Wednesday, November 20, 2024
Homeসাম্যবাদপুঁজিবাদ মানবজীবনে সর্বাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে — কমরেড প্রভাস ঘোষ

পুঁজিবাদ মানবজীবনে সর্বাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে — কমরেড প্রভাস ঘোষ

Convention_ P Ghoshকমরেড প্রেসিডেন্ট মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, উপস্থিত বামপন্থী দলগুলোর বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ, কমরেডস ও বন্ধুগণ, আমি মহান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠিত ভারতের স্যোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার (কমিউনিস্ট) এর পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে আমার বিপ্লবী অভিনন্দন জানাই। আপনারা এমন একটা সময়ে এই বিশেষ কনভেনশন করছেন যখন সমগ্র বিশ্বের মানব জাতি এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন। ইতিহাসে এর আগে কখনো এরকম সংকট এসেছে কি না আমার জানা নেই। এই সংকট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৈতিক সর্বক্ষেত্রব্যাপী।

মার্কস পুঁজিবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে তার সংকটের কারণ উদ্ঘাটন করেছেন
গোটা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদী শাসন চলছে। এই পুঁজিবাদের অভ্যুদয় ঘটেছিল সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে, সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে, তখন শিল্প বিপ্লবের ঝান্ডা বহন করে ব্যাপক শিল্পায়ন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতি, মানবতাবাদ-গণতন্ত্রের স্লোগান, সাম্য-মৈত্রীর আহ্বান, স্বাধীনতার আহ্বান এইসব ঘোষণা নিয়ে পুঁিজবাদ মানবজাতির সামনে উপস্থিত হয়েছিল। সেই সময় যারা ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, জার্মানির পেজেন্টস মুভমেন্ট, যার মধ্য দিয়ে সভ্যতার জয়যাত্রা শুরু, যারা প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিলেন, তারা কেউই দুঃস্বপ্নে ভাবেন নাই এই পুঁজিবাদ আজকে মানবসভ্যতাকে কী ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন করবে। সে সময়ে মহান মার্কস পুঁজিবাদের সংকট দেখে যান নাই। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে হাতিয়ার করে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, এই পুঁজিবাদও ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করবে। কারণ পুঁজিবাদের নিয়ম, পুঁজির ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ) মুনাফার জন্য, আর মুনাফা অর্জন করতে হলে শ্রমিককে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেই মুনাফা অর্জন করতে হবে। অংকশাস্ত্র দিয়ে সেই সময় মার্কস এটা দেখিয়েছিলেন। সারপ্লাস লেবার দ্বারাই সারপ্লাস ভ্যালু (উদ্বৃত্ত শ্রম থেকেই উদ্বৃত্ত মূল্য), যেখান থেকে পুঁজিপতিরা মুনাফা অর্জন করে, আর এখান থেকে পুঁজিবাদের বাজার সংকট আসবে — একথা তিনি বলেছিলেন এবং বলেছিলেন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রেই সর্বাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে।

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে স্থায়ী মন্দা চলছে
আজ গোটা বিশ্বের দিকে যদি আমরা তাকিয়ে দেখি, ইউএনও-র হিসাব ৩৫০ কোটি মানুষের হাতে যা সম্পদ, মাত্র ৮৫ জন ব্যক্তি সেই সম্পদ ভোগ করছে। একদিকে ৩৫০ কোটি লোক, আরেকদিকে ৮৫ জন ব্যক্তি – এই হচ্ছে বিশ্বের অবস্থা। বিশ্বের ১২০ কোটি লোক দৈনিক রোজগার করে ১.২৫ ডলার। ২২০ কোটি লোক দৈনিক রোজগার করে ২.৫০ ডলার – এই হচ্ছে তাদের রোজগার, তাদেরই হিসাব। প্রায় ৪০০ কোটি লোক গোটা বিশ্বে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির লোকোমোটিভ ইঞ্জিন বলে পরিচিত, আজ সে প্রশান্ত মহাসাগরে নিমজ্জিত প্রায়, ত্রাহি ত্রাহি রব, মন্দার পর মন্দার আক্রমণে মার্কিন অর্থনীতি বিপর্যস্ত। মার্কিন দেশে আড়াই কোটি লোক বেকার, ৩০ লক্ষ ৫০ হাজার লোক গৃহহীন, রাস্তায় কাটায়, পার্কে কাটায়, ব্রিজের তলায় কাটায়, চরম দারিদ্র্য মার্কিন দেশের, মার্কিন অর্থনীতি দেউলিয়া, যে ছিল সবচেয়ে বেশি ঋণদাতা, সে হচ্ছে এখন সবচেয়ে বেশি ঋণী। গোটা ইউরোপের ইঞ্জিন বলে পরিচিত জার্মানি সেও চরম সংকটে নিমজ্জিত। ইউরোপেও মন্দার ছায়া। পরশুদিন কাগজে দেখলাম জাপানও মন্দা কবলিত। প্রায় স্থায়ী মন্দা গোটা বিশ্বব্যাপী এখন চলছে। সমস্ত জায়গায় ছাঁটাই, কলকারখানা বন্ধ; শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি কোথাও তুলতে পারছে না, বরঞ্চ মজুরি কমিয়ে দিচ্ছে। কোনও দাবি তুললে ছাঁটাই করবে এই ভয় আমেরিকা-ইউরোপে। এবং সেখানে স্থায়ী চাকরি নেই, বেতন কমিয়ে দিচ্ছে। সেসব দেশে রাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত, যাকে বলে সভ্রেইন ডেব্ট, রাষ্ট্র নিজে ঋণী। গোটা ইউরোপ-আমেরিকা-জাপান সমস্ত জায়গায় রাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত। এই টাকা দিয়ে স্টিমুলেশন দিচ্ছে পুঁজিপতিদের। যেটাকে আমাদের ভাষায় আমরা বলি পুঁজিবাদ আজ ইনটেনসিভ কেয়ার রুমের ভেন্টিলেশনে আছে। রোগীকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়, বিশ্বপুঁজিবাদ আজ ভেন্টিলেশনে আছে – এই হচ্ছে তার অবস্থা। বাজার অর্থনীতির বাজার নেই। কোথায় বাজার পাবে, খদ্দের চাই তো, যেখানে কোটি কোটি বেকার এবং যারা কাজ করছে তাদের মজুরি অত্যন্ত কম, টাকার দাম পড়ে যাচ্ছে। ফলে কেনবার ক্ষমতা নাই। ফলে বাজার অর্থনীতিই বাজারকে ধ্বংস করছে। এ হচ্ছে অনেকটা যেমন সুন্দরবনের বাঘ হরিণ খায়, হরিণের গর্ভে বাচ্চা আছে তাকেও খেয়ে ফেলে, ভবিষ্যতে আরও হরিণ জন্ম নেয় না। এক ধরনের তৃণভোজী যেমন ঘাস খেতে খেতে ঘাসের শেকড় খেয়ে ফেলে, নতুন ঘাস জন্মায় না, পুঁজিবাদ এভাবে নিজের বাজারকে নিজেই ধ্বংস করছে। এর হাত থেকে পুঁজিবাদের যেন নিস্তার নেই।

Convention_Deligate Session 2
প্রতিনিধি অধিবেশনের শুরুতে দলীয় পতাকা ও শুভেচ্ছা স্মারক বিনিময়

ভারতে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে কোটিপতিদের, শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের নয়
আমি যে দেশের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছি সেই ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে বলেছে, ১২১ কোটির দেশ, ৬৬ কোটি সেখানে আনএমপ্লয়েড। ১২১ কোটির মধ্যে ৬৬ কোটি বেকার, আপনারা ভাবুন। আর আমাদের হিসাব হচ্ছে ৬৬ না, ৮০ কোটি বেকার ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষে এখন ৮১ পার্সেন্ট লোকের দৈনিক রোজগার ২০ টাকা। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের চেহারা। ভারতবর্ষে ইউনেস্কোর হিসাব প্রতিবছর ২৫ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যায়। দেড় লক্ষ লোক আত্মহত্যা করে। তার মধ্যে কৃষকের সংখ্যা বেশি। ভারতবর্ষে এই হচ্ছে অগ্রগতির চিত্র। প্রায়ই উন্নয়ন উন্নয়ন বলে ভারতবর্ষের নেতারা বলে, এই হচ্ছে ভারতবর্ষের উন্নয়ন। শিশুমৃত্যুতে ভারতবর্ষ শীর্ষস্থানে। মায়েরা সন্তান জন্মের সময় ভারতবর্ষে মারা যায় সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষ নারী পাচারে শীর্ষস্থানে। ভারতবর্ষ কালোবাজারিতে শীর্ষস্থানে, বিশ্বে যত কালো টাকার কারবার সেইক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানে। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারতবর্ষের পুঁজিবাদের অগ্রগতি! আবার ভারতবর্ষের আরেকটা চিত্র আছে। বিশ্বের কোটিপতি সবচেয়ে যে দেশে বেশি, এক নম্বর দুই নম্বর করতে করতে ভারতবর্ষ এখন ষষ্ঠ স্থানে। মানে কোটিপতির সংখ্যায় ভারতবর্ষ এখন ষষ্ঠস্থান অধিকার করেছে। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের অবস্থা। ভারতবর্ষের পার্লামেন্টের ৮০ ভাগ সদস্য কোটি টাকার মালিক। বিলিওনিয়ার্স এন্ড মিলিওনিয়ার্স এরা হচ্ছে পার্লামেন্টের সদস্য। তাহলে এরা কার রিপ্রেজেন্টেটিভ (প্রতিনিধি) আপনারা অনুমান করতে পারেন। ক্ষুধার্ত শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনগণের নয়। ভারতবর্ষের এই চেহারা।

ভারত একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র
ভারতবর্ষের পুঁজিপতিরা গতবছরেই ৩২ হাজার ২৪৬ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে ইনভেস্ট করেছে। ভারতবর্ষ শুধু পুঁজিবাদী না, ভারত একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশ। আমাদের মহান শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়ে গেছেন ভারতবর্ষের পুঁজিপতিরা বহুদিন আগেই, পাঁচের দশকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এবং এটার শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। ভারতবর্ষে একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠী, মাল্টিন্যাশনালের জন্ম হয়েছে। ভারতবর্ষের পুঁজিপতিরা অন্যদেশের মাল্টিন্যাশনালের সাথে হাত মিলিয়ে বিশ্বকে লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতের দোস্তি খুবই প্রবল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইসরায়েল একটা শক্তি হিসাবে দাঁড়াচ্ছে। এক সময় পাকিস্থান ছিল আমেরিকার মিত্র। এখন পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে ভারতের হাত ধরেছে আমেরিকা। এবং ভারতবর্ষের পুঁজিবাদকে শক্তিশালী করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে, আরব দুনিয়াকে লুণ্ঠনের ক্ষেত্রেও ভারত আমেরিকার সহযোগী ভূমিকা নিচ্ছে। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের চেহারা। একদিকে ভারত রাষ্ট্রের দেশি-বিদেশী ঋণ প্রায় ৭৪ লক্ষ কোটি টাকা। সেই ভারতীয় রাষ্ট্রই আবার ভারতীয় পুঁজিপতিদের ৩৬ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স মওকুফ করে দিয়েছে। ট্যাক্স তো কমাচ্ছে যাতে পুঁজিবাদ আরও শক্তিশালী হয়। এরকম একটা আক্রমণের সম্মুখীন ভারতীয় জনগণ।
ফলে বিশ্বে দারিদ্র্য বাড়বে, বেকারত্ব বাড়বেই, ছাঁটাই বাড়বেই, পার্মানেন্সি বলে কোনো নতুন ওয়ার্কার কোথাও হচ্ছে না, সব টেম্পোরারি। এবং দুনিয়াভর এখন কন্ট্রাক্ট সিস্টেম, চুক্তিভিত্তিক কাজ। ভারতবর্ষ এখন লেবার রিফর্ম করতে যাচ্ছে। চুক্তি ভিত্তিকও নয়, সমস্ত শ্রমিক এপ্রেনটিস (প্রশিক্ষণার্থী) হিসাবে নেবে, আরও কম মজুরিতে। এবং আট ঘণ্টা শ্রমদিবসও আর থাকছে না। যত ইচ্ছা খাটিয়ে নাও, শ্রমিকরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না। ভয়ঙ্কর আক্রমণ গোটা বিশ্বে, ভারতবর্ষে। শ্রমজীবী মানুষ সমস্ত জায়গায় এরকম একটা আক্রমণের সামনে পড়েছে। পুঁজিপতিরা ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করতে পারছে না। সে টাকা ঢালছে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসায়, চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসায়, গৃহনির্মাণ নিয়ে ব্যবসায় — এইসব নানান জায়গায়। সুদের কারবার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ৭৫ লক্ষ ডলারের একটা শ্যাডো ব্যাংকিং ওয়ার্ল্ড চলছে ভারতবর্ষে। মানে পুঁজিপতিরা কারখানা না করতে পেরে এখন সুদের কারবার করছে। বহুদিন আগে এটা লেনিন দেখিয়ে গেছেন। এরকম একটা অবস্থা সেদেশে।

পুঁজিবাদ গণতন্ত্রের ঝাণ্ডাকে পদদলিত করছে
অন্যদিকে গণতন্ত্র কথাটা কথায় আছে — ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল’ গণতন্ত্রের বিঘোষিত কথা। কিন্তু পিপল কোথায়? সমস্ত জায়গায় বাই দ্য ক্যাপিটালিস্ট, ফর দ্য ক্যাপিটালিস্ট, অফ দ্য ক্যাপিটালিস্ট। পিপল বলে কিছু নাই। মানি পাওয়ার সবকিছু কন্ট্রোল করে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসেসই ইলেকশানকে ম্যানিপুলেট করে, তাদের মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার, মিডিয়া পাওয়ার দিয়ে। ইলেকশানের নামেই এই জিনিস হচ্ছে। ফলে গণতন্ত্র বলে কোথাও কিছু নাই। বরঞ্চ ফ্যাসিবাদ নানানরূপে নানানভাবে বিশ্বের সমস্ত জায়গায় আক্রমণ করছে। এই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য বহুদিন আগেই কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়ে গেছেন। অনেকে ভেবেই ছিল ফ্যাসিস্ট জার্মানি-ইটালির পরাজয়ের পর ফ্যাসিবাদ নাই। তিনি বললেন — না, বরঞ্চ আজকে উন্নত-অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ফ্যাসিবাদ। কনসেনট্রেশন অব ক্যাপিটাল, মনোপলি ক্যাপিটাল হচ্ছে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি। অন্যদিকে সেন্ট্রালাইজেশন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল-মিলিটারি-ব্যুরোক্রেটিক কমপ্লেক্স, তার হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে চিন্তার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধ্বংস করা, যুক্তিবাদী মননকে ধ্বংস করা, অন্ধতা-অন্ধবিশ্বাস-কূপমণ্ডুকতা-প্রাচীন ঐতিহ্যবাদ-উগ্র জাতীয়তাবাদ এগুলোকে উৎসাহিত করা। এই আক্রমণ বিশ্বের সমস্ত জায়গায়। ফলে গণতন্ত্র বলে কোনও কিছু নাই। পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির পার্লামেন্ট আছে, ডেমোক্রেসি বলে কোথাও কিছু নাই। এই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলেই তো ইউরোপ এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকা লুণ্ঠন করেছিল উপনিবেশ স্থাপন করে। এই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলেই তো প্রথম মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছিল। এই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলেই তো জার্মানিতে, ইটালিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল। এই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বর্ষণ করে ধ্বংসস্তুপ করেছিল। এই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলেই তো এই সেদিন মিথ্যা অজুহাত তুলে একটা বর্বর আক্রমণ করেছে ইরাকের উপরে। ইরাক নাকি ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তৈরি করেছে। কিচ্ছু খুঁজে পায় নাই। একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ধ্বংস করল, আফগানিস্তানকে ধ্বংস করল, লিবিয়াকে ধ্বংস করল, সিরিয়াকে ধ্বংস করছে। ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গা বাঁধিয়েছে ইরাকে, শিয়া-সুন্নি লড়াই — এর পেছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সমস্ত জায়গায় তো পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির ঝাণ্ডা তুলেই, এই হচ্ছে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কদর্য পরিণতি। ফলে পুঁজিবাদ যে গণতন্ত্রকেও একদিন ঘোষণা করেছিল, সেই ঝাণ্ডাকে পদদলিত করেছে, কোথাও গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। এই হচ্ছে লুণ্ঠনের গণতন্ত্র, পুঁজিবাদের শোষণের গণতন্ত্র। জনগণের প্রতিবাদের গণতন্ত্র নেই, আন্দোলন-লড়াইয়ের গণতন্ত্র নেই। এই হচ্ছে গণতন্ত্রের চেহারা।
পুঁজিবাদ মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে।

অন্যদিকে যে ইউরোপ একসময় শেকসপীয়রকে জন্ম দিয়েছিল, মিল-মিল্টন-বার্কলেকে জন্ম দিয়েছিল, ভিক্টর হুগো-এমিল জোলাকে জন্ম দিয়েছিল, টলস্টয়কে জন্ম দিয়েছিল, গোর্কিকে জন্ম দিয়েছিল, নিউটনকে জন্ম দিয়েছিল, আইনস্টাইনকে জন্ম দিয়েছিল, আরো অনেক বৈজ্ঞানিককে জন্ম দিয়েছিল, যে ইউরোপ রুশো-ভলতেয়ারকে জন্ম দিয়েছিল, যে আমেরিকা আব্রাহাম লিংকন-জেফারসনকে জন্ম দিয়েছিল, সে ইউরোপ আজ কোথায়? সে ইউরোপের আজকে ক্লেদাক্ত রূপ, সে ইউরোপকে ধ্বংস করেছে পুঁজিবাদ। সেখানে মনুষ্যত্ব বলে কিছু নাই। মানবতাবাদ-মানবিক মূল্যবোধ বলে কিছু নাই, তাকে ধ্বংস করছে। সমস্ত জায়গায় সে নোংরা সংস্কৃতির চর্চা করছে। চূড়ান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা-স্বার্থপরতা, শুধু লোভ আর লোভ, ব্যক্তিগতভাবে লুণ্ঠন করা, লোভ করা, অপরকে ঠকানো, আর ভোগবাদী মানসিকতা। ওখানে ট্যাবলেট না খেলে যুবকদের ঘুম হয় না। নোংরা মানসিকতা চরিতার্থ না করলে তাদের আনন্দ হয় না। ইউরোপে স্লোগান উঠেছে — বিবাহিত জীবন বন্ধন চাই না, কিছুক্ষণের জন্য লিভ টুগেদার। ইউরোপের মেয়েরা মা হতে চায় না, মা হওয়া বোঝা। যে সন্তান ইউরোপে জন্ম নিচ্ছে তারা মাতৃত্বের-পিতৃত্বের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আমরা বাচ্চা বয়সে পেন্সিল নিয়ে মারামারি করতাম ক্লাসে, আর শিশু বয়সী আমেরিকার ছেলেমেয়েরা স্কুল লাইফে পিস্তল নিয়ে মারামারি করে, খুন করে। ইউরোপে আমেরিকাতে আজ এই অবস্থা। আমেরিকা-ইউরোপে মাধ্যমিক স্কুলে সেখানে কনট্রাসেপটিক ক্লিনিকের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সভ্যতাকে কোথায় নিয়ে গেছে এই ইউরোপ।

আর তার ঢেউ আমাদের দেশে এসে গেছে। আপনাদের চেহারা আপনারা জানেন, আপনারাই বলবেন। আমাদের ভারতবর্ষ — আমি অবিভক্ত ভারতবর্ষের কথাই বলছি — যে রামমোহন বিদ্যাসাগরকে জন্ম দিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকে জন্ম দিয়েছিল, নজরুল-শরৎচন্দ্রকে জন্ম দিয়েছিল। কত বৈজ্ঞানিক, কত দেশাত্মবোধের এই দেশবন্ধু, সুভাষ বোস, ভগৎ সিং, আশফাক উল্লাহ খান, সূর্যসেন, প্রীতিলতা আপনাদের এখানকার — সেই দেশ আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই দেশের স্মৃতি অবলুপ্ত। এদের নামও উচ্চারণ করার লোক কোথাও নেই। নোংরা ফিল্ম স্টারদের জীবনী, ক্রিকেট প্লেয়ারদের জীবনী এই হচ্ছে চর্চার বিষয়, আলোচ্য বিষয়। মেয়েরা ভারতবর্ষের শহরগুলোতে সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় বেরুতে পারে না। কাকে কখন কে তুলে নিয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটির ছেলে, কলেজের ছেলে, তথাকথিত শিক্ষিত ছেলেরাই এগুলো করছে! ধর্ষণ-গণধর্ষণ প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে অসংখ্য ঘটে যাচ্ছে এবং এই নিয়ে কোথাও এতটুকু বিবেক দংশন নাই! ছ’বছরের শিশু তাকে পর্যন্ত ধর্ষণ করছে! পিতা অভিযুক্ত — কন্যা অভিযোগ করছে ধর্ষণের দায়ে। ভারতবর্ষের সংবাদপত্রে এইসব জিনিস পাবেন। তার জন্যে ভারতবর্ষের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল? শহীদরা প্রাণ দিয়ে গিয়েছিল? এই নিয়ে নজরুলের কাব্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শরৎচন্দ্রের সাহিত্য — এসব জিনিস তারা দেখে যাননি। মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই। চূড়ান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা-স্বার্থপরতা, বিবেকবর্জিত মানুষ — এরকম একটা অবস্থা। স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রেম-প্রীতি ভালবাসা — মানুষের যেগুলি হৃদয়বৃত্তি, যেখানে মানুষ আর জন্তুতে পার্থক্য। যৌন সম্পর্ক তো প্রকৃতির নিয়ম, প্রাণী জগতেও আছে। মানুষের যৌন সম্পর্ক কি তাই? এই রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কত কাব্য-গান, শরৎবাবুর সাহিত্যে কত মাধুর্য্য, ধর্ম-অধর্ম, ন্যায়-অন্যায়, কত সৌন্দর্য্য — এর সব কিছু ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সবকিছু মরে গেছে। ছেলে রোজগার করে বৃদ্ধ বাবা-মার দায়িত্ব নেবে না, রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে না হলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই বৃদ্ধাশ্রম আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতার সৃষ্টি। বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের কারাগার, সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এরকম একটা অবস্থা। বিয়ের পাঁচদিন বাদে স্ত্রীকে বিক্রি করে দিচ্ছে কয়েক হাজার টাকা পেয়ে। এই সব জিনিস হচ্ছে।
তো এই হচ্ছে পুঁজিবাদী সভ্যতার সংস্কৃতি। ফলে পুঁজিবাদ মনুষ্যদেহী মনুষ্যত্ব বর্জিত একদল ‘আধুনিক’ মানুষ বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করছে। এই আক্রমণ আরো ভয়ঙ্কর। বহুদিন আগে কমরেড শিবদাস ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, জনগণ-একটা দেশ-একটা জাতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে, লড়তে পারে, যদি তার মনুষ্যত্ব থাকে, নৈতিক বল থাকে। তার সামনে আদর্শ থাকে। ভারতবর্ষের পুঁজিবাদ সেই নৈতিক বলকে ধ্বংস করছে, ছিন্নমূল করে দিচ্ছে, অতীতের যে সংগ্রামী ঐতিহ্য, মানবিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য তার মূল থেকে ছিন্ন করে দিচ্ছে। এই হচ্ছে আরেকটা সমাজ। একটুবাদেই অন্ধকার নামবে — ভারতবর্ষের গঞ্জে গঞ্জে স্টেশনে স্টেশনে পাওয়া যাবে অসংখ্য নারীমূর্তি — আমাদেরই মা-বোন, আমাদেরই কন্যা। স্বামী বেকার, অভুক্ত সন্তান, দেহ বিক্রির জন্য লক্ষ লক্ষ নারী বাজারে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতবর্ষের সংবাদমাধ্যমে এই খবর পাবেন। ফুটপাতে লক্ষ লক্ষ শিশু জন্ম নেয়, সে জানে না তার বাবা কে, মা কে, কোন গ্রামে তার ঠিকানা।

সমাজতন্ত্র নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল
কয়েক হাজার বছরের শোষণমূলক ব্যবস্থা যে পৃথিবীতে কায়েম ছিল, পুজিবাদকে উচ্ছেদ করার জন্য সেখানে আমাদের লড়াই মাত্র আশি বছরের। এর মধ্যে জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন আছে, ফলে এখানে হতাশার কোনো কারণ নেই। এ কথাই আমরা বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনে প্রথম শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখল করে, যা মাত্র কয়েক মাস টিকে ছিল। ৪৬ বছর বাদে মহান লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের বিজয় যাত্রা শুরু হয়। এবং সে সমাজ আশি বছর টিকে ছিল। এবং এই আশি বছরের বেশিরভাগটাই হচ্ছে ক্রমাগত অগ্রগতির ইতিহাস। যে সমাজতন্ত্রে বেকারত্ব বলে কিছু ছিল না, ছাঁটাই বলে কিছু ছিল না, ক্রমাগত মজুরদের মজুরি বৃদ্ধি করছিল। বিনামূল্যে চিকিৎসা ছিল, বিনামূল্যে শিক্ষা ছিল। যে সমাজতন্ত্রে নর নারীর সমান অধিকার ছিল। যে সমাজতন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বৈষম্য ছিল না। জাতিগত বৈষম্য ছিল না। যে সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিল বার্নাড শ, রমাঁ রল্যা, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ। এরা সকলেই অভিনন্দন জানিয়েছিল নতুন সভ্যতা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, রাশিয়ায় গিয়ে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থানে পৌঁছালাম। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন রাশিয়ায় গিয়ে, এ একটা দেশ, ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান ছিল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার কিন্তু প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। এই একটা দেশ (সোভিয়েত ইউনিয়ন) সেটা প্রতিষ্ঠা করেছে। আরেকটা কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, হাজার বছরের ইতিহাসের বিরুদ্ধে এ দেশটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন — রাশিয়ান বিপ্লব, এ রক্তাক্ত বিপ্লব মানব ইতিহাসে প্রথম একটা লড়াই করছে, লোভ থেকে মানুষকে মুক্ত করার, লোভ-লালসা থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার। আমি আজ কামনা করি এদের এই লড়াই যেন জয়যুক্ত হয়। মনীষী রমাঁ রল্যা বলেছিলেন, আমি কমিউনিজমের পক্ষে, যদি কোনো দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হয়, তবে মানবজাতির ইতিহাসে অন্ধকার নেমে আসবে। বার্নাড শ বলেছিলেন, পৃথিবীতে গণতন্ত্র যদি কোথাও থাকে, সে গণতন্ত্র আছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরা কিন্তু কেউ কমিউনিস্ট ছিলেন না। এরা সব মানবতাবাদী ছিলেন। সুভাষ বোস বলেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দী দিয়েছে মার্কসবাদ। বিংশ শতাব্দী দিয়েছে মানব ইতিহাসে রুশ বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা, সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি। যখন পশ্চিমি সভ্যতা অস্তমিত, সংকটগ্রস্ত। পশ্চিমি সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদীরা এই নতুন সভ্যতাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

সমাজতন্ত্রের সংকট এসেছে শোধনবাদী চিন্তা থেকে
এই সমাজতন্ত্রের সংকট অনিবার্য ছিল না, পুঁজিবাদ আক্রমণ করেছিল ধ্বংস করার জন্য, বাইরে থেকে আক্রমণ করে পারে নি। কিন্তু ধ্বংস হল যে কারণে সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছিল, রাজনীতি ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটেছিল। কিন্তু চিন্তা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী যে সংস্কৃতি, ব্যক্তিবাদী যে মানসিকতা, ব্যক্তিবাদী যে স্বার্থবোধ, যেটা পুঁজিবাদ সৃষ্ট মানসিকতা — চিন্তার জগতে, ভাবের জগতে, সংস্কৃতির জগতে — এখান থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে পারে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামটা যথাযথভাবে করা যায়নি।

১৯৪৮ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন গাছতলায় দাঁড়িয়ে আমাদের দল প্রতিষ্ঠা করছেন, তখনই তিনি হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন। তখন সাম্যবাদী আন্দোলনে বিরাট অগ্রগতি ঘটেছে। রাশিয়ার সমাজতন্ত্র, পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র, চীন জয়লাভের পথে, ভিয়েতনাম জয়লাভের পথে, সাম্রাজ্যবাদ থরথর করে কাপঁছে। তখন কমরেড শিবদাস ঘোষ বলছেন যে, সাম্যবাদী আন্দোলনের অভ্যন্তরে, মার্কসবাদী পরিভাষায় যাকে বলে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, সেটা নেই। চিন্তার দ্বন্দ্ব নেই। অর্থাৎ নেতার সাথে কর্মীদের সম্পর্ক হবে দ্বান্দ্বিক। এমনকি বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে, অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক হবে দ্বান্দ্বিক। নেতা ঠিক করছে কি ভুল করছে, নেতৃত্ব ঠিক পথে চলছে কি ভুল পথে চলছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক পথে চলছে কি ভুল পথে চলছে, মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিচার করার ক্ষমতা অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির থাকা উচিৎ। এবং বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট নেতা কর্মীদের থাকা উচিত। এ না হলে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের পরিবর্তে আসবে যান্ত্রিকতা। এবং এ যান্ত্রিকতা এসে গেছে, ভবিষ্যতে বিপদ সৃষ্টি করবে। তিনিই প্রথম মহান স্ট্যালিনের জীবদ্দশায় ১৯৪৮ সালেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। মহান স্ট্যালিন মৃত্যুর আগে এ বিপদ বুঝেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ১৯৫৩ সালে, রাশিয়ার ভিতরে পুঁজিবাদী চিন্তার প্রভাব আসছে, এ আশংকা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। রাশিয়ার অভ্যন্তরে, প্রতিবিপ্লবী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে এটা তিনি অনুভব করেছিলেন। হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র তিন মাস বাদেই তিনি মারা যান। সে লড়াই করলেন মহান মাও সেতুঙ চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য। তিনিও বেশি দিন বেঁচে থাকলেন না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে পুরো মাত্রায় সফল করে যেতে পারলেন না। সে সময় কমরেড শিবদাস ঘোষ বললেন, এই যান্ত্রিক সম্পর্ক হচ্ছে কেন? এই যান্ত্রিকতা হওয়ার কারণ, মার্কসবাদের যে উন্নত চেতনা এবং মার্কসবাদী যে সংস্কৃতি, সর্বহারা সংস্কৃতির উন্নত মান, এ না থাকার জন্য যান্ত্রিকভাবে নির্ভর করা, একটা অন্ধতা এসে গেছে।

আমাদের পার্টি বেঁচে গেল কেন? দেখুন, রাশিয়ায়, চীনে কমিউনিজম ধ্বংস হয়ে যাবার পর, বিশ্বের অনেক শক্তিশালী পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। আমাদের পার্টি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর কোনো ভাঙন হয় নি। আমরা ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে এগুচ্ছি, কারণ আমাদের পার্টি, কমরেড শিবদাস ঘোষ, মহান স্ট্যালিনকে , মাও সেত্ঙু-কে শিক্ষক হিসেবে মানতেন, কিন্তু অন্ধভাবে মানতেন না। তাঁদের যেগুলো ঠিক বক্তব্য তাকে গ্রহণ করতেন, যেগুলো তিনি মনে করতেন ঠিক না সেগুলো তিনি ছাত্র হিসাবে শিক্ষকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি আমাদের পার্টিকে তৈরি করে গিয়েছিলেন, আমাদের মনকে তৈরি করে গিয়েছিলেন, এরকম একটা বিপদ আসছে, এই বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকতে। এর জন্য আমাদের দুঃখ হয়েছে, কিন্তু আমরা হতাশ হইনি, আমরা ভেঙে পড়িনি। এটা তিনি পারলেন কিসের জোরে?

তিনি পারলেন কারণ আমাদের পার্টি গড়ে তুলতে গিয়ে তাঁকে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তখন ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি একটি, স্ট্যালিন তাদের সমর্থন করছে, মাও সেতুঙ তাদের সমর্থন করছে। আর কমরেড শিবদাস ঘোষ এই কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বিচার করে দেখালেন, এই কমিউনিস্ট পার্টি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি নয়। এরা ভারতবর্ষের যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি হলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই পরিণতি হত না। বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসতে পারতো না। এমনকি ১৯২৫ সালে মহান স্ট্যালিন ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের বলেছিলেন, ভারতবর্ষের জাতীয় বুর্জোয়ারা আপসকামী। এদেরকে বিচ্ছিন্ন করে পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনি মৈত্রী করতে বলেছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষ বোসকে বিরুদ্ধতা করে গান্ধীকে সমর্থন করেছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে সুভাষ বোস বারবার ডেকেছিলেন বামপন্থী ঐক্যের জন্য। তারা সাড়া দেয় নি। এমনকি ’৪২-এর আগস্ট আন্দোলনে তারা শামিল হয় নি। এই জন্য স্ট্যালিন তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন। তারা সুভাষ বোসকে জাপানের দালাল বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সুভাষ বোস কৌশলগত কারণে জাপানে গিয়েছিলেন, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য। কৌশল ঠিক কি বেঠিক প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সুভাষ বোস সোভিয়ত ইউনিয়নের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। রাশিয়া যখন যুদ্ধে হারছে, তখনও সুভাষ বোস সিঙ্গাপুর থেকে বলছেন, এখনও মহান স্ট্যালিন বেঁচে আছেন, এই মহান স্ট্যালিন মানবসভ্যতাকে রক্ষা করবেন। এই লোককে সি পি আই ব্যবহার করতে পারে নি। কারণ সি পি আই কোনোদিনই ভারতবর্ষের মাটিতে মার্কসবাদকে প্রয়োগ করতে পারে নি। এখানেই তাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা, আমি তাদের অনেক ভুলের ইতিহাস এখানে ব্যক্ত করতে চাই না।

