Wednesday, November 20, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধপোস্টার : জহির রায়হান

পোস্টার : জহির রায়হান

Zahir Raihyn [dropcap]দূ[/dropcap]র থেকেই দেখলেন আমজাদ সাহেব। লাল কালো হরফে লেখা অক্ষরগুলো সকালের সোনালি রোদে কেমন চিকচিক করছে। সাম্র্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। বাজারে এক মেছুনীর সাথে ঝগড়া করে মেজাজটা এমনিতেই বিগড়ে ছিল আমজাদ সাহেবের। তার ওপর সদ্য-চুনকাম-করা বাড়ির দেয়ালে এহেন পোস্টার দেখে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেকে ডাকলেন। আনু-উ-উ।

আনুর দেখা নেই। বাবার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে লাটিম আর মার্বেল হাতে বেরিয়ে পড়েছে সে সেই ভোরে। কানু এসে বলল, কি বাবা?

তোকে কে ডেকেছে। আনু কোথায়? চোখ রাঙিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন আমজাদ সাহেব। এত কষ্ট করে, বাড়িওয়ালার হাত-পা ধরে হোয়াইটওয়াশ করালাম। দেয়ালে লিখে দিলাম বিজ্ঞাপন লাগিও না। তবুওÑতবুও দেখ পাজিগুলোর যদি একটু কাণ্ড জ্ঞান থাকত। যতসব নচ্ছার কোথাকার।

আমায় গাল দিচ্ছ কেন। ওগুলো কি আমি লাগিয়েছি নাকি? মুখ ভার করল কানু

ছেলের কথায় আরো ক্রুদ্ধ হলেন আমজাদ সাহেব। শুয়ার কোথাকার। তোর কথা কে বলছে? বলছিলাম, যে বাঁদরগুলো এসব পোস্টার লাগায় তাদের ধরতে পারিস না?  ধরে জুতো পেটা করে দিতে পারিস না তাদের। থাকিস কোথায়? রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন আমজাদ সাহেব।

পাশের বাড়ির আফজাল সাহেব বাইরে চিৎকার শুনেই বোধ হয় বেরিয়েছিলেন। বললেন, কী ব্যাপার আমজাদ সাহেব। এই সকালবেলা-।

আর বলবেন না সাহেব, সাধে কী আর চেঁচাচ্ছি। এসেই দেখুন-না একবার। বলে আঙুল দিয়ে দেয়ালের পোস্টারটাকে দেখালেন আমজাদ সাহেব।

ও। এ আর কী। ও তো সব জায়গায় লাগিয়েছে ওরা। শহরটাকে একেবারে ছেয়ে ফেলেছে সাহেব। তারিফ করতে হয় এই ছেলেগুলোর ।

আঁ! আপনি বলছেন কী? রীতিমতো অবাক হলেন আমজাদ সাহেব। আপনি  ওই ছেলেগুলোর তারিফ করছেন?

তারিফ করব না? আফজাল সাহেব বললেন। দেশের মধ্যে সাচ্চা কেউ যদি থেকে থাকে তো ওরাই আছে। ওরাই লড়ছে দেশের স্বার্থের জন্য।

আর মন্ত্রীরা বুঝি কিছু করছে না আপনি বলতে চান?

করছে না কে বলছে। আলবত করছে। আফজাল সাহেব উত্তর করলেন। খবরের কাগজে দেখেন না। আজ এখানে টিপার্টি, কাল ওখানে ডিনারের আয়োজন। পরশু নিউইয়র্ক যাত্রা। করছে না কে বলছে। অনেক করছে ওরা।

তা তো আপনারা বলবেনই। একচোখা লোক কিনা, তাই একদিকটাই দেখেন শুধু। বলে আর সেখানে দাঁড়ালেন না আমজাদ সাহেব। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন তিনি। হালিমা বিবি তৈরি হয়েই ছিলেন বোধ হয়। ভেতরে ঢুকতেই মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হল্লা করবার আর সময় পেলে না? এদিকে অফিসের সময় হয়ে এল, একটু পরেই তো ভাত ভাত করে বাড়ি ফাটাবে।

স্ত্রীর সাথে এ-সময়ে ঝগড়া করার মোটেই ইচ্ছে ছিলনা  আমজাদ সাহেবের। তবুও কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ঘরে বসে হুকুম সবাই দিতে পারে। কাজের বেলায় কেউ নয়।

থলে থেকে তরকারি বের করতে গিয়ে হঠাৎ বাধা পেলেন হালিমা বিবি। কী বললে, কাজ করি না আমি,না? বলি এই ভোর-সকালে উঠে বিছানাপত্তর গুটানো থেকে শুরু করে, ঘর ঝাড়– দেয়া, বাসনপত্তর মাজা, চুলোয় আঁচ দেয়া এগুলি কি তুমি করেছ না আমি। কে করেছে শুনি?

