরা চাই বস্তু। সেজন্য তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, আমরা আপনার যে প্রাচ্যবাদ এটাকে বিশ্বাস করিনা, এই যে ভাববাদ একে বিশ্বাস করিনা। কেননা আমরা বস্তুবাদী, আমরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদে বিশ্বাস করি। রবীন্দ্রনাথ এই রকম প্রতিরোধ কখনো দেখেননি, এই রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া কখনো তাঁকে সহ্য করতে হয়নি। সংগঠিত তরুণদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথ বললেন যে, আমি কবি, আমি কোনো দর্শন প্রচার করতে আসিনি। তরুণরা বলল, কবিতা তো দর্শন ছাড়া হয় না। আপনার দর্শনটা হচ্ছে প্রগতিবিরোধী। আমরা তো ওই পথে যাবো না। সেইজন্য তারা প্রচারপত্র বিলি করেছে। শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত সবগুলো বক্তৃতা দেননি। পিকিং-এ সাতটা বক্তৃতা দেবার কথা ছিলো, দু’টো বক্তৃতা দিয়ে আর দেননি। তার পরে যখন বিদায় নিচ্ছেন তখন এক সভাতে তরুণরা আওয়াজ তুলছে, আপনি ফিরে যান, আপনার বাণী আমাদের দরকার নেই। আত্মায় আমাদের দরকার নেই। আমাদের বস্তু দরকার। আমরা বস্তুবাদী, দার্শনিক অর্থে বস্তুবাদী। রবীন্দ্রনাথ যেটা দেখে এলেন, যে অভিজ্ঞতা তিনি নিয়ে এলেন, সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে একটা উত্থানের। এবং এই উত্থানের নায়ক হচ্ছে তরুণরা। এই তরুণেরাই বিপ্লব সম্পন্ন করেছে ১৯৪৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ যাওয়ার ২৫ বছর পরে চীনে বিপ্লব হয়েছে। এবং সে বিপ্লবে এই তরুণরাই অগ্রনায়ক ছিলো।

এখানেও যে সত্যটা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে এই যে, সংঘবদ্ধ চেষ্টা, জ্ঞানের অন্বেষণ, বির্তক এবং কোনো কিছুকেই তর্ক না করে মেনে নিতে অসম্মতি, আত্মসমর্পণ না-করা, এগুলো হচ্ছে গুণ। বিপ্লব এমনি এমনি ঘটে না, বিপ্লব মুখের কথা নয়। শুচিকর্ম বা টি-পার্টি নয়। বিপ্লব হচ্ছে সংগঠিত চেষ্টা এবং বিপ্লব হচ্ছে ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সেজন্য জ্ঞানের অনুশীলন দরকার, জ্ঞানের প্রয়োগ আবশ্যক। সারা পৃথিবী থেকে আমি জ্ঞান নেব, কিন্তু তা বিশ্লেষণ করব এবং আমি বুঝবো যে আমার ব্যাধিটা কোথায়। ওই তরুণরা কি চায় রবীন্দ্রনাথ বুঝেছেন, তিনি চলে এসেছেন, কিন্তু বুঝেছেন যে এখানে একদিন বিপ্লব হবে। এখানে একটা মহাজাগরণ ঘটবে। সে জাগরণ ঘটলো পরবর্তীতে।

কাজেই যে কথাটা আমাদের জন্য খুব বেশি করে মনে রাখা প্রয়োজন সেটা হলো এই যে দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে, যদি না আমরা পতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। আমরা একাকী এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবো না। একাকী এর বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে সে বিচ্ছিন্ন হতে থাকবে। সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সংগঠিত আন্দোলন হয় তাহলে যেমন করে ওই যে আমরা অতো বড় পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৫,০০০ হাজার সদস্যকে আমাদের এখানে আত্মসমর্পণ করালাম তেমন ঘটনা ঘটাতে পারবো। ওরা সশস্ত্র ছিলো, ওদের বিদেশি সমর্থন ছিলো, টাকা-পয়সা ছিলো। দেশে তাদের সমর্থক রাজাকার-আলবদর ছিলো। কিন্তু তারা পরাজিত হয়েছে যে শক্তির কাছে সেটা হচ্ছে ঐক্যের। এই শক্তিতে কৃষক এসেছিলো। আমরা যেন এই ভুলটা না করি, এইটা যেন আমরা বুঝতে ব্যর্থ না হই যে, আমাদের দেশে যে বিপ্লব হয়নি তার একটা কারণ আমরা মধ্যবিত্তরা কৃষকের কাছে যেতে পারিনি। চীনে যে বিপ্লব হলো তার কারণ কৃষকের জাগরণ ঘটেছে। মুক্তির লড়াইটা কৃষকের লড়াই ছিলো। আমাদের ৭১-এর যুদ্ধে যারা লড়াই করেছে তারা অধিকাংশই কৃষক এবং কৃষকের সন্তান। যে নারী লাঞ্ছিত হয়েছে সে কৃষকের কন্যা, সে কৃষকের বোন, সে কৃষকের স্ত্রী। যে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ দানের কথা বলি তার অধিকাংশই কৃষক।

তো আমরা যে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন করেছি তাতে কৃষককে সঙ্গে নিতে পারিনি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একই সময়ে গঠিত হলেও চীন বিপ্লব করলো, ভারত করতে পারলো না। তার কারণ হচ্ছে চীন কৃষকের কাছে গেছে, কৃষককে সংগঠিত করেছে এবং সেই কৃষকরাই বিদ্রোহ করেছে। সেই বিদ্রোহই চীনকে নতুন জায়গায় নিয়ে গেছে। ভিয়েতনামেও একই ঘটনা। আমেরিকা পরাজিত হলো। কার কাছে? না কৃষকদের নিয়ে গঠিত বাহিনীর কাছে। কিন্তু আজকে চীনের কি অবস্থা? আজকে চীন পুঁজিবাদী এবং ওই চীন, যে-চীন একদিন পৃথিবীকে মুক্ত করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল, নিজের দেশকে মুক্ত করেছিলো, সেই চীন পুঁজিবাদী হয়ে এখন ক্রমাগত অধঃগতি হচ্ছে। সেখানে বেকারত্ব  দেখা দিচ্ছে, সেখানে দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে, সেখানে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, সেখানে নদী দূষিত হচ্ছে। পুঁজিবাদের যত যত বালামুসিবত আছে সব চীনে এখন দেখা দিচ্ছে।

শিক্ষাটা হচ্ছে এই যে, পুঁজিবাদের পথে মুক্তি নেই এবং মুক্তির লড়াইটা হচ্ছে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। সেজন্য যাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, তাঁদের অবস্থান হওয়া চাই খুব পরিষ্কার। পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ নয়, পুঁজিবাদের বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্র। এবং এই সমাজতন্ত্রের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম একটা সংগঠিত, একটা সুসংগঠিত ধারাবাহিক সংগ্রাম। এতে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে। আন্দোলনের জন্য স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বড় গুণ, কিন্তু ওই গুণ পর্যাপ্ত নয়। আন্দোলনকে সংগঠিত হতে হবে।

সেই জন্যই আজকে যে সম্মেলনের মধ্যে আপনারা তরুণেরা একত্রিত হয়েছেন এবং আপনারা যে সংগঠিত হতে চেষ্টা করছেন সেটাকে আমরা অভিনন্দন জানাবো। আমরা আশা করবো যে, আপনাদের এই সংগঠন শক্তিশালী হবে এবং আপনারা, এই তরুণরা, এই মধ্যবিত্ত তরুণরা ওই যে কৃষক আছে, যে কৃষকরা অপেক্ষা করছে, যে কৃষকরা মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিয়েছে এবং বঞ্চিত হয়েছে এবং যে কৃষকের সন্তান এখন গার্মেন্টসে চাকুরি করছে, বিদেশ গিয়ে টাকা পাঠাচ্ছে, অর্থনীতিকে সবল রেখেছে, সেই কৃষকের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবেন। তরুণদের ছাড়া ভরসা করবার আর জায়গা নেই। সেই তরুণদের উপর ভরসা রেখে আজকের এই সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে আমি আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments