আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাব এই সমাবেশে আসার জন্য এবং লালপতাকা নিয়ে মিছিলে যুক্ত হবার জন্য। আমরা এখানে যে বিপ্লবের শতবর্ষের উদযাপন করছি, সে রকম বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। এই বিপ্লব মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।
১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে একটা বিপ্লব হয়েছিল। সেই বিপ্লবের মূল কথা ছিল স্বাধীনতা, সাম্য আর মৈত্রী। কিন্তু স্বাধীনতা এসেছিল ধনীদের জন্য। সেই ফরাসি দেশেই ১৮৭১ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল, যার নাম ছিল প্যারি কমিউন। তাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। তারপরে ১৯১৭ সালে এই সমস্ত বিপ্লবকে পাথেয় করে এবং নতুন জ্ঞানের সঞ্চার ঘটিয়ে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে যে বিপ্লব হয়েছিল তা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এটি কেবল একটি দেশের বিপ্লব ছিল না, এই বিপ্লব ছিল সমস্ত বিশ্বের মানুষের জন্যে। এমন একটা রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যারা বলতে পেরেছিল যে – আমাদের এখানে কোনো মানুষ অভুক্ত থাকে না, বলতে পেরেছিল এখানে নিরক্ষর কেউ নেই, বলতে পেরেছিল এখানে আবাসনের কোনো সমস্যা নেই, বলতে পেরেছিল এখানে গণিকাবৃত্তি নেই। তারপর থেকে এই সমাজ ছড়িয়ে গেছে পূর্ব ইউরোপে, চীনে, কিউবায়, ভিয়েতনামে। ৭২ বছর টিকে ছিল সেই সমাজ।
প্রশ্ন উঠবে – এই ব্যবস্থা যদি এতই ভালো হবে তাহলে এর পতন হলো কেন? আসলে সমাজতন্ত্রের পতন হয়নি, পতন হয়েছে কতগুলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। আপনারা জানেন, পুঁজিবাদী বিশ্ব অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। তারা সমস্ত অপকৌশল প্রয়োগ করেছে, অপপ্রচার করেছে এবং ওই রাষ্ট্রের ভেতরেও একটা আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল, যারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে তৎপর ছিল। দেশের বাইরের আক্রমণ এবং দেশের ভেতরে এই অবস্থার কারণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতন হয়েছিল। সমাজতন্ত্র না থাকার পরিণতি রাশিয়াতে কী হয়েছে? বেকার সমস্যা চলে এসেছে, গণিকাবৃত্তি চলে এসেছে এবং ছদ্মবেশে জারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পুঁজিবাদ আজকে পতনের জায়গায় চলে এসেছে। সমাজতন্ত্র এসেছিল ঐতিহাসিক কারণে ও বৈজ্ঞানিক নিয়মে। ঐতিহাসিক কারণটা হলো এই – পৃথিবীতে একদিন দাস ব্যবস্থা ছিল, তারপর সামন্তব্যবস্থা এসেছে, এরপর পুঁজিবাদ এসেছে। পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ কথা হতে পারে না। ইতিহাস এগুবে, ইতিহাস পুঁজিবাদী পথে এগুবে না। ইতিহাস পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে এগুবে। এর কারণ হলো বৈজ্ঞানিক। কারণটি হলো এই যে আমরা দাস ব্যবস্থা, সামন্ত ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দেখছি, এদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। কিন্তু এদের মধ্যে যে মিল আছে তা হলো এ প্রত্যেকটি ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সমাজতন্ত্র উল্টো কথা বলে। সমাজতন্ত্র সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করে। কাজেই অন্য ব্যবস্থায় শতকরা পাঁচজন সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং ৯৫ জন বঞ্চিত হবে। অথচ এই ৯৫ জনের শ্রমেই সভ্যতা চলবে, আধুনিকতা চলবে। কাজেই সেই ব্যবস্থা টিকতে পারে না।
আজকে সারাবিশ্বে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বের ৯৫ ভাগ মানুষ সমাজতন্ত্রের পক্ষে আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দেখছি, পুঁজিবাদের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলো বেড়িয়ে আসছে এবং পুঁজিবাদ আজ তার শেষ অবস্থা ফ্যাসিবাদে রূপ নিয়েছে। আজ তার সমস্ত মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থা পৃথিবীকে উত্ত্যক্ত করছে, প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করছে, মানুষের সভ্যতাকে বিপন্ন করছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করছে। দুটো বিশ্বযুদ্ধ পুঁজিবাদ বাধিয়েছে। বিবাদ বাধিয়ে অস্ত্র বিক্রি করছে বিবাদমান দুই পক্ষের কাছেই। কাজেই পুঁজিবাদের হাতে এখন মানুষের সভ্যতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষ তাই বিক্ষুব্ধ। এই ব্যবস্থা তারা ভাঙবে। সমাজতন্ত্রের অভ্যূত্থান তাই অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য।
সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের পার্থক্য হলো মৌলিক। পুঁজিবাদ বিশ্বাস করে মুনাফায়, সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে মনুষ্যত্বে। পুঁজিবাদের আগ্রসন তাই মনুষ্যত্বের উপর আগ্রাসন। সেই জন্য এই মুনাফারূপী পুঁজিবাদের পতন অপরিহার্য। আমরা যদি পুঁজিবাদের নৃশংস রূপ দেখতে চাই, তাহলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে গণহত্যা চলছে, সেই দিকে তাকাব। এই গণহত্যা মুনাফার জন্য। একটা জনগোষ্ঠীকে একেবারে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এই গণহত্যায় চীন সমর্থন দিচ্ছে। আমরা দেখছি গণহত্যার সবচেয়ে নির্মম যে অস্ত্র গণধর্ষণ, তা আজ সামরিক জান্তারা চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর। এই গণধর্ষণ আমরা দেখেছি একাত্তর সালে। পাকিস্তানি হানাদাররা কেমন করে আমাদের মা, মেয়ে, বোনদের গণধর্ষণ করেছে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেও এই গণধর্ষণ চলছে। বাঙালিরা এই কাজ করছে। সবচেয়ে অকল্পনীয় যে ঘটনা শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে। নানা তার নাতনিকে ধর্ষণ করছে। এমন কাজ পাকিস্তানের হানাদাররাও করেনি। আজকের বাংলাদেশে সেই জিনিস আমরা দেখছি। দেখছি পুঁজিবাদ কত নির্মম কত বর্বর হতে পারে।
আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেটি ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’। সেই মন্বন্তরে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আমাদের নিজের গ্রামে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। সেই মানুষটা বেকার ছিল, তাকে সহযোগিতা করার কেউ ছিল না। আমি শৈশবে সেই দৃশ্য দেখেছি। সেই স্মৃতি আমাকে অনেকদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। সেই একই গ্রামে ৭৩ বছর পরে কিছুদিন আগে আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে একজন নয়, একটা পরিবার- বাবা, মা, মেয়ে সবাই আত্মহত্যা করেছে। সেই একই কারণে। অভাবের কারণে। ওই তেতাল্লিশের পর আমরা ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দিয়েছি, আমরা পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দিয়েছি, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ দেখছি। দেখছি একজনের জায়গায় তিনজন মারা যাচ্ছে।
উন্নতি হচ্ছে। উন্নতি গর্জন করছে। কিন্তু এই উন্নতির পিছনে এমন আত্মহত্যার গল্প আছে। যত উন্নতি হচ্ছে, তত বৈষম্য বাড়ছে। কারণ হচ্ছে এদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম, সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, মানুষ জেগে উঠেছিল। একাত্তরের যুদ্ধ হয়েছিল সমাজতন্ত্রের জন্য। এ কারণে জাতীয়তাবাদীরাও সংবিধানে সমাজতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হয়নি বলে পুঁজিবাদ অবমুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা তাতে পুজিবাদের জয় হয়েছে। এ কারণে এখানে ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরীব আরও গরীব হয়েছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ এসমস্ত কিছু বেড়েছে। সমাজতন্ত্র এর বিরুদ্ধে কথা বলে।
এই রুশ বিপ্লব, এর প্রতীক হচ্ছে কাস্তে-হাতুড়ি। কাস্তে-হাতুড়ি বোমা নয়, কাস্তে-হাতুড়ি কামান নয়, কাস্তে-হাতুড়ি হচ্ছে শ্রমের প্রতীক, সৃজনশীলতার প্রতীক। যে মেহনতী মানুষরা সভ্যতার চাকা চালায়, যারা উৎপাদন করে, তারা ওই কাস্তের সাহায্যে উৎপাদন করে, হাতুড়ির সাহায্যে উৎপাদন করে। এটি তাদের শ্রমের প্রতীক। রুশ বিপ্লব তাদের কথা বলে।
রুশ বিপ্লব থেকে যে শিক্ষা আমরা পাই তা হলো — প্রথমত, বিপ্লবে কোনো আপোসের জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত হলো, বিপ্লবীদের ঐক্য প্রয়োজন। তৃতীয়ত, বিপ্লবীদের জ্ঞানের অনুশীলন প্রয়োজন। এই জ্ঞানের কথাটা যেন আমরা না ভুলি। আমাদের স্মরণ করতে হবে যে মার্কসের সময়ে মার্কসের মতো অমন দার্শনিক পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি ছিলেন না। স্মরণ করতে হবে, লেনিন যখন বিপ্লব করেছিলেন, তখন তাঁর মতো বিপ্লবী পৃথিবীতে আর একজনও ছিল না। কাজেই তেমন জ্ঞানের চর্চা করতে হবে। আরেকটি কথা, বিপ্লব মানে সংস্কার নয়। বিপ্লব মানে সংশোধন নয়। বিপ্লবের মুহূর্তে লেনিন লিখেছিলেন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’। তিনি বলেছিলেন, পুরোনো রাষ্ট্রকে আমরা যদি চূর্ণ-বিচূর্ণ না করতে পারি, তাহলে বিপ্লব হবে না।
সোভিয়েতে যে বিপ্লব হয়েছিল তাতে ক্ষমতা কোনো পার্টির কাছে যায়নি, গেছে জনগণের কাছে। আজকে যে শতবর্ষ আমরা উদ্যাপন করছি তার ভেতর রয়েছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক। সমাজতন্ত্র অর্থাৎ সামাজিক মালিকানা। আমরা সেই ডাকে কীভাবে সাড়া দেব তার উপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের বিপ্লবের ভবিষ্যৎ। এ কথা বলে, আপনাদের পুনরায় শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।