করোনা ভাইরাসে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদী বৃহত্তর সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে। আরো কত মানুষের মৃত্যু ঘটবে আমরা জানি না। সংক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থ সরকার জনগণকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, যারা মরার মরবে ও যারা বাঁচার বাঁচবে। অন্যদিকে করোনাজনিত অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে ছাঁটাই-বেতন কর্তন চলছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে। প্রবাসীরা অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দিয়ে ৬০ হাজার শ্রমিককে এক ধাক্কায় বেকার করে দিয়েছে, পাটচাষীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভুতুড়ে বিদ্যুৎবিলের বোঝা, বর্ধিত পানির বিল-গাড়িভাড়ায় মানুষ দিশাহারা। অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষ-কৃষক-নিম্নবিত্তকে সহায়তা দেয়ার পরিবর্তে সরকার প্রধানত শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে।
এই মহামারীর সময়েও যে লাগামহীন দুর্নীতি-প্রতারণা ও জালিয়াতি হতে পারে, সেই নজির স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। মাস্ক ও পিপিই কেনায় দুর্নীতি, কোভিড পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। গরীব মানুষের জন্য বরাদ্দ করা চাল ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। লাখ লাখ টাকায় বালিশ-পর্দা কেনা, খিচুড়ি বিতরণ ও ভবন নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ, সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন – এধরনের অসংখ্য দুর্নীতির ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কীভাবে হরিলুট চলছে।
করোনা মহামারীতে আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের আসল চেহারা পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত হয়েছে। দুয়েক মাস লকডাউনেই দেশের বেশিরভাগ পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, অর্থাৎ কাজ বন্ধ থাকলে অল্প কিছুদিন চলবার মতো সঞ্চয় নেই বেশিরভাগ মানুষের। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহরেই বেশিরভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই-এর মতো প্রাথমিক জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা নেই, আইসিইউ-এর জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোর কথা বলাই বাহুল্য। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল সেবাখাতকে বেসরকারিকরণ করে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। চিকিৎসা সে-ই পাবে, যার টাকা আছে।
মানুষের জীবন বাঁচানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া ও প্রয়োজনে জনগণের খাদ্য-জীবিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য যে দায়বদ্ধ মনোভাব ও জনসম্পৃক্ত ব্যবস্থাপনা দরকার, তার কিছুই এ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রে নেই। রাতের আঁধারে ভোটডাকাতির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এ সরকারের জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। বরং তারা গণবিক্ষোভ ঠেকাতে ও সমালোচনাকারীদের দমনে গ্রেপ্তার-নিপীড়ন চালাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ২ বছরে হাজারের বেশি মামলা হয়েছে, দেড় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর সিন্হার মৃত্যু, তাকে মাদকব্যবসায়ী সাজানোর চেষ্টা, মাদক দমনের নামে শুধুমাত্র ওই জেলায় ‘ক্রসফায়ারে দুই শতাধিক মানুষ হত্যা এসব ঘটনায় উঠে এসেছে – এদেশে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে মানুষের জীবন কতটা নিরাপত্তাহীন।
এই করোনাকালে বাংলাদেশসহ তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি – পুঁজিবাদী সরকারগুলো সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব নেয়ার চাইতে মালিকগোষ্ঠী-শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের মুনাফা ঠিক রাখতে বেশি তৎপর।
এই পরিস্থিতিতে আসুন – মানুষের জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় নিম্নোক্ত আশু দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে সোচ্চার ও সংগঠিত হই:
১.সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা চাই। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় আয়ের ৬% বা জাতীয় বাজেটের ২০% বরাদ্দ কর। বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাবাণিজ্য বন্ধ কর। ঔষধ, অক্সিজেন ও অন্যান্য চিকিৎসা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর।
২.করোনা ও নন-করোনা সকল রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর-এর ব্যবস্থা কর। চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা-প্রণোদনা নিশ্চিত কর। প্রতিদিন ৫০ হাজার করোনা পরীক্ষা, সকল জেলায় ল্যাব ও উপজেলায় পর্যাপ্ত নমুনা সংগ্রহ কর।
৩.গরীব-মধ্যবিত্তের জন্য স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহে রেশনব্যবস্থা চালু কর। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বর্ধিত বিল প্রত্যাহার কর। রেল-বিআরটিসি’সহ সরকারি গণপরিবহন বাড়াও। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অল্প ভাড়ায় সরকারি আবাসন প্রকল্প বা কলোনী নির্মাণ কর। বাড়িভাড়া-গাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর কর।
৪. দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ কর, আয়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন সম্পদ বাজেয়াপ্ত কর। কালো টাকার মালিক-অর্থপাচারকারী-ঋণখেলাপী-ব্যাংক লুটেরাদের গ্রেপ্তার কর।
৫. কৃষকদের ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে রাষ্ট্রীয় ক্রয় বাড়াও। স্বল্পমূল্যে সার-বীজ-কীটনাশক ইত্যাদি উপকরণ ও কৃষিযন্ত্র সরবরাহ কর, কৃষিখাতে সরকারী বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়াও। মহাজনী ও এনজিও ঋণের সুদ মওকুফ কর, কিস্তি আদায় বন্ধ রাখ।
৬. রাষ্ট্রীয় পাটকল ও চিনিকল আধুনিকীকরণ করে চালু রাখ, লোকসানের জন্য দায়ীদের শাস্তি চাই। ছাঁটাই-বেতন কর্তন বন্ধ কর। অসংগঠিত খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকারি অর্থসহায়তার ব্যবস্থা কর। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ কর। সব শ্রমিকের জন্য অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও ‘সর্বজনীন পেনশন’ ব্যবস্থা চাই।
৭. শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চাই। সরকারিভাবে বেকার জনগোষ্ঠীর নাম তালিকাভুক্ত করে কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় শূন্যপদে নিয়োগ দাও, সরকারি চাকুরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত কর।
৮. করোনাকালে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ফি মওকুফ কর। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন সরকারি তহবিল থেকে দাও। শিক্ষার্থীদের মেস-হোস্টেল ভাড়া রেয়াত করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ চাই। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল কর। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ বন্ধ কর।
৯. নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে দোষীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মাদক-পর্নোগ্রাফি-জুয়া নির্মূল কর। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন চাই। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত কর। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সেনাশাসন প্রত্যাহার কর।
১০. স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান চাই। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বেআইনী আটক, হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ কর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারা বাতিল কর, গ্রেপ্তারকৃতদের জামিন দাও। প্রশাসন-বিচার বিভাগের দলীয়করণ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বন্ধ কর।
১১. অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
১২. ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বন্ধ কর। তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় কর। জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত না করে ভারতকে বন্দর ও রাস্তাঘাট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া চলবে না। সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ব্যয়বহুল-ঝুঁকিপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ কর।
ভুক্তভোগী সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে
১ – ৩১ অক্টোবর দাবি মাস
২৮ অক্টোবর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী ও সারাদেশে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ
সারাদেশে প্রচারপত্র বিলি, হাটসভা-পথসভা, মিছিল-সমাবেশ সফল করুন
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)
কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটি
২২/১ তোপখানা রোড (৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১০০০। ফোন ও ফ্যাক্স : ৯৫৭৬৩৭৩, ০১৭৭০-১০১৬৭৩।