রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ সময়ে যা যা ঘটেছে তার ভয়াবহতার বিবরণ দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পত্র-পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে এ খবর এখন সারাদেশের মানুষ জানেন। জাতিসংঘের ধারণা, এ পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনও মানুষের ঢল বন্ধ হয়নি।
রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়। এরা বেশি সুবিধার আশায় এদেশে ঢুকতে চাইছে — ব্যাপারটা এমনও নয়। তারা প্রাণরক্ষার জন্য এদেশে আশ্রয় চাইছে। তাদের আশ্রয় দেয়া সরকারের মানবিক কর্তব্য। তাদের সাহায্য করা এদেশের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। কোনো স্বাধীন দেশের মানুষ, কোনো মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি এ দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা হলো গণহত্যা। এটা কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নয়। সরকার পরিকল্পনা করে তার বাহিনী দিয়ে এই জনপদের মানুষকে গণহারে হত্যা করছে, তাদের ঘরের মেয়েদের ধর্ষণ করছে, নির্যাতন করে করে তিল তিল যন্ত্রণা দিয়ে মারছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দেশের সাধারণ জনগণ এ ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারে না, তা নয়। জাতি হিসেবে এরকম গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখোমুখি আমরাও হয়েছিলাম। আমরা কি সে কথা ভুলে যেতে পারি? আমাদের কি এ সময়ের কর্তব্য ঠিক করতে বিতর্ক করতে হবে? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে একটা ছোট অংশ আমরা উল্লেখ করতে চাই। প্রবন্ধটি গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, “. . .মানুষ কেন শরণার্থী হয়, বাংলাদেশের মানুষ সেটা জানে। একাত্তরের কথা তাদের পক্ষে কোনোদিনই এবং কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। লাখ লাখ বাঙালি যে সেদিন শরণার্থী হয়েছিল, তা কাজের খোঁজে বা সুবিধার লোভে নয়, প্রাণের ভয়ে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। গণহত্যার মুখোমুখি হয়ে তারা বিষয়-সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল, এমনকি আপনজনকেও ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতেই পালিয়ে আসছে। তারা মারা পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে। মৃতের লাশ, আহত মানুষ, বিপনড়ব শিশু ও বৃদ্ধকে মাথায় করে, কোলে করে নিয়ে তারা ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে, নৌকা ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের আশ্রয় না দিলে তারা যাবে কোথায়? আমরা আজ যদি বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিই, তাহলে কেবল নিজেদের ইতিহাস থেকেই নয়, অন্তর্গত মনুষ্যত্ব থেকেও বিচ্যুত হব।”
এখন কথা আসতে পারে রোহিঙ্গারা দেশে যে অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয় — তার জবাব কী? এদের তো মাদক চোরাকারবারি কিংবা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ব্যবহার করবে। ঠিক, তাদের ব্যবহার করা হয়। এই লোকেরা রোহিঙ্গাদের না পেলেও অন্য কাউকে না কাউকে ব্যবহার করে তাদের কাজ করে। রোহিঙ্গারা এখানে এসে কোনোরকম কাজকর্মবিহীন অবস্থায় অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটায় বলে টাকার বিনিময়ে অনেক কিছুই তারা করতে বাধ্য হয়। সেটা রোহিঙ্গা আসার সমস্যা নয়। এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পেতে হলে যারা এ কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
সেক্ষেত্রে যত রোহিঙ্গা আসে তাদের শরণার্থী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে, শরণার্থী কার্ড দিয়ে, শরণার্থী শিবিরে পুনর্বাসন করা উচিত। তাহলে তাদের সংখ্যা ও তাদের পরিচয় সম্পর্কিত নির্দিষ্ট তথ্য সরকারের হাতে থাকবে। সেই শরণার্থী শিবির পরিচালনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইতে পারে সরকার। একই সাথে মিয়ানমার সরকারের উপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা দরকার যাতে তারা রোহিঙ্গাদের উপর এই অমানবিক অত্যাচার বন্ধ করে ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়। তাদের এই অত্যাচারের কথা বিশ্ববাসীকে জানানোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সারা বিশ্ব যাতে মিয়ানমার সরকারের এই ঘৃণ্য আচরণের বিরুদ্ধে সরব হয় সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করা উচিত। রোহিঙ্গাদের সব রকম নাগরিক অধিকার দিয়ে তাদের নিজস্ব জায়গায় পুনর্বাসিত করার ব্যাপারে কিছু দলিল বাংলাদেশ সরকার ব্যবহার করতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে এ নিয়ে আলোচনা তুলতে পারে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা এ ব্যাপারে কিছু দলিলের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “ . . . ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও তৎকালীন বার্মা সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘রিপ্যাট্রিয়েশান এগ্রিমেন্ট’ বা ‘প্রত্যাবাসন চুক্তি’তে সেসময় বার্মা থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে বার্মার বৈধ নাগরিক হিসেবে পরিষ্কার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল এবং এই চুক্তির আওতায় তাদের ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের যৌথ ঘোষণাতেও একইভাবে সেসময় বাংলাদেশে আসা শরণার্থীদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করা হয়। এগুলো ঐতিহাসিক দলিল, ১৯৭৮ সালের চুক্তিটি পাওয়া যাচ্ছে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে, ২০১৪ সালে গবেষণার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিকে সরবরাহ করা হয়েছিল। আর ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণাটি পাওয়া যাচ্ছে forcedmigration.org এর ওয়েবসাইটে। এগুলো নিশ্চয় বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আছে, তাহলে আজকে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে এই দলিলগুলো ব্যবহার করে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকারের বিরোধিতা ও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে আন্তর্জাতিক তৎপরতা চালাতে অসুবিধা কোথায়?”
সরকারের অসুবিধা কোথায় আমরা জানি। রাষ্ট্রটা যেহেতু পুঁজিবাদী, সে একটা শ্রেণিগত লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতেই এ ব্যাপারগুলো দেখে, মানবিক দিক থেকে নয়। একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেবার মানবিক দায় আজ কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই অনুভব করে না, একটা সময় সমাজতান্ত্রিক শিবির যখন বিশ্বে ছিলো তখন সে এই দায়িত্ব পালন করতো। এই রাষ্ট্রগুলো যতটুকুও বা করে তা জনগণের চাপে পড়ে করে। সিরিয়ার সংকটেও আমরা দেখেছি রাষ্ট্র বাধা দিলেও ইউরোপের দেশে দেশে সাধারণ মানুষ শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও এদেশের মানুষকে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের দলের পক্ষ থেকে শরণার্থীরা অবস্থান করেন এমন এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। সেখানে উপবাসী লোকেরা বসে আছেন আশ্রয়ের আশায়। তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করার জন্য দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই মানুষের কাছে আহবান জানানো হয়েছে।