খুব একটা খারাপ কথা মুখে এসেছিল আমজাদ সাহেবের। সামলে নিলেন অতিকষ্টে। বয়স্ক ছেলেমেয়েদের সামনে রোজ রোজ এ-ধরনের ঝগড়াঝাটি সত্যি কী বিশ্রী ব্যাপার। স্ত্রীর দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করে গামছা আর লুঙি হাতে কলগোড়ায় চলে গেলেন তিনি।

স্ত্রীর আক্ষেপ-ভরা খেদোক্তি সেখানেও ধাওয়া করল তাকে। কাজ করেও কোনো নাম নেই। কোনো স্বীকৃতি নেই! বারো বছর বয়সে মাথায় ঘোমটা চড়িয়ে মিনসের ঘর করতে এসেছি। সেই থেকে কাজ আর কাজ। খেটে খেটে শরীর আমার হাড্ডিসার হয়েছে। তবুও নাম নেই, তবু-। বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করলেন হালিমা বিবি। খোদা আমার মরণ হয় না কেন। আজরাইলের কি চোখ কানা হয়েছে, আমায় দেখে না?

চটপট গোছলটা সেরে একটু পরেই ফিরে এলেন আমজাদ সাহেব। তখনও নিজের অদৃষ্টকে একটানা ধিক্কার দিচ্ছেন হালিমা বিবি। একটা চাকর রাখেনি লোকটা। আমায় বাঁদীর মতো খাটিয়ে নিয়েছে। একটা ভালো কাপড় কিনে দেয়নি কোনোদিন। ছেঁড়া নেংটি পরে পরে আমি থাকি! তবুও নাম নেই। তবুও -।

আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ রাগে ফেটে পড়লেন আমজাদ সাহেব। চুপ করো বলছি। নইলে এখনি গলা টিপে দেব।

দাও না, দাও। সামনে এগিয়ে এলেন হালিমা বিবি। সরোষদৃষ্টিতে তার দিকে একপলক তাকালেন আমজাদ সাহেব। তারপর,আলনা থেকে জামাটা নামিয়ে নিয়ে সোজা রাস্তায় এলেন তিনি । রাস্তায় নেমে কেন যেন আবার পেছনে দেয়ালটার দিকে ফিরে তাকালেন আমজাদ সাহেব।

আর একখানা পোস্টার।

ঠিক আগের পোস্টারটার পাশেই সেঁটে দেওয়া হয়েছে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। বাঁচার মতো মজুরি চাই।

এমুহূর্তে কে যেন একটিন জ¦লন্ত পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে আমজাদ সাহেবের গায়ের ওপর। দপ করে জ্বলে উঠলেন আমজাদ সাহেব। আন-উ-উ।

আনু তখনও ফেরেনি! কানু এসে ভয়ে ভয়ে বলল, কি বাবা?

কি বাবা-আ-আ। তীব্র দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করলেন তিনি। তুই কেন আনু কোথায়।

কানু বানিয়ে বলল, ও স্কুলে গেছে।

ও স্কুলে গেছে, আর তুমি ঘরে বসে বসে করছ কী। আঁ? ছেলেকে ধমকে উঠলেন আমজাদ সাহেব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার দেখছিস কী, যা-না একটা বাশঁ জোগাড় করে এনে নিচু থেকে গুতিয়ে পোস্টার দুটো ফেলে দে মাটিতে। আর শোন্, সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি তুই, খবরদার কেউ যেন পোস্টার-তোস্টার না লাগাতে পারে হাঁ। বুঝলি তো।

জি হাঁ।

হাঁ। যা বললুম মনে থাকে যেন। বলে অফিসমুখো হলেন আমজাদ সাহেব।

পেছন থেকে  মেজো মেয়ে টুনি ডেকে বলল, বাবা ভাত খেয়ে যাও! মা ভাত খেয়ে যেতে বলছে। মেয়ের ডাকে একবার ফিরে তাকালেও,থামলেন না আমজাদ সাহেব। আগের মতোই চলতে থাকলেন। না খেয়েই আজ অফিসে যাবেন তিনি। শুধু আজ বলে নয়। বছরে বারো মাসে তিন মাস না-খেয়েই অফিস করেন আমজাদ সাহেব। কোনো-কোনোদিন পেটের অবস্থা বেশি কাহিল হয়ে পড়লে, মোড়ে বিহারীদের সস্তা হোটেলটায় ঢুকে গোটা দুয়েক ডালপুরী আর কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে অফিসে যান তিনি। মাসের প্রথম হলে, অফিসের পাশে দিল্লি রেস্টুরেন্টটায় ঢুকে শিককাবাব আর চাপাতি উদরস্থ করেন। আজ কিন্তু এ-মুখো ও-মুখো কোনো মুখোই হলেন না আমজাদ সাহেব। অনেকটা দৌড়াতে দৌড়াতে অফিসমুখে ছুটলেন তিনি। নতুন সাহেব ভীষণ কড়া। পাঁচ মিনিট লেট হলে ডাহা পাঁচ টাকা জরিমানা করে বসে থাকে।

শা’র সাহেবের গুষ্ঠীর শ্রাদ্ধ হত। কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে তরতর করে উপরে উঠে গেলেন আমজাদ সাহেব। সরু বারান্দাটা  পার হতেই সাহেবের সাথে একেবারে মুখোমুখি।

এই যে আমজাদ সাহেব। আজও আপনি লেট। পনের মিনিট। পনের মিনিট নয় স্যার। পাঁচ মিনিট । কথাটা ঠোঁটের কাছে এসেও কেন যেন থেকে গেল। মুখ কাঁচুমাচু করে বার কয়েক হাত কচলালেন তিনি। তীক্ষèদৃষ্টিতে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নতুন জুতোর মচমচ শব্দ তুলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন সাহেব তাঁর চেম্বারের দিকে। ভেতরে ঢুকে সবার দিকে একপলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের আদি অকৃত্রিম চেয়ারটিতে এসে বসলেন আমজাদ সাহেব।

এল.ডি ক্লার্ক হাসমত মিয়া, বারকয়েক তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি আমজাদ সাহেব, চোখ দুটো এত লাল কেন। ভাবীর সাথে ঝগড়া করে এসেছেন বুঝি?

কথা শুনে দাঁতে জিভ কাটলেন আমজাদ সাহেব। কী-যে বলেন, খানদানি পরিবারে বৌয়ের সাথে ঝগড়া? ছ্যা-ছ্যা। জানেন,আমার নানা ছিলেন খাঁটি শেখ। আর দাদা-।

আরে না না, তা কি আর জানিনে। জানি। তবে এমনি একটু ঠাট্টা করছিলুম আপনার সাথে। বললেন হাসমত মিয়া। মনে মনে বড় গর্ববোধ করলেন আমজাদ সাহেব। বললেন, ঠাট্টা করে যে বলছেন তা আমি বুঝেছি। তবে কিনা, চোখ দুটো লাল হবার পেছনেও কারণ আছে একটা। কারণটা বলতে গিয়ে , দেয়ালে পোস্টার লাগানো আর তা দেখে তাঁর ভীষণ চটে যাওয়ার ইতিবৃত্তটাই শোনালেন আমজাদ সাহেব।

হাসমত মিয়া বললেন, এতে রাগ করবার কী আছে?