চলমান জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মার্কসবাদকে বিকশিত করতে হবে
লেনিন বলেছেন যে, মার্কস-এঙ্গেলস এ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। আমরা মার্কস-এঙ্গেলসের ছাত্র। চলমান জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মার্কসবাদকে আমাদের আরও সর্বাত্মকভাবে বিকশিত করতে হবে। মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক দর্শন। একমাত্র দর্শন যা বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, বোটানি, জুওলজি বিজ্ঞানের নানান শাখা-প্রশাখা বস্তুজগতের, প্রকৃতি জগতের বিভিন্ন দিকে কাজ করে। বিশেষ ফিল্ডের আবিষ্কৃত বিশেষ নিয়মগুলোকে কো-অর্ডিনেট করে, কো-রিলেট করে জেনারালাইজ করে, সাধারণীকৃত করে তার থেকে সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করেছেন মার্কস। যে জন্য মার্কসবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনও বিরোধ নেই। মার্কসবাদের যে জেনারেল প্রিন্সিপলস তা প্রকৃতি জগত, মানবসমাজ সমস্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন গ্যালিলিও কোন নিয়ম সৃষ্টি করেন নাই, নিউটন কোনো নিয়ম সৃষ্টি করেন নাই, আইনস্টাইন কোনো নিয়ম সৃষ্টি করেন নাই। প্রকৃতি বস্তু যে নিয়মে চলছে তা আবিষ্কার করেছেন। মার্কসও কোন নিয়ম সৃষ্টি করেন নাই। মানবসভ্যতা যে নিয়মে চলছে, সমাজ যে নিয়মে চলছে, পরিবর্তিত হয়েছে, সেই নিয়মকে তিনি আবিষ্কার করেছেন। সে জন্য বিজ্ঞানের ধ্বংস নেই, মার্কসবাদেরও ধ্বংস নেই। বিজ্ঞানের অপব্যবহার হতে পারে, বিজ্ঞানের ভ্রান্ত প্রয়োগ হতে পারে, বিজ্ঞানের নামে অ্যাটম বোমা তৈরি করে ধ্বংস হতে পারে, তেমনি মার্কসবাদের নামে বিভ্রান্তি হতে পারে, সংশোধনবাদ আসতে পারে, মার্কসবাদের নামে মার্কসবাদের বিপ্লবী প্রাণ সত্ত্বাকে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু সেটা সঠিক মার্কসবাদ নয়। যথার্থ মার্কসবাদ বৈপ্লবিক শক্তির জোরে, বৈজ্ঞানিক শক্তির জোরে টিকে আছে এবং টিকে থাকবে।

বুর্জোয়ারা বিজ্ঞান নেয় কৃষিতে-শিল্পে, বুর্জোয়ারা বিজ্ঞান নেয় চিকিৎসাক্ষেত্রে, যানবাহনে, যন্ত্রনির্মাণে, সৌরজগত অভিযানে, সমস্তক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে নেয়। কিন্তু বুর্জোয়ারা ইতিহাস বিশ্লেষণে বিজ্ঞানকে নেবে না। সামাজিক সমস্যার প্রশ্নে বিজ্ঞানকে নেবে না। কারণ তাহলে বুর্জোয়া সভ্যতা বিপন্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার যে সবকিছু পরিবর্তনশীল, গতিশীল। কোনো জিনিসই এক জায়গায় থাকে না। সমাজও এক জায়গায় থাকে না। মার্কসবাদই প্রথম দেখিয়েছে কেন আদিম সমাজ ভেঙে দাসপ্রথা এল, দাসপ্রথা ভেঙে সামন্ততন্ত্র এল, সামন্ততন্ত্র ভেঙে কেন পুঁজিবাদ এল, আবার পুঁজিবাদ পাল্টে কেন সমাজতন্ত্র আসবে, তারপর কমিউনিজম আসবে, তারপর আরও নতুন সমাজ আসবে। এ বিরামহীন, এর শেষ নেই। কোন নিয়মে হবে তা মার্কসবাদ দেখিয়ে গেছে।

কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদকে বিকশিত করেছেন
যেভাবে মার্কস-এঙ্গেলসের পর লেনিন-স্ট্যালিন মাও সেতুঙ সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদকে বিকশিত করেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষও ভারতবর্ষের মাটিতে মার্কসবাদী দল গড়ে তুলতে গিয়ে মার্কসবাদকে বিকশিত করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান জগতের, দর্শন জগতের বুর্জোয়া ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে, আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার, আন্তজার্তিক সাম্যবাদী আন্দোলনের সংকট কোথায়, তার সমাধান কোথায়, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় কীভাবে কেন ঘটল — এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনকে আক্রমণ করছে, এ আক্রমণ স্ট্যালিন-কে নয়, এই আক্রমণ সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মার্কসবাদের বিরুদ্ধে। সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে কি কি কারণে সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হল এবং কিভাবে আগামী দিনে এই বিপদের হাত থেকে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করা যায় সেই পথনির্দেশও করেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার সে ক্ষেত্রেও পথনির্দেশ করে গেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ সর্বহারা সংস্কৃতি কাকে বলে, ধর্মীয় সংস্কৃতি, মানবতাবাদী সংস্কৃতি থেকে পৃথক কমিউনিস্ট সংস্কৃতি কাকে বলে, এটাও সঠিকভাবে দেখিয়ে গেছেন। এবং ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যও তিনি দেখিয়েছেন — এগুলো হচ্ছে আন্তজাতিক ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের অবদান। আর ভারতবর্ষের বুকে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করার কাজটি তিনি করেছেন। আরেকটা দিকও তিনি দেখিয়েছেন। একটা সঠিক মার্কসবাদী দল গড়ে তুলতে হলে কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনে এই পথনির্দেশও তিনি দিয়েছেন। লেনিনের পথকে আরও উন্নত, আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এই অর্থে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা আজকের যুগে আমাদের পথনির্দেশক হিসাবে আমরা গণ্য করে থাকি।

বিজেপি কংগ্রেসের পথেই ফ্যাসিবাদকে জোরদার করছে
ভারতবর্ষে এখন তীব্র লড়াই করতে হচ্ছে — দীর্ঘদিন আমরা লড়াই করে এসেছি, লড়াই করে যাচ্ছি, ভারতবর্ষের যে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উন্নীত, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করছে — তার বিরুদ্ধে। আবার ভারতবর্ষের সংশোধনবাদী পার্টি সিপিআই, সিপিএম-এর সাথে আদর্শগত সংগ্রামও আমাদের চলছে। দীর্ঘদিন কংগ্রেসের নেতৃত্বে পুঁজিবাদ সংহত হচ্ছিল এবং কংগ্রেস সরকার পুঁজিবাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছিল। সম্প্রতি বিজেপি পার্টি ক্ষমতায় এসেছে পুঁজিবাদের নতুন পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে। পুঁজিপতিরা বহুদলীয় গণতন্ত্র বললেও আজকের দিনে একচেটিয়া পুঁজির যুগে বাস্তবে দ্বি-দলীয় গণতন্ত্রেরই চর্চা করে। ইউরোপে আমেরিকায় সব জায়গায়। ভারতবর্ষেও তাই। অন্যান্য কিছু ছোট ছোট পার্টি আছে এ পর্যন্তই — এই দুটি পার্টিকে কেন্দ্র করে যারা পরিষদীয় রাজনীতি, ভোটের রাজনীতি করে, তারা এদেরকে ভিত্তি করেই চলে।

আপনারা অনেকেই জানেন না, সিপিএম একসময় ’৭৭ সালে জনসংঘের সাথে হাত মিলিয়েছিল, যে জনসংঘ আর এস এস থেকে বিজেপির অভ্যুথান ঘটল। আজকের এই বিজেপির সাথেও আটের দশকে সিপিএম একত্রে হাত মিলিয়ে ভি. পি. সিং সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতে যদি শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন থাকতো, বিজেপি এই জায়গায় আসতে পারতো না এটা আমরা মনে করি। এবং কংগ্রেস কোনোদিন যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করে নাই। সেক্যুলার হিউম্যানিজম বলতে বোঝায় যে ধর্ম ব্যক্তির বিশেষ বিষয় হিসাবে থাকবে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা এসব প্রশ্নে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না। এটাই ছিল নবজাগরণের ঘোষণা। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঘোষণা। ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস কোনওদিনই একথা বলে নাই। কংগ্রেস মূলত সর্বধর্ম সমন্বয়ের নামে হিন্দুধর্মের প্রাধান্য এবং উচ্চবর্ণ হিন্দুর প্রাধান্যেরই চর্চা করে গেছে। যার ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ই ধর্মভিত্তিক জাতভিত্তিক এই সমস্ত বিভেদ ছিল। এবং তার পরিণতি কি হয়েছে ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে আমরা সকলেই জানি। তার ওপর কংগ্রেসও বহু সময় সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়েছে। ভোটের স্বার্থে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দমন করার জন্য। আর বিজেপি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল। বিজেপির শক্তির অভ্যুথান ঘটালো ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, উগ্র হিন্দুত্বের স্লোগান তুলে। আমাদের দল সে সময় বলেছিল, তোমরা যদি যথার্থ হিন্দু হয়ে থাক, তাহলে বিবেকানন্দ হিন্দু ছিল না, তোমরা তো তাঁকে হিন্দুই মনে কর। চৈতন্য হিন্দু ধর্মের একজন শক্তিশালী প্রবর্তক ছিলেন, রামকৃষ্ণ ছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন। ভারতের হিন্দুরা এঁদের মানে। প্রায় অবতার হিসেবেই মনে করে। কিন্তু চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ তো কোনদিন বলেন নি যে, রামের জন্মভূমি বাবরি মসজিদ ধ্বংস কর। তাহলে কি তাঁরা কাপুরুষ ছিল? তাঁরা যদি হিন্দু হয়ে থাকে তাহলে তোমরা হিন্দু নও। তোমরা যদি হিন্দু হয়ে থাক তাহলে তাঁরা হিন্দু ছিলেন না। এ প্রশ্ন আমাদের দল তুলেছে। যে প্রশ্নের উত্তর বিজেপি, আরএসএস আজও দিতে পারে নি। আমাদের দল বলেছে, বিবেকানন্দের উক্তি পড়ে আমরা বলেছি মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে, বিবেকানন্দ বলেছেন, আমি কৃষ্ণকে যেমন সম্মান করি, হযরত মুহাম্মদকেও তেমনি সম্মান করি। দু’জনই মহাপুরুষ। বিবেকানন্দ বলছেন, আমার যদি বিবাহিত জীবন থাকতো, আমি আমার সন্তানকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা দিতাম না। আমার সন্তান খ্রিস্টান হতে পারে, আমার স্ত্রী বৌদ্ধ হতে পারে, আমি মুসলমান হতে পারি, কি তাতে? বিবেকানন্দ বলছেন, যে আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যে দিন কোরান, বেদ, বাইবেল মিলে একটা ধর্ম হবে। এই বিবেকানন্দ হিন্দু ছিলেন? এই প্রশ্নগুলোকে আমরা তুলেছি। যার কোনও উত্তর তারা দিতে পারে নি। বিজেপি কংগ্রেসের পথেই ফ্যাসিবাদকে আরো জোরদার করছে।

এই কয়েকদিন আগে বিজেপি যা সম্প্রচার করছে শুনলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন। ওরা বলছে, ইতিহাস পড়ানোর কোনো দরকার নেই, রামায়ণ-মহাভারতই ইতিহাস। রামায়ণ-মহাভারত পড়লে ইতিহাস জানা যাবে। আর কোন ইতিহাস পড়ার দরকার নেই। বিজেপি বলছে, বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কার বেদ-বেদান্তের মধ্যে আছে। মানে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, প্ল্যাংক, হাইজেনবার্গ সবই বেদের মধ্যে আছে। আমার মনে পড়ে বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহার কথা। ড. মেঘনাদ সাহার নাম আপনার জানেন, তাঁর জন্ম এই বাংলায়। তিনি যখন বৈজ্ঞানিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন, একটু নাম টাম হয়েছে সেই সময় তাঁর বাবার একজন বন্ধু ঢাকাতে বড় উকিল ছিলেন, তিনি মেঘনাদ সাহাকে ডেকে আনলেন আদর করে। বললেন, তোমার খুব নাম শুনছি, তুমি কি আবিষ্কার করেছো? মেঘনাদ সাহা খুব উৎসাহের সাথে ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন। পিতৃবন্ধু হাই তুলতে শুরু করেছে একের পর এক। সব শোনার পর বললেন, তুমি যা বলছ সবই বেদে আছে। মেঘনাদ সাহা বলল, কোন বেদে আছে? তখন তিনি উত্তর দিলেন, আমি জানি না কিন্তু আছে। মেঘনাদ সাহার একটা প্রবন্ধ আছে ‘সবই ব্যাদে আছে’। বিদ্যাসাগর অনেক আগেই বলেছিলেন, বেদান্ত ভ্রান্ত, সাংখ্য ভ্রান্ত। এগুলি চর্চার দ্বারা আধুনিক শিক্ষিত যুবক তৈরি হতে পারে না। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, স্কুলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক দর্শন এগুলি পড়ানো দরকার অন্ধতা থেকে মুুক্ত করার জন্য। বিদ্যাসাগরকে ডেকেছেন রামকৃষ্ণ, তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাননি। তিনি এই সব বিশ্বাস করতেন না। ধর্ম বিশ্বাস করতেন না। এসব চর্চা এই দেশে একদিন হয়েছিল। সেই যুক্তিবাদী মনন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধ্বংস করার জন্য আজকে বিজেপি গোটা ভারতবর্ষের মননকে অতীত যুগে, মান্ধাতার যুগে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বালাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা ছড়াচ্ছে।

সাম্প্রদায়িকতা রুখতে আদর্শগত সংগ্রামের সাথে চাই শ্রেণী ও গণআন্দোলন
এই বর্ধমানে ঘটনা ঘটল — একটা বিস্ফোরণ হল তা নিয়ে কী কা-! আমরা কি তাহলে বলব যে, যে বাংলা পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য লড়াই করল, সে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ এখন অনুপ্রবেশকারী হয়ে পশ্চিম বাংলায় ঢুকছে? সেটাকে এখন আরেকটা পাকিস্তান করবে এই জন্যে? আমরা বললাম, কেনও একটা মাদ্রাসায় বোমা যদি পেয়েও থাকো তাহলে কি বলা যাবে সব মাদ্রাসায় বোমা আছে? শোভারাম বলে এক হিন্দু সন্ন্যাসী তার আশ্রমে নারী নির্যাতন করে, ব্যাভিচার করে ধরা পড়ল, এখন কারাগারে। আমরা বললাম, তাহলে বল সমস্ত হিন্দু আশ্রমে ব্যাভিচার চলছে। এই আজকে আপনাদের দেশে এক কাগজে পেলাম, হরিয়ানাতে রামপাল বলে এক সন্ন্যাসীকে এ্যারেস্ট করতে গেছে, সেই আশ্রম থেকে বোমা মেরেছে। তাহলে বলতে সমস্যা কী সমস্ত আশ্রমে বোমা চলছে? আসলে এরা একটা তীব্র সংখ্যালঘু বিদ্বেষ তৈরি করে উগ্র হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তুলছে ভারতবর্ষে। এটা একটা ভয়ংকর বিপদ। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হচ্ছে তীব্রভাবে। সম্প্রতি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক আমার কাছে এসেছিল আলোচনা করার জন্য। আমি বললাম শুধু কনভেনশন করে কিছু হবে না। এই যে বিজেপি, ভাবগত ক্ষেত্রে চিন্তাগত ক্ষেত্রে যে উগ্র ঐতিহ্যবাদ প্রচার করছে, সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে — এর বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম দরকার। আর অন্যদিকে শ্রমিক কৃষক জনগণকে নিয়ে মিলিট্যান্ট ক্লাস এন্ড মাস স্ট্রাগল গড়ে তোলা দরকার। একটা মিছিল করে, একটা কনভেনশন করে কী হবে? মানুষকে জাগাতে হবে। সংঘবদ্ধ করতে হবে।

ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য আন্দোলনের পাশে আছি
আরেকটা কথা আমি আপনাদের বলতে চাই, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিল সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে কমরেড শিবদাস ঘোষ-ই প্রথম মার্কসবাদী চিন্তানায়ক যিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে আতœপ্রকাশ করেছে। পুরনো অবিভক্ত বাংলার সাথে তার সম্পর্ক নাই। ভাষা সংস্কৃতির মিল যাই থাকুক, একটা আলাদা অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, জাতিগত সত্তা নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে তিনি একথা বলেছিলেন। আরেকটা কথাও তিনি বলেছিলেন ওয়ার্নিং হিসেবে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য এসেছে, কিন্তু এই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে কাজ করছে ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খা। বাংলাদেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও সতর্ক করেছিলেন, ভারতবর্ষের জনগণকেও সচেতন করেছিলেন, যে ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদ যাতে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার না করতে পারে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ নেপাল শ্রীলংকা পাকিস্তানেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এখানে তো বটেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি আরব ওয়ার্ল্ডে, আফ্রিকাতেও সে তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আমেরিকার সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করছে। এই জলবণ্টন নিয়ে সমস্যা, সীমান্ত নিয়ে সমস্যা, অন্যান্য সমস্যা — এগুলো সমস্তই আধিপত্যবাদের সমস্যা। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মহান চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে আমাদের দল লড়াই করছে ভারতবর্ষের বুকে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এখানকার জনগণের যা কিছু ন্যায্য দাবি আমরা সবসময়ই কন্ঠস্বর তুলেছি, এবং আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করে গেছি।

মানবসভ্যতা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছে
ফলে আমি যে কথা বলতে চাই, যা দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম, একদিকে গোটা বিশ্বে বেকারত্ব বাড়–ক, অনাহারে মৃত্যু ঘটুক, মনুষ্যত্ব ধ্বংস হোক, স্নেহ প্রেম প্রীতি মায়া ভালবাসা ধূলায় লুণ্ঠিত হোক, নারীর ইজ্জত ধূলায় লুণ্ঠিত হোক, অসংখ্য শিশু মৃত্যু ঘটুক এবং এগুলো চলতে থাকুক, বাড়তে থাকুক — নির্বাক দর্শক হয়ে আমরা দেখব? আর অন্যদিকে মানবতা মুক্তি চাইছে, মানব সভ্যতা মুক্তি চাইছে। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সে কাঁদছে, ব্যথা বেদনায় ছটফট করছে। সে মুক্তি একমাত্র দিতে পারে মাকর্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা। এই বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির মধ্য দিয়ে একটা শক্তিশালী মার্কসবাদী আন্দোলন আপনারা এখানে গড়ে তুলেছেন, একে আমরা অভিনন্দন জানাই। আপনাদের সাথে আমাদের সর্বহারা আন্তর্জাতিকতা ভিত্তিক মৈত্রি-বন্ধন অটুট থাকবে। এবং আগামী দিনে গোটা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এবং সমস্ত রকম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালাব, এই কথা বলেই আমি এখানে শেষ করছি।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
আমাদের উভয় দলের মৈত্রী জিন্দাবাদ!
মহান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ!
আপনাদের সকলকে লাল সালাম জানাই।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments