Tuesday, December 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ মার্চ ২০১৭প্রশ্নপত্র ফাঁস — অবশেষে স্বীকার করলো শিক্ষামন্ত্রী !

প্রশ্নপত্র ফাঁস — অবশেষে স্বীকার করলো শিক্ষামন্ত্রী !

প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে ছাত্র ফ্রন্টের বিক্ষোভ
প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিক্ষোভ

পরীক্ষার আগের রাত। সন্তানকে নিয়ে পিতা-মাতা অপেক্ষা করছেন। কখন আসবে প্রতীক্ষিত বস্তু? কিছুক্ষণ পর পর ফেসবুকের নির্দিষ্ট কিছু পেজ কিংবা হোয়াটস্ আপে ঘোরাঘুরি। অবশেষে আকাঙ্খিত প্রশ্নপত্রটি পাওয়া গেল। সবাই ভীষণ খুশি। এখন উত্তর বের করতে হবে দ্রুত। গৃহশিক্ষককে ডেকে এনে বা যেভাবেই হোক উত্তর বের করে মুখস্ত করানো হলো। পরদিন পরীক্ষাহলে গিয়ে দেখা গেলো সব কমন পড়েছে। ভালো পরীক্ষা দিয়ে সন্তান খুশি, বাবা-মা আরও বেশি খুশি।

না, এটা কোনো কষ্ট-কল্পনা নয়। আজকের বাংলাদেশে এসএসসি, এইচএসসি এমনকি জেএসসি-পিইসিতেও অনেক শিক্ষার্থীর জন্য এটা এখন পরিচিত ব্যাপার। চলমান এসএসসি পরীক্ষাতেও বাংলা, ইংরেজি, গণিতে ঘটেছে এমন ঘটনা। পরীক্ষার সময় এখন আর কষ্ট করে, রাত-দিন জেগে পড়াশুনা করতে হয়না বরং কিছুটা অর্থের কষ্ট স্বীকার করলেই সারা বছর কিছু না পড়েও পরীক্ষায় ভালো করা যায়, এমনকি এ প্লাসও পাওয়া যায়! সফল হওয়া এইসব শিক্ষার্থীরা ভি চিহ্ন দেখায়, সাংবাদিকরা ছবি তুলে, ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। অনেক শিক্ষার্থী আছে হয়তো তারা কষ্ট করেই এই ফলাফল অর্জন করে, কিন্তু তাদের কষ্ট হারিয়ে যায় অনৈতিক এই সমাজে। তাই পাশের পর বিজয়োৎসব এখন আর কাউকে স্পর্শ করছে না। এই বিজয় যে আসলে কার বিজয় তা আজ বিবেকবান প্রতিটি মানুষকেই ভাবাচ্ছে। এমন একটা আদর্শহীন-নীতিহীন-ভবিষ্যৎহীন-ক্রিমিনাল প্রজন্ম কার প্রয়োজনে তৈরি হচ্ছে?
প্রতিবছর যে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে তার দায় আসলে কার? ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা, কিশোর-কিশোরীরা প্রশ্ন পাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতা তাদের অনেকেরই নেই। সত্যিকার অর্থে, তারা এসব ঘটনার শিকারমাত্র। কিন্তু যে বাবা-মা-শিক্ষক তাদের হাতে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, তাদের দায়িত্বশীলতাকে আমরা কীভাবে দেখব? তারা যে নির্লজ্জের মতো ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে ছোটাছুটি করছেন, একটা ভালো রেজাল্টের জন্য সম্ভব সমস্ত ধরনের অন্যায়ের সাথে নিজেদের যুক্ত করছেন, কিংবা কিছু টাকা কামাচ্ছেন, তারা সন্তানের কোন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছেন? অভিভাবক-শিক্ষকদের এমন নৈতিক স্খলনে সন্তানদের কাছে কি তাদের শ্রদ্ধার আসনটি থাকছে? তাদের এই অধোগতি কি সন্তানদেরও বিপদগামী হতে শেখাচ্ছে না? একটা শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে মানুষকে অপরাধী করে তুলতে পারে, তা বোধহয় বাংলাদেশে বসবাস না করলে বোঝা যেত না।

এত কিছুর মধ্যেও যারা সততা এবং বিবেকের কারণে এমন নষ্ট পথে হাঁটছে না, সেইসব ছেলে-মেয়ে ও অভিভাবকদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। কেননা তাদের সন্তানদের অনেকেই ভালো ফলাফল করতে পারছে না। আমাদের দেশে ভালো ফলাফল মানে কতটা ভালো শিখেছে তা নয়, কতটা পয়েন্ট সার্টিফিকেটে যুক্ত হয়েছে সেটা। আর সার্টিফিকেট পাওয়াটাই যখন শেষ কথা, অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা যেভাবেই হোক তা পেতে চেষ্টা করে। তাই সততা দেখিয়ে খারাপ ফলাফল মেনে নেয়া অনেকের জন্য বেশ কষ্টের। তাই তো আক্ষেপ করে কেউ কেউ বলে, এদেশে সততার কোনো মূল্য নেই।

সততা-নৈতিকতার মূল্য দেয় না যে রাষ্ট্র, যে সরকার, যে সমাজ; সমস্যার মূল শেকড় আসলে সেখানেই পোতা আছে। এমন সমাজই প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ প্রশ্নফাঁসকারীদের জন্ম দেয়। তাদের লালন-পালন করে, প্রশ্রয় দেয়। যেমন, এবারও যখন প্রশ্নফাঁসের খবর এলো, সরকার যথারীতি অস্বীকার করে নানা আজগুবি ও হাস্যকর কথা বলতে লাগলো। অথচ ফেসবুকে সাধারণ মানুষ দেখিয়ে দিচ্ছিলো কোন কোন পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়েছে। সবাই জানছে প্রশ্নফাঁসের কথা, আগের রাতে প্রশ্নও পেয়ে যাচ্ছে অনেকে। কেবল সরকার বুঝতে পারছে না। তারা অপেক্ষা করছে, কেউ অভিযোগ করলে তারা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনকি এটাও ঘোষণা করেছিল, আসলে ফাঁস হওয়া পত্রগুলো সাজেশন মাত্র। হয়তো কাকতালীয়ভাবে ১/২টা মিলে গেছে। সরকার যখন এভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করে তখন দুটো ব্যাপার বোঝা যায়, এক তারা অপরাধীদের বাঁচিয়ে দিতে চায় এবং অন্যটি তারা নিজেরাও এসব কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত আছে। নাহলে এমন দায়বোধহীন কথা তারা বলতে পারতো না।

প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িয়ে আছে বিশাল শিক্ষাবাণিজ্য। লক্ষ-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল প্রতারক শিক্ষা ব্যবসায়ী। গত ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষায় ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২০০/৫০০ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেসময় যেসব প্রশ্ন বাজারে পাওয়া গেছে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে মূল প্রশ্নপত্রের সাথে হুবহু মিল। পিএসসি, জিএসসি, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাতেও একই ঘটনা প্রতিবছরই ঘটছে।

প্রশ্নফাঁস এখন মহামারী আকার নিয়েছে। শুরু হয়েছে কিন্তু অনেক আগে। সরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৭৯ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ওই সময় থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৮২ বার বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরি ও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ২০১৪ সালের জেএসসি, পিএসসি, এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০১৫ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালেও পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটলো। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। এর মধ্যে পরীক্ষা স্থগিত, বাতিল ও তদন্ত কমিটি হয়েছে মাত্র ৩০টি পরীক্ষায়। এর মধ্যে কিছু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। কিছু রিপোর্টে হোতাদের চিহ্নিত করে ও প্রশ্নফাঁস রোধে বিভিন্ন সুপারিশ করলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। কারও শাস্তিও হয়নি। আবার সারা দেশে আলোচনা শুরু হলে কিছু কোচিং সেন্টারের মালিক ও সাধারণ কিছু ব্যবসায়ীদের ধরে মানুষকে দেখানো হয়, বাস্তবে এরা মূল আসামী নয় ‘মিডলম্যান’ মাত্র। মূল আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এবারও তাই করা হলো। এই যখন অবস্থা তখন বোঝাই যায়, কারা প্রশ্নফাঁসের পথকে অবারিত রাখছে এবং কারা শিক্ষার্থী-অভিভাবক সকলকে অপরাধী বানাচ্ছে।

মহান দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, ছুড়ি দিয়ে কাউকে হত্যা করলে বোঝা যায়। কিন্তু সমাজ যখন তিল তিল করে মানুষের মনুষ্যত্বকে খুন করে, তা হঠাৎ করে বোঝা যায় না। পরীক্ষার নামে প্রহসন করে একটা জাতিকে এভাবে প্রতিনিয়ত খুন করছে। যদিও অনেকেই এর ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না। সরকার তার জনগণকে নির্জীব-কূপমন্ডূক রাখতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক এবং এটা তার প্রয়োজনও। একটা রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী শাসন চালাতে হলে এমন মানুষেরই চাষ দরকার। কিন্তু জনগণও যখন সেই একই তালে চলে তখন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো কঠিন হয়ে পড়ে। আজ দেশের সকল অভিভাবক-শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, সাময়িক ভালো ফলের আশায় আমরা এক সর্বনাশা ভবিষ্যৎকে ডেকে আনছি। বাবা-মারা কি বুঝবেন না- এইভাবে সার্টিফিকেট পেয়ে একজন শিক্ষার্থী সামান্য আত্মবিশ্বাসী নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে না? জ্ঞান-বিদ্যাহীন সার্টিফিকেট সর্বস্ব সন্তানই কি আমাদের কাম্য? এখনই যদি আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক না হই, সামনে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। কেননা এরাই হবে আগামী দিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক বা অন্য কিছু। কাদের হাতে দেশটা যাচ্ছে, একবারও কি ভেবে দেখবেন না?

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments