মারামারি করা ভালো নহে, তথাপি আমরা বাল্যকালে মারামারি করিয়াছি। লাটিম, মার্বেল, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলিতে গিয়া আমরা প্রত্যহ এই কর্মে লিপ্ত হইতাম। আমাদের কী দোষ? আমাদের কথা মান্য না করিলে তখন আমাদের আর কি-ই বা করিবার থাকে? দেখিলাম পরিস্কার আউট, অথচ আম্পায়ার নির্বিকার। মারামারি বাঁধিবে না? আমাদের পোস্টে বল ঢুকাইয়া, গোল বলিয়া চিৎকার করিয়া প্রতিপক্ষ আকাশ বিদীর্ণ করিয়া ফেলিতেছে অথচ স্ট্রাইকার অফ সাইডে ছিল। মারামারি হইবে না? সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মারামারি একটু-আধটু করিতে হয়। তাহাতে ক্ষতি কী? ইহাতে সত্যের মর্যাদা কমিয়া যায় না, বরং মারামারির গৌরব বাড়ে।
গত কয়েকদিন যাবৎ শিক্ষকদের মারামারির সংবাদ পত্রিকার পাতায় আসিতেছে দেখিয়া অনেকে বুক চাপড়াইতেছেন। সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের এই রচনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদিগের গোষ্ঠী ‘নীল দল’ নামে পরিচিত। তাহারা কড়া আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের ওয়ার্ড কমিটির নেতা গিয়াসউদ্দিন যেমন কথায় কথায় অন্যদের চাটি মারে, মারে ‘সোনার বাংলা’ গড়িয়া তোলার জন্যই, বুঝাইয়া তো আর দেশ গঠন করা যায় না – তেমনি শিক্ষকেরাও হাত তুলেন। গত কিছুদিন আগে সিনেট নির্বাচনের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী মানববন্ধনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখাইয়াছেন। গিয়াসউদ্দিন দেখে নাই, দেখিলে লজ্জা পাইত।
এই সকল ব্যাপার নিয়া পত্রিকায় যত সমালোচনাই হউক, মানুষ যতই ছিঃ ছিঃ করুক, আমরা মনে করি ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত এই শিক্ষকদের দমিয়া যাইবার কোনো কারণ নাই। ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা সহজ নহে, আমরা জানি। ছোটবেলায় খেলার মাঠে সত্য প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া আমরা তাহা বুঝিয়াছি। শুধু বুঝাইয়া হয় না, পিটাইতে হয়। তার উপরে ‘সোনার বাংলা’! না পুড়িলে খাঁটি সোনা কীভাবে হইবে? জনগণকে প্রথমে তাই পুড়াইতে হইবে।
কথা মনে হয় আমরা বেশি বলিয়া ফেলিতেছি। একটু ইমোশোনাল হইয়া পড়িয়াছি বোধ হয়। কেন হইব না? সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য কেহই ধরিতে পারিতেছে না। দেখিয়া হৃদয়ে খুব চোট পাইতেছি। দেশটা বোঝার মতো কেহ নাই।
যাহা হউক প্রসঙ্গে ফিরিয়া আসি। বলিতেছিলাম নীল দলের কথা। তাহারা ছাত্র পিটাইয়াছেন, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করিয়াছেন — ঠিক করিয়াছেন। করিয়াছেন এক মহান উদ্দেশ্যকে সম্মুখে রাখিয়া। আমাদের পরিচিত এক চলচ্চিত্র পরিচালক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ধারণকৃত ওইদিনের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করিয়াছেন। বলিলাম ‘কী করিবেন?’ বলিলেন, ‘সিনেমা বানাইব।’ কী নাম দিবেন? তিনি দরাজ গলায় বলিলেন, ‘এবার তোরা ছাত্রলীগ হ’ । আমি বলিলাম, ‘নামটা পরিচিত শোনাইতেছে।’ তিনি বলিলেন, ‘নামটা পরিচিত লাগিতে পারে, তবে কাজটা নিশ্চয় আপনার পরিচিত মনে হয় নাই?’ আমি বলিলাম, ‘না’। তিনি জবাব দিলেন, ‘একেবারে ইউনিক!’
এই নীল দলের শিক্ষকেরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হইয়াছেন। পত্রিকায় খবর দেখিয়া আমরা একটু চিন্তায় পড়িয়া গিয়াছিলাম। পরিচালক বন্ধু ভুল ভাঙ্গিয়া দিলেন। ‘প্র্যাকটিস, বুঝিলেন প্র্যাকটিস। তাহারা প্র্যাকটিস করিতেছিলেন। মারধর প্র্যাকটিস করিতে হয় না? ইহাকেই পত্রিকাওয়ালারা না বুঝিয়া মারামারি বলিয়া প্রচার দিতেছে।’
এই ভুল প্রচার করিয়া সরকার মহোদয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা উচিত নহে। লিখিয়া দিলেন ‘অমুক কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ।’ কেন, তাহারা প্র্যাকটিস করিতে পারে না? দামাল ছেলেরা একসাথে থাকিলে একটু আধটু টাই টুই হয়-ই। তাহাতে এত প্রচারের কী আছে? তাহারা যে কত কত ভালো ক্রিয়া করে তাহা কি লেখা হয়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা আওয়ামী লীগের কমিটিতে আছেন বলিয়া সমালোচনা শুরু হইয়া গেল। কেন? ওরকম প্রকান্ড ও প্রচন্ড দলের কমিটিতে কি লোকেরা থাকিতে চাইবে না? ইহা তো গৌরবের ব্যাপার। আজ যদি আইনস্টাইন বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে তিনি নিশ্চয় আমাদের প্রাণপ্রিয় দলের বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক হইতে চাহিতেন। দুঃখের ব্যাপার, তিনি বাঁচিয়া নাই। স্টিফেন হকিংও হাঁটাচলা করিতে পারেন না। গোটা দুনিয়ায় আজ জ্ঞানী লোকের অভাব। তাই যাহার যা মনে আসিতেছে বলিতেছে।
মন আজ কয়েকদিন যাবৎ খুবই ভারাক্রান্ত। এই পোড়া দেশের উন্নয়নের জন্য এত চেষ্টা, তাহা কাহারও চোখে পড়িতেছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লেখাপড়া শিক্ষা শেষ করিয়া এখন ফাইটিং শিখিতেছেন। ইহা কি সিনেমার হিরো হইবার জন্য? দেশ গড়িয়া তোলার জন্য এত কষ্ট, এত পরিশ্রমের মূল্য কি কেহই দিবে না?
গাল বাহিয়া দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। এই ব্যথা কে বুঝিবে? আর কত পিটাইলে বুঝিবে?