Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুলাই ২০১৮ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার লড়াই চলছে, চলবে আরও বহুদিন

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার লড়াই চলছে, চলবে আরও বহুদিন

DdKl8BcXUAMuJaM
এ যেন দুই চোখে দুই জিনিস দেখার মতো ব্যাপার। আপনি এক চোখে যখন গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্নাইপারের গুলিতে ৬২ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু, কমপক্ষে তিন হাজার মানুষের রক্তাক্ত আহাজারি আর ধোঁয়া-ধূলা-টিয়ারগ্যাস আর রক্তের হোলিখেলা দেখছেন। ঠিক সেই সময়ে অন্য চোখে দেখবেন – গাজা থেকে মাত্র ৫০ কিলিমিটার দূরে জাকজমকপূর্ণ এক আয়োজনে, শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে, সেলফি তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প আর তার স্বামী জ্যারেড কুশনার জেরুজালেমে নতুন মার্কিন দূতাবাসের উদ্বোধন করছেন।

গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমস্ত প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেবার ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথে রামাল্লা, বেথলেহেম, হেবরনসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ হয়েছে। গাজা উপত্যকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীদের সাথে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে জর্ডান, তিউনিসিয়া, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। তারই একপর্যায়ে গাজার ইজরায়েল সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কর্তৃক ৬২ জন ফিলিস্তিন হত্যার ঘটনা ঘটে।

ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমিতেই পরবাসী। নিজের দেশেই থাকতে হলেও তাদের জীবন দিতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এই রক্তাক্ত অধ্যায়টির সূচনা ঘটে আজ থেকে ৭০ বছর আগে। বিশ্বসা¤্রাজ্যের মোড়লদের চক্রান্তে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরব ভূখ-ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৪৮ সালে একটি তথাকথিত ‘ইহুদি’ রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম দেয়। সেই একই প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও কথা ছিল। কিন্তু ৭০ বছরে ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হলেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন ভূখ- আজও অধরাই রয়ে গেছে।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র (একটি ইহুদি, অন্যটি আরব) গঠন করার উদ্যোগ নেয়। আরবরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। প্রতিবেশী চারটি দেশ মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে আরবেরা পরাজিত হয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাসহ অবিভক্ত প্যালেস্টাইনের ৭৭ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। এর বাইরে বাকী অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম জর্ডান এবং গাজা মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে আরেকটি যুদ্ধ হয় ইসরায়েলের। ছয়দিনের এই যুদ্ধে জর্ডান পরাজিত হয় এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয় মিশরও।

এরপর ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো চুক্তির মাধ্যমে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় তাতে পশ্চিম তীর ও গাজায় নামকাওয়াস্তে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। ততদিনে অবশ্য এ অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা ইসরায়েলিদের দখলে চলে গেছে। আজও সেখানে নামেই আছে স্বায়ত্তশাসন। চারপাশে ইসরায়েলের পাহারা, উঁচু দেয়াল। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতেও ইসরায়েলের অনুমতি লাগে।

ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী ধিকৃত, কিন্তু তবুও একাজ করার সাহস তারা পেয়েছে এবং পাচ্ছে মার্কিন শাসকদের কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থ, অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলিদের সহায়তা করে আসছে সেই শুরু থেকেই। ফিলিস্তিন স্বাধীন ভূ-খন্ডের স্বীকৃতিও পায়নি তাদের কারণে। জেরুজালেম শহরকে নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহতেও আছে তাদের হাত। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। তখন থেকে এ শহরটিকে রাজধানী হিসেবে ইসরায়েল ঘোষণা করে। ফিলিস্তিনিরা তা মানেনি। বরং স্বাধীন ফিলিস্তিন হলে তার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম – এই তাদের ঘোষণা। বিশ্বের কোনো দেশ ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু জেরুজালেম নয়, ৬৭ সালে ইসরাইল যেসব এলাকার দখল নিয়েছিল সেগুলোকে জাতিসংঘসহ বিশ^সম্প্রদায় এতদিন ‘অধিকৃত এলাকা’ বলে অভিহিত করে এসেছে এবং সেখান থেকে ইসরাইলকে দখল প্রত্যাহার করতে হবে এই দাবি করে এসেছে। ট্রাম্প এই ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ইসরাইলের দখলকেই বৈধ স্বীকৃতি দিলেন। অর্থাৎ, দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব বাতিল করে প্যালেস্টাইন ভূ-খ-ে একক রাষ্ট্র থাকবে ইসরাইল – এর পক্ষে মার্কিন সমর্থন ঘোষণা করলেন। এর প্রতিক্রিয়াতেই সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং তা দমনে নির্মমতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অপতৎপরতার সাথে জড়িয়ে আছে আরেকটি দেশ, সৌদি আরব। মুসলিম বিশ্বের মোড়ল হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেও কেবল ক্ষমতার স্বার্থে ইসরায়েলের সাথে হাত মেলাতে তার বাধে না। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সৌদি যুবরাজ সালমান নিউইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি আমেরিকান ইহুদি নেতৃবৃন্দকে নিশ্চয়তা দেন যে, ‘প্যালেস্টাইন ইস্যু সৌদিদের অগ্রাধিকারে নেই এখন।’ আসলে সৌদি আরব আর ইসরায়েল এখন পরস্পর সম্পর্ক সূত্রে আবদ্ধ। সৌদি আরব চাইছে ইসরায়েলকে সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি যাওয়া এবং ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেয়া। অন্যদিকে ইসরায়েলের চাওয়া হলো ইরানের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের পক্ষে সৌদি অর্থায়ন এবং সৌদি আরবের ভূমি ব্যবহার। বলার অপেক্ষা রাখে না, সৌদি আরবের মুখাপেক্ষী মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ সৌদি-ইসরায়েল এই অবস্থানের বিরুদ্ধে যাবে না। এ কারণেই ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম অত্যাচারের পরও আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিশ্চুপ দেখতে পাই।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি নিপীড়ন যেমন সত্য ঘটনা, তেমনি এই দীর্ঘ সময়ে ফিলিস্তিনি জনগণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এত দমন-পীড়ন-নির্যাতনেও ফিলিস্তিনিরা তাদের মাথা নত করেনি। এই সময়েও একটি ঘটনা এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে। হুইল চেয়ারে বসা, দুই পা নেই এমন একজন ফিলিস্তিনি যুবক আবু সালেহর ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে গুলতি ছুঁড়ে দেবার ছবি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। লড়তে লড়তে জীবন দেয়া এই অকুতোভয় যোদ্ধা বিশ্বের সকল নিপীড়িত-লড়াকু মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু একজন আবু সালেহ নয়, এমন অসংখ্য যোদ্ধা প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ফিলিস্তিনে। ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়ছে ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোর-যুবারা। মাতৃভূমি রক্ষায় তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সৌদি আরব – কোনো অন্যায়ের শক্তি নেই তাদের রুখে দাঁড়াবে। ৭০ বছর ধরে লড়াই চলছে, চলবে আরও বহুদিন। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার লড়াই বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চলবে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments