আমরা গভীর বেদনার সাথে জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও এই দেশের বামপন্থী আন্দোলনের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গতকাল ৬ জুলাই রাত ১০.৫০ মিনিটে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউ-তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বৃদ্ধবয়সে রোগাক্রান্ত শরীরে আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ও চলৎশক্তিহীন হয়ে গত ১৪ মার্চ থেকে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের পক্ষ থেকে আমরা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং প্রয়াত নেতার সংগ্রামী জীবনের প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁর এই মৃত্যুতে শুধু আমাদের দলেরই নয়, এই দেশের বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও এক বিরাট ক্ষতি হল।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতে চট্টগ্রাম জেলার বাড়বকুণ্ডতে জন্মগ্রহণ করলেও কৈশোরেই কলকাতার খিদিরপুরে চাকুরিরত তাঁর এক ভাইয়ের আশ্রয়ে চলে যান। তিনি প্রথাগত বিদ্যালাভের বিশেষ সুযোগ পাননি এবং সাধারণ জীবনযাপন করছিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষের মাটিতে বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট), এসইউসিআই (সি)—কে এক সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এবং তারই কার্যক্রম হিসাবে খিদিরপুরে শ্রমিকদের মধ্যে ইউনিয়ন গঠন করছিলেন। এইসময়ে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই ১৯৫১ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী পরিচয় ঘটে। এই ঘটনা কমরেড মুবিনুল হায়দারের জীবনে আমূল পরিবর্তন সূচনা করে। তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের মার্কসবাদ—লেনিনবাদের যুগোপযোগী বিশেষীকৃত প্রজ্ঞাদীপ্ত ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ, তাঁর অসাধারণ চরিত্র, শোষিত জনগণের প্রতি অগাধ ভালবাসা, সকল প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে বিপ্লবী দল গঠন ও সংগ্রামে অদম্য দৃঢ়তা ও মনোবল, বিরল সাংগঠনিক শক্তি যতটা ঐ বয়সে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাতেই গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষকে শিক্ষক ও নেতা হিসাবে গ্রহণ করে বিপ্লবী আন্দোলনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন।
এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে তিনি খিদিরপুরে ডক শ্রমিকদের, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করেছেন, কর্মী সংগ্রহ করেছেন, পার্টি ইউনিট গঠন করেছেন। ওই সময়ে কংগ্রেস সরকারবিরোধী নানা আন্দোলনে তিনি বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হন এবং তাঁর ওপরে পুলিশী হামলাও হয়। সরকারি চাকুরিরত ভাই তাতে ভয় পেলে কমরেড মুবিনুল হায়দারকে আশ্রয় ছাড়তে হয়। ওই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ, নীহার মুখার্জীদের কোনও স্থায়ী আস্তানা ও খাদ্যের সংস্থান ছিল না। কমরেড মুবিনুল হায়দারকেও আশ্রয়চ্যুত হয়ে অনেক দিন অর্ধাহারে—অনাহারে কলকাতার পার্কে—ফুটপাতে রাত কাটাতে হয়েছে। কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত এই সংগ্রামী মানুষটি শোষিত মানুষের বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ১৯৬৪ সালে ভারতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বিগ্ন হয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দেশের হিন্দু—মুসলমান ছাত্র যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার জন্য কমরেড মুবিনুল হায়দারকে দায়িত্ব দেন এবং বহু প্রদেশ ঘুরে খুবই যোগ্যতার সাথে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কলকাতায় তারঁই উদ্যোগে এক বিশাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই দলের সংগ্রামী যুব সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ অর্গানাইশেন (এআইডিওয়াইও)’ গড়ে ওঠে, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার। ১৯৬৭ সালে তাঁকে দিল্লিতে পাঠান হয় এবং তিনি দিল্লি ও হরিয়ানায় এসইউসিআই (সি)—এর সংগঠন গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য যে, প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে থেকে এবং জ্ঞানজগতের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে তাঁর অনন্যসাধারণ আলোচনা শুনে কমরেড মুবিনুল হায়দার দর্শন—রাজনীতি—ইতিহাস—সাহিত্য—সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বহু ছাত্র—যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল।
ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কমরেড মুবিনুল হায়দার সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরগুলি ঘুরে ঘুরে পার্টির পক্ষ থেকে ত্রাণকার্য পরিচালনা করেন এবং প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে মার্কসবাদ—লেনিনবাদ—শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে একটি যথার্থ বিপ্লবী দল গঠনের স্বপ্ন নিয়ে স্বদেশে চলে আসেন। মনে রাখতে হবে, সেইসময়ে তিনি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের কোনও প্রতিষ্ঠিত নেতা ছিলেন না, একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। এইসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন তথা সামাজিক জীবন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছিল। একদিকে বহু শহীদের আত্মদানে অর্জিত স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যবহার করে আপসকামী বুর্জোয়া নেতৃত্ব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পাকিস্তানি অত্যাচার—শোষণের পরিবর্তে বাংলাদেশী শোষক—লুটেরাদের শাসন কায়েম করেছে। অন্যদিকে ছাত্র—যুব সমাজ ও জনগণের মধ্যে শোষণমুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকুতি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু তাঁদের সঠিক পথ দেখাবার মত কোনও যথার্থ বিপ্লবী দল ও নেতৃত্ব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষা ও অসাধারণ সংগ্রামের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এক কঠিন ও কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হন। সেইসময় তারঁ কোনও পরিচিতি ছিল না, সঙ্গী—সাথী ছিল না, যোগাযোগ ছিল না, থাকা—খাওয়ার সংস্থান ছিল না। অন্যদিকে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) ও কমরেড শিবদাস ঘোষও বাংলাদেশে অপরিচিত নাম ছিল। এই অবস্থায় কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাসম্বলিত কয়েকটি পুস্তক হাতে নিয়ে তিনি নানাস্থানে ঘুরেছেন, বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতা—কর্মী ও বুদ্ধিজীবী যাকেই পেয়েছেন, তাঁকেই এইসব পুস্তক দিয়েছেন, নিজের উপলদ্ধি অনুযায়ী মার্কসবাদ—লেনিনবাদ—শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন।
এই প্রক্রিয়ায় সদ্য সংগঠিত যৌবনোদ্দীপ্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)—এর অনেক নেতৃবৃন্দ ও সংগঠক তাঁর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণের প্রতি আকৃষ্ট হন। জাসদের কোনো স্তরের সদস্য কিংবা সাংগঠনিক দায়িত্বে না থাকার পরও ওই দলটির নেতৃত্বের একাংশের ওপর তিনি আদর্শগত ছাপ ফেলতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের মার্কসবাদী বিচারধারা এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার আলোকে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী দল গঠনের নীতিগত ও পদ্ধতিগত সংগ্রামের শিক্ষা কমরেড মুবিনুল হায়দার যে মাত্রায় জাসদের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছেন, সেখানে নিয়ে গেছেন। তাঁর সাথে যারা ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তাদের বিপ্লবী কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবী দল গড়ে তোলার আদর্শগত ও সাংগঠনিক সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে ওঠেন জাসদ—এর একদল নেতা—কমী। এদেরই একটি অংশ পরবর্তীতে জাসদ নেতৃত্বের হঠকারিতা, আপোষকামিতা, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভ্রান্তির বিরুদ্ধে দলের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
এই নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি ১৯৮০ সালে ‘প্ল্যাটফর্ম অফ অ্যাকশন’ হিসাবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) গড়ে তোলেন। মার্কসবাদ—লেনিনবাদ—শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে নতুন করে বিপ্লবী দল গড়ে তোলার এই সংগ্রামের মূল কেন্দ্র ছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলেও তাঁর নাম তখন প্রকাশ করা হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান নেতৃত্বে না থাকলেও বাসদ—এর অন্য সকল নেতাদের কাছে তিনি শিক্ষক ও নেতা হিসাবেই গণ্য ছিলেন। সঠিক লাইন ও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের বিপর্যয় ও শোধনবাদের বিকাশ সম্পর্কিত যথার্থ মূল্যায়ন, বাংলাদেশের উৎপাদনপদ্ধতি—রাষ্ট্রচরিত্রসহ প্রসঙ্গে অন্যান্য বাম দলের রণনীতি—রণকৌশলের সাথে স্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরা, রবীন্দ্র—শরৎ—নজরুল সহ শিল্প—সাহিত্য সম্পর্কে মার্কসবাদী বিশ্লেষণ, শিক্ষা আন্দোলনে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা, সর্বহারা নৈতিকতা ও সংস্কৃতির আধারে কর্মীদের গড়ে তোলার প্রচেষ্টা Ñ— ইত্যাদি এদেশের বাম রাজনীতিতে বাসদ—এর একটি বিশিষ্ট অবস্থান তৈরি করে। বাসদ কর্তৃক ঘোষিত জীবনের সর্বক্ষেত্রব্যাপী মার্কসবাদ চর্চার লক্ষ্য নির্ধারণ, ‘দলই জীবন, বিপ্লবই জীবন’ এই চেতনায় সর্বহারা শ্রেণীচেতনার মূর্ত রূপ হিসাবে দলের সাথে ব্যক্তিসত্তাকে একাত্ম করার ধারণা, নেতাকর্মীদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব—সমন্বয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট যৌথজ্ঞানের ভিত্তিতে যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ গড়ে তোলা, কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পত্তিজাত মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম, গণচাঁদার ভিত্তিতে দলের আর্থিক ভিত্তি দাঁড় করানো, ব্যক্তিসম্পত্তিভিত্তিক পরিবারকেন্দ্রিক জীবনের স্থলে পার্টি মেস—সেন্টার গড়ে তুলে দলকেন্দ্রিক যৌথজীবনের ধারণা, জনগণের ওপর নির্ভরশীল সার্বক্ষণিক কর্মী বা পেশাদার বিপ্লবী গড়ে তোলা, ব্যক্তিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে যৌথস্বার্থ ও যৌথচেতনাকেন্দ্রিক দলীয় সংস্কৃতি নির্মাণ — এই সকল ধারণা দলে নিয়ে আসা ও চর্চার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করেছেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী।
সর্বহারা নৈতিকতা ও উন্নত রুচি—সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে তাঁর জীবন, সংগ্রাম ও আচরণ দলের নেতাকর্মীদের সামনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে সবসময় ছিল। তিনি যখন যেখানে অবস্থান করেছেন, সবসময় নেতা—কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে কমরেড শিবদাস ঘোষসহ মার্কসবাদী অথরিটিদের জীবন ও শিক্ষাকে তুলে ধরেছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ—রাজনীতি—অর্থনীতি—ইতিহাস—রুচি—সংস্কৃতি—শিল্প—সাহিত্য—সঙ্গীতসহ জ্ঞানজগতের ও জীবনের সকল সমস্যা সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধরানোর জন্য ক্লান্তিহীনভাবে আলাপ—আলোচনা করেছেন। নেতা—কর্মীদের চরিত্রের কাঠামো পাল্টানো ও বিপ্লবী হিসাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম করেছেন। নিজের হাতে তিনি অসংখ্য বিপ্লবী কর্মী, সার্বক্ষণিক ক্যাডার ও সমর্থক—শুভানুধ্যায়ী তৈরি করেছেন। বাসদ—এর অভ্যন্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যসহ বিপ্লবী দল গড়ে তোলার মূলনীতিগত প্রশ্নে মৌলিক পার্থক্য দেখা দিলে ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল কমরেড মুবিনুল হায়দারকে আহ্বায়ক করে বাসদ—কনভেশন প্রস্তুতি কমিটি নামে নতুন দল গঠিত হয়, যা পরে কনভেনশনের মাধ্যমে বাসদ (মার্কসবাদী) নাম গ্রহণ করে। আদর্শগত প্রশ্নে পুরানো দলে বাহ্যিক সম্মান—প্রতিষ্ঠা ও নিরাপদ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে ৮০ বছর বয়সে শূন্য হাতে নতুন করে সংগ্রাম শুরু করার ঘটনা কমরেড মুবিনুল হায়দারের দৃঢ় চরিত্র, উচ্চ মনোবল ও গভীর আদর্শনিষ্ঠার পরিচায়ক।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী একদিকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মোর্চা গঠনে সক্রিয় ভুমিকা রেখেছেন।
নতুন দল গড়ে তোলার সংগ্রাম যখন শুরু হয়, তখন তিনি একের পর এক রোগের আক্রমণে গুরুতর অসুস্থ। ইতিপূর্বে তাঁর হার্টে বাইপাস সার্জারি হয়েছে, তারপর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ায় ব্রেনে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়, ব্রেনে মাইল্ড স্ট্রোকও হয়। ফলে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে আগের মত সুস্থ ও সক্ষম ছিলেন না। অন্যদিকে নূতন দলে মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে ওঠার স্তরে থাকায় অধিকাংশ নেতা ও কর্মী এই প্রক্রিয়ায় চিন্তা করতে ও আলোচনা করতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি। তাঁকে কার্যকরীভাবে সাহায্য করার মত ও ভুলভ্রান্তি থেকে মুক্ত করতে সক্ষম উপযুক্ত নেতাও গড়ে ওঠেনি, ফলে বহু সিদ্ধান্তই তাঁকে এককভাবে নিতে হয়েছে। এই সঙ্কট কাটানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে পার্টি সমালোচনা—আত্মসমালোচনার মাধ্যমে অতীতের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্টির আদর্শগত ও সাংগঠনিক কেন্দ্রীকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীরও খোলামেলা সমালোচনা হয়, তিনি তা গ্রহণ করেন। এটা তাঁর চরিত্রের মহত্ত্বের দিক।
সামগ্রিকভাবে বলা চলে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশে মার্কসবাদের এক সঠিক উপলব্ধি ও জীবনব্যাপী চর্চার আন্দোলন শুরু হয়, বিপ্লবী রাজনীতিতে উন্নত চরিত্র ও সংস্কৃতি অর্জন যে অপরিহার্য — কমরেড শিবদাস ঘোষের এই মূল্যবান শিক্ষার প্রভাব সৃষ্টি হয়। বহু ছাত্রযুবক অনুপ্রাণিত হয়, বামপন্থী আন্দোলনে এক নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। দলের নেতাকর্মীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক আবেগপূর্ণ, বন্ধুত্বমূলক ও খোলামেলা ছিল।
আমাদের দল বর্তমানে যখন বাইরের ও ভিতরের বিভিন্ন আদর্শগত আক্রমণকে পরাস্ত করে, ভুলভ্রান্তিমুক্ত হয়ে মহান মার্কসবাদ—লেনিনবাদ—শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় নূতন স্তরে উন্নীত হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, তখন সংগ্রামী নেতা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর এই মৃত্যু আমাদের কাছে এক বিরাট ক্ষতি হিসাবে এসেছে। এই গভীর শোকের মুহুর্তে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, আমরা মহান মার্কসবাদ—লেনিনবাদ—শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে, উন্নত সর্বহারা সংস্কৃতি অর্জনের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে প্রয়াত নেতা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর অপূর্ণ স্বপ্ন বাংলাদেশে যথার্থ শক্তিশালী সাম্যবাদী দল গঠনের সংগ্রাম এবং একইসাথে তীব্রতর শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী লাল সালাম!
কর্মসূচি : কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মরদেহ হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মরদেহ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগে হস্তান্তর করা হবে আগামীকাল ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার। মরদেহ হস্তান্তরের পূর্বে আগামীকাল বেলা ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসস্থ শহীদ ডা. মিলনের সমাধিস্থলে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বর্তমান কভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে এই আয়োজন সম্পন্ন করা হবে।
বাসদ (মার্কসবাদী) দলীয়ভাবে তিনদিন ব্যাপি শোক পালনের কর্মসূচী নিয়েছে। সকল দলীয় কার্যালয়ে এই তিনদিন পার্টি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
বার্তা প্রেরক
মানস নন্দী
সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটি।
যোগাযোগ : ০১৭১১৮৮৯০৮০