আলবত আছে। আমজাদ সাহেব মাথা ঝাঁকালেন। কতকগুলো বখাটে ছোকড়া, বুঝলেন হাসমত সাহেব। কাজকর্ম কিছুই নেই। সারাদিন শুধু এই করেই বেড়ায়। আসলে কী জানেন-এরা হচ্ছে দেশের শত্রু।মানে এরা বিদেশের দালাল। কেন আপনি পরশু প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনেন নি? আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন আমজাদ সাহেব।

হাসমত মিয়া বললেন, চুপ, সাহেব আসছে। সাহেব ঠিক এলেন না। দরজা দিয়ে একবার উঁকি মেরে আবার চলে গেলেন বাইরে। কেন যেন আজ অফিসের কাজে মন বসছিল না আমজাদ সাহেবের। এটা ওটা অনেক কিছু ভাবছিলেন  তিনি। কালু মুদির পাওনা,দুধওয়ালার বাকি, মেয়ের বিয়ে-অনেক চিন্তাই মাথার ভেতর গিজগিজ করছিল তাঁর। পাশের সিটে বসা হাসমত মিয়া খসখস শব্দে কলম চালাচ্ছিলেন আপন মনে।

সামনের সারিতে বসা রমেশবাবু তার নস্যির ডিবে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন পকেটময়, আর বিরক্তিতে ভ্রু বাঁকাচ্ছিলেন বারবার। সদ্য-বিয়ে-করা ডেসপাচার মুলকুত মিয়া কাজের ফাঁকে ফিসফিসিয়ে নতুন বৌ-এর গল্প করছিলেন পাশের সিটে বসা আকবর আলির সাথে। সবার দিকে একপলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফাইলের ভেতর ডুব দিলেন আমজাদ সাহেব। মাথার উপরে বৈদ্যুতিক পাখাটা একটানা ঘুরছিল বনবন শব্দে। দেয়াল ঘড়িতে তখন বোধ হয় বেলা একটা। হঠাৎ ওপাশের টেবিল থেকে ক্যাশিয়ার হুরমত আলি চাপাস্বরে বললেন, শুনেছেন আমজাদ সাহেব?

কী।

অফিসে নাকি ছাঁটাই হবে।

ছাঁটাই? তড়িত-আহত হওয়ার মতো আচমকা উঠলেন আমজাদ সাহেব।

হাঁ, ছাঁটাই। আস্তে বললেন হুরমত আলি। খবরটা একমুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল অফিসের আনাচে-কানাচে। চলন্ত কলমগুলো শ্লথ হল; থেমে পড়ল; খসে পড়ল অনেকের হাত থেকে। ফ্যাকাশে দৃষ্টি তুলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল সবাই।

ছাঁটাই? সেকি? কাঁপা ঠোঁটে বিড়বিড় করে উঠলেন হাসমত মিয়া।

ও গড সেইভ মি। সেইভ মি গড। চাপা আর্তনাদ করে উঠল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টাইপিস্টটা। আমজাদ সাহেব নিষ্কম্প। নিশ্চুপ। একটা কথাও মুখ দিয়ে বেরুচ্ছিল না তাঁর। মাথার ভেতর শুধু গিজগিজ করছিল কালু মুদির পাওনা, দুধওয়ালার বাকি, মেয়ের বিয়ে-। কপালের শিরাগুলো টনটন করছিল তাঁর।

সব অফিসেই ছাঁটাই হচ্ছে সাহেব। নিচ্ছে না, শুধু বের করছে। ভাঙা-ভাঙা গলায় বললেন হুরমত আলি। কপালটা দুহাতে চেপে ধরে এল.ডি ক্লার্ক রমেশবাবু বললেন, কাল সেক্রেটারিয়েট থেকেও নাকি সাতজনকে ছাঁটাই করেছে শুনলাম।

ও গড সেইভ মি। সেইভ মি গড। আর একবার আর্তনাদ করে উঠল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টাইপিস্টটা। ড্রাফটসম্যান আকবর আলি এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। হঠাৎ টেবিলের ওপর একটা প্রচণ্ড ঘুসি মেরে লাফিয়ে উঠলেন  তিনি। ছাঁটাই করবে মানে-ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি?

হ্যাঁ ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি? এটা মগের মুল্লুক নয়। তাঁকে সমর্থন করে বললেন মুলকুত মিয়া। আমাদের বৌ-পরিবার নেই? ভাই- বোন নেই? তারা চলবে কেমন করে? ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি যে ছাঁটাই করে দেবে?

আহ্ মুলকুত সাহেব! আস্তে আস্তে; এত চিৎকার করছেন কেন? চাপাস্বরে তাকে তিরস্কার করলেন বুড়ো ক্যাশিয়ার হুরমত আলি। আমজাদ সাহেব তখনও নিশ্চুপ নিষ্কম্প।বিকেলে,অফিস ছুটির মিনিট কয়েক আগেই টাইপ-করা নামগুলো টাঙানো দেখা গেল বারান্দায় নোটিশবোর্ডের ওপর। অনেকগুলো নাম। একটা। দুটো। তিনটা। তিনটে নামের নিচের নামটার দিকে চোখ পড়তেই মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বারান্দায় বসে পড়লেন আমজাদ সাহেব। খোদা, খোদা এ কী করলে!

গড। ও গড। গড।

ভগবান! ছেলেপিলেগুলো যে না-খেয়ে মরবে ভগবান।

অনেকটা টলতে টলতেই অফিস ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেন আমজাদ সাহেব। একটা নিরালা পার্কে ঢুকে আধভাঙা বেঞ্চের ওপর ঝুপ করে বসে পড়লেন তিনি। নিরালা একটু চিন্তা করবেন। কিন্তু চিন্তা করতে বসে বহুমুখী চিন্তার ধাক্কায় অল্পক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠলেন আমজাদ সাহেব। দূরে একটা হলদে বাড়ির জানালায় একটা মেয়ে পাশের বাড়ির ছেলের সাথে ইশারায় কথা বলছে। সেদিকে কিছুক্ষণ অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। চিঠির আদান-প্রদান হল এজানালা থেকে ওজানালায়। দৃষ্টি সেদিকে থাকলেও, ভাবছেন তিনি অন্য কিছু। চাকরিটা তাহলে সত্যি সত্যিই গেল।

আরে আমজাদ যে। কী ব্যাপার, এখানে কী করছ? পেছনে পরিচিত কন্ঠস্বরে ফিরে তাকালেন আমজাদ সাহেব।

আবিদ সাহেব দাঁড়িয়ে। এককালের সহপাঠী; বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে কাজ করেন।

ম্লান হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন আমজাদ সাহেব। কি হে, কেমন আছো ভালো তো? ভালো আর কোথায়। ঘরে বৌয়ের অসুখ।

অসুখ?

হা সেই পুরনো রোগটাই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

ডাক্তার দেখাও নি?

ডাক্তার তো বলেছে রক্ত বলতে কিছু নেই শরীরে। বলে একটু থামলেন আবিদ সাহেব। তা ভাই একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করে দিতে পারো? বড় কষ্টে আছি।

কেন তুমি চাকরি করতে না। সেটা কী হল? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমজাদ সাহেব।

সে তো গত পরশুই খতম। বলে ম্লান হাসলেন আবিদ সাহেব।

সাতজনকে ছাঁটাই করেছে আমাদের ওখান থেকে। শুনোনি?

ছাঁটাই! ছাঁটাই! ছাঁটাই!

উহ্ কী হবে এই পোড়া পৃথিবীটার? কপালের ফুলে-ওঠা শিরা দুটো টিপে ধরে উঠে ধারালেন আমজাদ সাহেব। বাসার কাছে এসে পৌঁছতে চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল তাঁর। হাত-পা সমেত গোটা শরীরটা আর-একবার কেঁপে উঠল, রাগে-ক্ষোভে। সদ্য-চুনকাম করা তার একতলা দালানটার দিকে আগুনঝরা দৃষ্টিতে আর-একবার তাকালেন আমজাদ সাহেব। ময়লা পায়জামা আর ছেঁড়া শার্ট-পরা কুড়ি-বাইশ বছরের রোগা ছেলে দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছে। ধড়ে প্রাণ রাখব না শালার। চাপা রোষে গর্জে উঠলেন তিনি। শালার গুষ্ঠী শ্রাদ্ধ করব আজ। হাত দুটো নিশপিশ করছিল আমজাদ সাহেবের। এতদিন পর হাতের মুঠোয় পেয়েছেন ছেলেটাকে, যতসব বখাটে ছোকড়া-শা’র আজ আর আস্ত রাখব না, পিষে ফেলব পায়ের তলায়। পোস্টারটা দেয়ালে সেঁটে দিয়ে ছেলেটা ধীরে ধীরে ততক্ষণে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। হিংস্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন আমজাদ সাহেব। হঠাৎ পোস্টারটার দিকে নজর পড়তেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। পুরনো খবরের কাগজের ওপর লাল কালিতে লেখা গোটা গোটা অক্ষর। ছাঁটাই করা চলবে না।

 অনুশীলন : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments