Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মার্চ ২০১৮প্রশ্নফাঁস আর পরীক্ষার চাপে শৈশব-কৈশোর আজ অন্ধকারে

প্রশ্নফাঁস আর পরীক্ষার চাপে শৈশব-কৈশোর আজ অন্ধকারে

ssf

ক’দিন আগে শেষ হলো এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে থেকেই সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের উদ্যোগে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ চলছিল। পুরাতন ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে কথা হচ্ছিল এক অভিভাবকের সাথে। তাঁর সন্তান এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে দুঃখ করে বললেন, ‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে লজ্জা লাগে, আমার সন্তান এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে’। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ অবস্থায় একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ কষ্ট পাবেন — সেটাই স্বাভাবিক। রাজধানীর একটি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক বললেন, ‘আমাদের খাতায় বেশি করে নম্বর দিতে বলা হয়। শিক্ষক হিসেবে আত্মসম্মানে লাগে।’ হাজার হাজার অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আজ এমন হতাশা আর গ্লানিতে গুমরে কাঁদছেন। সব কান্না চোখে দেখা যায় না। তাদের আর্তনাদ বলে দেয় সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন তারা।

পরীক্ষা মানেই এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস। পরীক্ষা ব্যবস্থাটাই আজ পরিণত হয়েছে একটা প্রহসনে। প্রতিটি পরীক্ষাতে অসীম যন্ত্রণা নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষাকেন্দ্রে যাচ্ছে আর জানছে তাদের প্রশ্নপত্রটি আগেই ফাঁস হয়েছে এবং তা টাকা থাকলেই কিনে নেয়া যাচ্ছে। অবস্থা এখন এমন — ভালো প্রস্তুতি আর পরীক্ষায় ভালো করার উপায় নয়, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়া গেল কিনা এবং তার উত্তর যোগাড় করা গেল কিনা — তাই এখন ভালো ফলাফলের শর্ত। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে একেকটি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। পরীক্ষার সংখ্যাও তাই বাড়ানো হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই সূচনা হয়েছে পাবলিক পরীক্ষার। প্রাণভরে শৈশবটুকু উপভোগ করার আগেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে ‘পিইসি’ নামক পাবলিক পরীক্ষার। একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস অন্যদিকে পরীক্ষার সীমাহীন চাপ- শিশুরা কীভাবে সুস্থ মন নিয়ে বাঁচবে — তা এখন দুশ্চিন্তার ব্যাপার।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ও তার আগের সরকারগুলোর সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যতম বড় সংকট ছিল নকলের মহোৎসব এবং সময়মতো পাঠ্যবই ছাপাতে না পারা। ২০০১ সালে জোট সরকারের সময় নকলের মহোৎসব কিছুটা বন্ধ হলেও বই ছাপা নিয়ে সংকট ছিলই। ২০০৯ সালের পর প্রশ্নফাঁসের দৌরাত্ম্য তীব্র হতে থাকল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর থেকে অন্তত ৮০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি ও প্রশ্নফাঁস করতে গিয়ে ধরা পড়া ৭০টি ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা হলেও কারও সাজা হয়নি। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছে। এবার অনেক কথার পর সরকার ঘোষণা করল — অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে, পরীক্ষা শুরুর সাতদিন আগে থেকে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু অসারের তর্জন গর্জন সার। দেখা গেল পুলিশ প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরার পরিবর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধরেছে। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য যারা করছে তারা আছে নাগালের বাইরেই।

‘আমার ছেলেটাকে প্রতিদিন বিকেলে বলি, বাবা একটু বাইরে যা। খেলাধুলা কর। কিন্তু সন্তান যেতে চায় না। বলে, বাইরে খেলতে গেলে হোমওয়ার্ক করার সময় পাওয়া যাবে না।’ — বলছিলেন মতিঝিল হাই স্কুলে পড়ুয়া এক সন্তানের মা। শিক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে শৈশব, অভিভাবকদের এমন আক্ষেপ অমূলক নয়। তার শিশুটি খেলতে পারে না, প্রাণ খুলে হাসতে পারে না, এমনকি আকাশটা দেখার সময় পর্যন্ত পায় না! ভালো রেজাল্ট করার চিন্তা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেড়ে নিয়েছে শিশুমনের নির্মলতা। কিছু অভিভাবক দুঃখ করে বলেন, তাদের সন্তান মানুষের সাথে এমনকি পরিবারের সদস্যদের সাথেও মিশতে পারে না। ক্লাসে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারে না। এ নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যাবে, প্রবল মানসিক চাপ শিশুদের মননজগতকে বিকল বানিয়ে ফেলছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের দুটি পাবলিক পরীক্ষা চলে আসছিল যুগ যুগ ধরে। বর্তমান সরকারের সময়ে আরও নতুন দুটি পাবলিক পরীক্ষা ‘পিইসি ও জেএসসি’ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের একজন শিক্ষাবিদও ওই দুটি পাবলিক পরীক্ষার পক্ষে মত দেননি। সরকারের একক সিদ্ধান্তে এগুলো চালু করা হয়েছে। পিইসি চালুর সাথে সাথে পাশের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশ। শিক্ষকদের বলা হয়েছে উদারভাবে নম্বর দিতে। সরকারের ‘পাশের হারের’ সুনাম কিনতে নিঃশেষ হয়েছে শিক্ষকের মর্যাদাবোধ।

পিইসি পরীক্ষা চালু হওয়ায় অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির বদলে আর্থিক অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা আর হয়রানি বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে এখনও কোনো কোনো অভিভাবক, যদিও সংখ্যায় তারা খুব সামান্য, বিভ্রান্তি থেকে মনে করেন ‘পিইসি পরীক্ষা থাকলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার চাপ থাকবে। তখন তারা ভালোভাবে পড়বে।’ এই চাপে রাখার কৌশল যে শিশুদের কতবড় ক্ষতি করছে তা উপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যাবার কথা।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় হলো তার শৈশব, যা এখন অন্ধকারে ঢেকে আছে। জ্ঞান, বিবেক, নৈতিকতার আলো আজ সেখানে পৌঁছায় না। শত শত অভিভাবকের আক্ষেপ, শিক্ষকের গ্লানি, ছাত্রের হতাশা এ দেশের শাসকরা অনুধাবন করে না। দায়িত্বহীনের মতো শিশুদেরকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিতেও তাদের এতটুকু কুণ্ঠাবোধ হয় না। কিন্তু বিবেক ও মনুষ্যত্ব নিয়ে আমরা তো বাঁচতে চাই। তাই আমাদের দায় একটু বেশি। সারাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পিইসি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আমাদের সকলকে এ আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ভীষণ প্রয়োজন।

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments